গাজায় শান্তি ফেরাতে ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গাজা শান্তিচুক্তির প্রথম দফায় ইজরায়েল এবং হামাস একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। প্রায় দু’বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কি তাহলে এবার ইতি পড়বে? এই প্রশ্নটি এখন স্বাভাবিক ভাবেই উঠতে শুরু করেছে।
বুধবার ট্রাম্প তাঁর সামাজিক মাধ্যম ট্রুথে লিখেছেন, ‘আজ আমেরিকা, আরব দুনিয়া, ইজরায়েল এবং আশপাশের দেশগুলির জন্য দারুণ দিন। গাজা শান্তিচুক্তির প্রথম দফায় একমত হয়েছে ইজরায়েল এবং হামাস। এর অর্থ প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ইজরায়েলি পণবন্দিদের মুক্তি দেবে। পরিবর্তে ইজরায়েল গাজার কিছু অংশ থেকে তাদের সেনা তুলে নেবে।’
Advertisement
শর্তগুলি মেনে নিয়ে দু’পক্ষকে রাজি করানোর জন্য ট্রাম্প ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিন মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, মিশর এবং তুরস্ককে। তিনি নিজের সমাজ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আরব এবং মুসলিম দেশগুলির কাছে এটি একটি গর্বের দিন। ইজরায়েল-হামাসের সংঘাত থামাতে আমি কাতার, মিশর এবং তুরস্ককের মতো মধ্যস্থতাকারী দেশগুলিকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
Advertisement
অন্য দিকে, আমেরিকার একটি সংবাদমাধ্যমকে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ইজরায়েলে যেতে পারেন। ইজরায়েলের আইনসভা নেসেটে বক্তৃতাও করতে পারেন। ইজরায়েলের সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট-এর খবর অনুসারে, রবিবারই ইজরায়েলে যেতে পারেন ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার খবর ছড়িয়ে পড়তেই দেখা গিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বছর পঁয়তাল্লিশ রান্ডা সামেহ বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে দু’বছর ধরে চলা এই দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটতে চলেছে। প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা সর্বস্ব হারিয়েছি।‘ গাজার বাসিন্দা সামের জুদেহ বলেন, ‘সত্যি বলতে খবরটা শোনার পর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আনন্দের কান্না চলে আসছে। দুই বছর ধরে বোমাবর্ষণ, আতঙ্ক, ধ্বংস, অপমান আর প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুভয়ের মধ্যে বেঁচে ছিলাম।‘
আরও এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ‘আমাদের এবার বিশ্রামের প্রয়োজন। এই যুদ্ধে আমার ভাই এবং পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হয়েছে। ঠিক করে তাদের কবরও দেওয়া হয়নি। এবার সেই কাজগুলি আমি সম্পন্ন করব।‘ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এই চুক্তির প্রথম ধাপ আজই (বৃহস্পতিবার) মিশরের রাজধানী কায়রোতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সর্বশেষ (৭ অক্টোবর ২০২৫) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই বছরে ২০ হাজার ১৭৯ শিশু নিহত, ১২ লক্ষাধিক মানুষ খাদ্যাভাবের শিকার এবং ৫৮ হাজার ৫৫৪ শিশু অনাথ হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে , গাজার পরিকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, এবং পুনর্গঠন শুরু করতেও বিশাল মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
গাজা শান্তিচুক্তিকে ইতিমধ্যেই স্বাগত জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। অন্যদিকে, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও তাঁর প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। জানিয়েছেন, এটি ইজ়রায়েলের জন্য একটা বড় দিন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক্স হ্যান্ডলে একটি পোস্ট শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এটি শুধু শান্তির দিকেই নয়, বরং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রতিফলনও বটে।‘ তিনি আরও লেখেন, ‘বন্দিদের মুক্তি এবং গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা বাড়ানো তাদের কিছুটা স্বস্তি এনে দেবে এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ প্রশস্ত করবে বলে আমরা আশা করি।‘
এর আগে চলতি বছর জাতিসংঘে গাজা সংঘাত নিয়ে আনা প্রস্তাবে তিন-চতুর্থাংশ সদস্য রাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি ও মানবিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে ভোট দিলেও ভারত ভোটদানে বিরত থাকে। ভারতের যুক্তি ছিল, ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি কেবল প্রত্যক্ষ আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব।‘ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই চুক্তিকে ‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক কূটনৈতিক সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে চুক্তির শর্তাবলি সম্পূর্ণরূপে মানার আহ্বান জানাচ্ছি। সব বন্দিকে মর্যাদাপূর্ণভাবে মুক্তি দিতে হবে। স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। লড়াই একবারে বন্ধ করতে হবে। গাজায় মানবিক ও বাণিজ্যিক সহায়তা অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এই দুর্ভোগের অবসান ঘটাতেই হবে।‘ গুতেরেস আরও যোগ করেন যে জাতিসংঘ এই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে, মানবিক ত্রাণ ও পুনর্গঠন কার্যক্রম জোরদার করবে, এবং গাজার জনগণের জন্য বুনিয়াদি সহায়তা অব্যাহত রাখবে।
যদিও চুক্তির ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবুও অনেক বিশ্লেষক সতর্ক করছেন যে এর বাস্তব প্রয়োগই আসল চ্যালেঞ্জ। হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যকার গভীর অবিশ্বাস, পশ্চিম তীরের রাজনৈতিক জটিলতা এবং ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিভাজন—সব মিলিয়ে এই ‘শান্তি’ কতটা স্থায়ী হবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে দুই বছরব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞে বিপর্যস্ত গাজার সাধারণ মানুষের কাছে, এই ঘোষণা একটুকরো আশার আলো।
তবে এই শান্তি চুক্তির আবহেই বৃহস্পতিবার গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা ঘোষণার পরেও বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে। গাজা সিটিতে ‘তীব্র বিমান হামলার’ দাবি করে সংস্থাটির কর্মকর্তা মহম্মদ আল-মুঘাইর বলেন, ‘গত রাতে গাজায় প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির রূপরেখা নিয়ে চুক্তির ঘোষণার পর থেকে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে উত্তর গাজার এলাকায়।’
Advertisement



