• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

কাজিরাঙা হয়ে তাওয়াং

উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে প্রকৃতি বড় যত্ন করে সাজিয়েছে। পথে যেতে যেতে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করবেন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

রেখা মজুমদার

হাতে সময় মাত্র ১১ দিন। এই ক’টা দিনে গোটা অরুণাচল ঘুরে দেখা অকল্পনীয়। তাই বেছে নিয়েছিলাম কাজিরাঙা অভয়ারণ্য হয়ে অরুণাচল প্রদেশের অন্যতম সুন্দর জায়গা তাওয়াং।

Advertisement

যাত্রা শুরু হল অসমের গুয়াহাটি রেলস্টেশন থেকে। গন্তব্য কাজিরাঙা অভয়ারণ্য। দু’শো কিলোমিটার রাস্তা। গুয়াহাটি শহর ছাড়িয়ে গাড়ি চললো কাজিরাঙার দিকে। পথের দু’পাশে শান্ত, স্নিগ্ধ, শ্যামলিমায় ভরা গ্রামীণ অসম। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্য। পৌঁছতে লেগে গেলো প্রায় ঘন্টা চারেক। আপাতত কাজিরাঙাতেই রাত্রিবাস। কাজিরাঙ্গা পার্ক পরিদর্শনের সবচেয়ে ভালো সময় হল অক্টোবর মাসের শেষ থেকে শুরু করে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত। প্রতি বছর বর্ষাকালে, শক্তিশালী ব্রহ্মপুত্রের জল অসমের বেশিরভাগ অংশ প্লাবিত করে, কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান প্লাবিত হয়, ঠিক অসমের অন্যান্য বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জাতীয় উদ্যানের মতো। তাই, স্বাভাবিকভাবেই, বর্ষাকাল অসমের কোনও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বা জাতীয় উদ্যান পরিদর্শনের জন্য উপযুক্ত সময় নয়। তবে, কাজিরাঙা ভ্রমণের জন্য বুকিং পার্ক খোলার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের আশেপাশের হোটেলগুলি সীমিত হওয়ায়, আগে থেকে বুকিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কাজিরাঙায় একটা চমৎকার হোমস্টেতে ছিলাম। হোমস্টেগুলিতে অতিথিদের আতিথেয়তার সঙ্গে তাদের স্থানীয় অভিজ্ঞতার এক টুকরো দিয়ে অভিজ্ঞতা আরও বাড়ানো হয় এবং অতিথিরা অভিজ্ঞতাটি পছন্দ করে।

Advertisement

পরদিন ভোরের গন্তব্য কাজিরাঙা অভয়ারণ্য। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার। এটি ভারতের অন্যতম বিখ্যাত জাতীয় উদ্যান এবং এটি তার এক-শৃঙ্গযুক্ত গণ্ডারের জন্য পরিচিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি অভয়ারণ্যও। কাজিরাঙা জাতীয় অরণ্য আসলে অসমের গোলাঘাট এবং নগাঁও জেলা জুড়ে বিস্তৃত। নানা ধরনের বন্যপ্রাণী থাকায় প্রকৃতি প্রেমীর মানুষজনের প্রায় স্বপ্নের গন্তব্য হল এই অরণ্য। এই অরণ্যটি একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং সত্যি কথা বললে ভারতের আদিম প্রাকৃতিক স্থানগুলির মধ্যে একটি হল এটি। মানুষের উপস্থিতি বা অধিগ্রহণ দ্বারা বিঘ্নিত না হয়েই অসমের কাজিরাঙা একটি অনন্যসাধারণ অরণ্য হয়ে রয়ে গিয়েছে।

কাজিরাঙা পর্ব শেষ করে এরপরের গন্তব্য সোজা গাড়ি নিয়ে ভালুকপং। চোখে পড়ল ব্রহ্মপুত্র নদের বিস্তীর্ণ চর। ভালুকপংয়ে জিয়াভরলি নদীর চরও ভরে আছে ছোটবড় নুড়ি পাথরে। ভালুকপং অসম ও অরুণাচলের সীমান্ত। এখানেই সেনাবাহিনীর কাছে ছাড়পত্র দেখিয়ে অরুণাচলে ঢুকতে হয়। ভালুকপংয়ের পর যাত্রা শুরু বোমডিলার উদ্দেশে। পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা। এই পথেই টিপি অর্কিড রিসার্চ সেন্টার। বিভিন্ন ধরনের গাছ ও অর্কিড থাকার জন্য নানা ধরনের পাখি ও প্রজাপ্রতি চোখে পড়বে। অসমের সীমা পেরোতেই জিয়াভরলির নাম বদলে হল কামেং। টিপির অরণ্য দেখে আবার পথ চলা। যেতে যেতেই চোখে পড়ল পিকচার পোস্টকার্ডের মতো টেঙ্গা ও রূপা ভ্যালি। বোমডিলা পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। হোটেলে না ঢুকে চলে গেলাম কনে-দেখা আলোয় বোমডিলা মনাস্ট্রির মায়াবী রূপ দেখতে।

