আমেরিকা জুড়ে তুমুল বিক্ষোভ। আইনজীবী থেকে শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী থেকে চাকরি হারানো সরকারি কর্মী, শিশু থেকে বৃদ্ধ এবং পড়ুয়া থেকে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই এই বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। শনিবার আমেরিকার রাজপথ দেখল হাজার হাজার মানুষের সমবেত প্রতিবাদ। বিক্ষোভ থেকে উঠল স্লোগান, ‘নো কিংস।‘ অর্থাৎ আমেরিকায় কোনও রাজা নেই। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশকে একনায়কতন্ত্রের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগে সরব নাগরিকদের একাংশ। ট্রাম্পের কঠোর নীতি, মিডিয়া ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং অভিবাসীদের উপর দমনপীড়নের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়। রাজধানী ওয়াশিংটন তো বটেই, নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, বস্টন, লস অ্যাঞ্জেলেস, প্রতিটি বড় শহরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সাধারণ মানুষ।
ট্রাম্প বিরোধীদের মত, তাঁর আচার আচরণ কোনও গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মতো নয়। বরং, রাজার মতো। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি মোটেই ‘রাজা নন’। এই মন্তব্য করার কয়েক ঘণ্টা পরেই নিজের ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি এআই দিয়ে তৈরি বেশ কিছু ভিডিও পোস্ট করেন। একটি পোস্টে তাঁকে মুকুট পরে যুদ্ধবিমান চালাতে দেখা যাচ্ছে। সেই যুদ্ধবিমান থেকে তিনি ট্রাম্প-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের উপর বিষ্ঠা ফেলছেন।
Advertisement
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে এই নিয়ে তৃতীয় গণ-বিক্ষোভ হল ট্রাম্প সরকারের বিরুদ্ধে। গত জুনে ট্রাম্পের জন্মদিনে ‘নো কিংস’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘সংবিধান বাঁচাও’ স্লোগান উঠেছিল আমেরিকার মাটিতে। ২,১০০টি জায়গায় দেখা গিয়েছিল ‘নো কিংস’ বিক্ষোভ। শনিবার মার্কিন মুলুক দেখল তারই পুনরাবৃত্তি।
Advertisement
উদ্যোক্তাদের দাবি, সবমিলিয়ে ৭০ লক্ষের বেশি মানুষ জমায়েত করেছিলেন আমেরিকার রাস্তায়। শুধু নিউ ইয়র্কেই ছিলেন লক্ষাধিক প্রতিবাদী। ‘নো কিংস’ কর্মসূচির ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, ‘প্রেসিডেন্ট ভাবেন তাঁর রাজত্বই সর্বশ্রেষ্ঠ। মনে রাখতে হবে, আমেরিকায় কোনও রাজা নেই। আর আমরা কোনও বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি এবং নিষ্ঠুরতা সহ্য করব না।’ আমেরিকায় মোট ২৭০০টি বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটিই অপ্রত্যাশিত ভাবে সফল হয়েছে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। ট্রাম্প-বিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ।
৭০ বছরের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক পেগি কোলের কথায়, ‘আমার মনে হচ্ছে, ট্রাম্প আমাদের সরকার, গণতন্ত্রটাকে দখল করে নিচ্ছেন, ধীরে ধীরে এবং নিশ্চিত ভাবে তা ভেঙে ফেলছেন। আমরা প্রতিবাদ না-করলে এটা আটকানো যাবে না।’ আর এক প্রতিবাদী মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘এটাকেই গণতন্ত্র বলে। ঘৃণা নেই, ভয় নেই এখানে। অভিবাসীদেরও স্বাগত।’ আটলান্টা প্রদেশের বিক্ষোভে অনেক ডেমোক্র্যাটিক নেতাও শামিল হয়েছিলেন। প্রতিবাদীদের বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আমেরিকা গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রে মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারে, নিজেদের কথা নিজেরা বলতে পারে। আমাদের চুপ করানো যাবে না।’
রিপাবলিকানরা স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রতিবাদকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন। তাঁরা এটাকে ‘হেট আমেরিকা র্যালি’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদীদের ট্রোল করছে ট্রাম্পের দলবল। তাতে কোনও ভাবেই দমতে রাজি নয় প্রতিবাদীরা। শিকাগোর গ্র্যান্ট পার্কে এক জনসভায় ৮০ বছরের মেরিলিন রিকেন বলছেন, ‘পরিবর্তন এভাবেই আসে।‘ তাঁর চোখের সামনেই তখন আমেরিকান সংবিধানের এক রেপ্লিকায় সই করছেন প্রতিবাদীরা। সকলেই চাইছেন প্রতিবাদ।
দ্বিতীয় বার আমেরিকার কুর্সিতে বসেই সরকারের একাধিক নীতিতে বদল এনেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নীতি হয়েছে কড়া। এইচ-১বি ভিসার উপর মোটা অঙ্কের মূল্য চাপানো হয়েছে। প্রেসিডেন্টের শুল্কনীতির কারণে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। ট্রাম্পের আমলে বিশ্বের দরবারে আমেরিকার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের একাংশের। আমেরিকানদের প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে দাবি করেন ট্রাম্প। তাঁর দাবি, অভিবাসীদের দেশ থেকে সরানো, এইচ-১বি ভিসা নীতি, সব কিছুর নেপথ্যেই আমেরিকানদের স্বার্থ লুকিয়ে।
আমেরিকার একটা বড় অংশের মানুষ যে ট্রাম্পের নীতি পছন্দ করছেন না, শনিবারের ছবি থেকে তা কার্যত স্পষ্ট। গত ১৭ দিন ধরে আমেরিকায় ‘শাটডাউন’ চলছে। অর্থের অভাবে প্রশাসনের জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব প্রায় বন্ধ। চালু রয়েছে আপৎকালীন পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত দপ্তর। অনেক সরকারি কর্মীকে বেতন ছাড়া কাজ করতে হচ্ছে। শিক্ষা এবং গবেষণার খাতে বরাদ্দ কমায় অনেক গুণী মানুষ অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। ভারতীয় নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও সস্ত্রীক আমেরিকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে খবর। এই ঘটনাগুলি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
Advertisement



