একের পর ইতিহাস বদল করে হাসিনা সহ আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস। আর তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে চলেছেন এই সরকারের বিভিন্ন বিভাগে থাকা তাঁর সহকারী উপদেষ্টারা। ফলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে দুই দশকের দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যে ব্যক্তি দেশবাসীর হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তুলে দিলেন, সেই আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে এবার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। নতুন সরকারের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সনদ বাতিল হয়ে গেল। শুধু তিনি একা নন, তাঁর সঙ্গে আরও চারশোর বেশি নেতার ‘মুক্তিযোদ্ধা’র স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রাতেই এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশের বর্তমান তদারকি সরকার। সেই অধ্যাদেশ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের পথিকৃৎ মুজিব আর বাংলাদেশের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নন। বর্তমান সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বদলার রাজনীতি বলে মনে করছে ভারত সহ উপমহাদেশের একাধিক দেশের রাজনৈতিক মহল।
ইউনূস সরকারের নতুন এই অধ্যাদেশে বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ-সহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চারশোর উপর রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের প্রস্তাবে সিলমোহর দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৯৪তম সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছিল। গত ১০ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সংশ্লিষ্ট সেই খসড়ায় স্বাক্ষর করেন। সংশোধনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আরও চার শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে সনদ বাতিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট খসড়ায় বলা হয়, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল তাঁরাই থাকবেন, যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। রাজনীতিবিদরা সরাসরি যুদ্ধ করেননি, তাই তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করে নতুন পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে কোনও মর্যাদা কমানো হয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।’
ফলে মুক্তিযোদ্ধা কারা, সেই বিষয়ে সংজ্ঞা বদলে ফেলা হচ্ছে। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলছে। মুজিব মুছতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নাম রাখা হয়েছে ফজলুল কাদের চৌধুরী নামে এক কুখ্যাত গণহত্যাকারী রাজাকারের নামে। ঢাকার রাস্তায় ঘুরতে দেখা যাচ্ছে হিজবুত তাহরিরের জঙ্গিদের। দাঁত-নখ বের করেছে আনসারুল্লা বাংলা টিম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় প্রতিপন্ন করে যারা আসল রাজাকার, তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে প্রমাণ করতে চাইছে ইউনুস সরকার। আর সেই পথে হেঁটেই এবার ইউনুসের ‘মুক্তিযোদ্ধা’র মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ‘হাস্যকর’ পদক্ষেপ শুরু করল ইউনূস সরকার।
প্রসঙ্গত কয়েকদিন আগেই হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ‘১৯৭১-এর বদলা নেওয়ার দাবি করেছে ‘সন্ত্রাসী’ হাফিজ সঈদের সংগঠন। ফলে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা ছড়িয়েছে, ইউনূস সহ বেশ কিছু হাসিনা বিরোধী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতা পাক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে চক্রান্ত করে গণআন্দোলনের নামে মৌলবাদী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে হাসিনা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। কারণ, গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশে হাসিনা বিরোধী যে গণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে তাকে হাসিনার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের প্রকাশ বলে চালানো হয়েছিল বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে এবং গণমাধ্যমেও। পরবর্তীকালে জানা গিয়েছে, সেখানকার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত অনেকেই জামায়াতে ইসলামী বা জামাতের সঙ্গে জড়িত। এখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, ওই তথাকথিত গণঅভ্যুত্থানের পেছনে ছিল হাফিজ সঈদের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ জামাত-উদ-দাওয়া।
হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসতেই দলের আওয়ামী লীগকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করেছে। এমনকি হাসিনার বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থেকে শুরু করে অপহরণের অভিযোগও আনা হয়েছে। এবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার প্রধান মুখ শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি বাতিল করে কার্যত এশিয়া মহাদেশের একটি সংগ্রামের ইতিহাসকেই কলঙ্কিত করা হল।