বোমডিলা থেকে ভোরে বেরিয়ে পড়তে হল ১০ হাজার ফুট উপরে তাওয়াংয়ের উদ্দেশে। পথে পড়ল সে লা। তিব্বতি ভাষায় ‘লা’ মানে হ্রদ। বৌদ্ধদের কাছে এই হ্রদ বড় পবিত্র। বিরাট এই হ্রদের প্রকৃতি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল অনেকক্ষণ। সে লা-র পর রাস্তা বেশ খারাপ। বাড়তে লাগল ঠান্ডা, পথ ঢেকে গেল কুয়াশায়। নভেম্বর মাস থেকেই এই অঞ্চলে বরফ পড়তে শুরু করে। মার্চ মাসেও নাকি এখানে বরফ পাওয়া যায় । পাহাড় ঢেকে আছে লাল-হলুদ সবুজ রঙের গুল্ম আর ব্লু-পপি ফুলে।

এই লম্বা জার্নিতে মাঝে-মাঝে বিরতি নিতেই হয় আর্মি ক্যাম্পগুলিতে। পর্যটকদের জন্য এখানে আছে ওয়াশরুম, ক্যান্টিন এবং প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার দোকান। সে লা-র পর থামা হল যশবন্ত গড়ে। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধে, ভারতীয় সেনা যশবন্ত সিংহ রাওয়ত একা তিন দিন ধরে চিনা সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে শহিদ হয়েছিলেন। তাঁরই স্মরণে এই গড়। তিনটে দিন তাওয়াংয়ের জন্য বরাদ্দ। দীর্ঘ যাত্রার পরে, প্রথম দিন প্রাতরাশে গরম মোমো-স্যুপ খেয়ে যাওয়া হল স্থানীয় বাজারে। মার্কেটে স্থানীয় কিছু জিনিস কেনাকাটার পর দেখতে গেলাম ‘তাওয়াং ওয়ার মেমোরিয়াল’। ইন্দো-চিন যুদ্ধে শহিদ ভারতীয় সৈনিকদের স্মরণে এই মেমোরিয়াল।

১৬৮০-৮১ সালে তৈরি হয়েছিল ভারতের সবচেয়ে বড় এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মঠ তাওয়াং মনাস্ট্রি। বর্তমান দলাই লামা তিব্বত থেকে ভারতে আসার সময় এই মনাস্ট্রিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। লাইব্রেরি, ক্যান্টিন, স্কুল, হস্টেল, অতিথিশালা নিয়ে যেন ছোটখাটো একটা গ্রাম এই মনাস্ট্রি। এই মঠটির কাছেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীদের মঠ। দেখা হল, ষষ্ঠ দলাই লামার জন্মস্থানও। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাওয়াং শহরটির মতোই সুন্দর এখানকার মানুষের ব্যবহারও। রেস্তরাঁয় খাবারের মানও বেশ ভাল। ভারতীয় সেনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যাওয়া হল ভারত-চিন সীমান্ত ‘বুম লা’। উচ্চতা ১৬ হাজার ৫০০ ফুট। বুম লা থেকে ফেরার পথে থামা হল সাংগিটসার লেকে। শাহরুখ খান ও মাধুরী দীক্ষিতের ‘কোয়েলা’ ছবির একটি গানের দৃশ্য এখানে শ্যুট হওয়ার পরই লোকমুখে এর নাম হয়ে যায় ‘মাধুরী লেক’।

তাওয়াং থেকে এবার ফেরার পথে থাকা হল ছোট্ট ছিমছাম শহর দিরাংয়ে। যেখানে আসার পথে দেখলাম জঙ্গ ফলস। এ যেন নায়াগ্রা ফলসের মিনিয়েচার! দিরাংয়ের শিপ ব্রিডিং ফার্ম ও অ্যাপেল অর্চার্ডের শান্ত পরিবেশ মনোরম। দিরাংয়ের কাছেই ছবিটি মত সুন্দর সংগটি ভ্যালি। দিরাংয়ের পর সেসা। সেসার পরই গুয়াহাটি হয়ে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। তাওয়াং ও দিরাং পাখি আর প্রজাপতি-প্রেমীদের জন্য আদর্শ জায়গা।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে প্রকৃতি বড় যত্ন করে সাজিয়েছে। পথে যেতে যেতে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করবেন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। এখানকার অন্যতম সুন্দর জায়গা তাওয়াং। মাইলের পর মাইল সবুজ পাহাড়, ঝকঝকে নীল আকাশ, অগুনতি পাহাড়ি ঝরনা, প্রাকৃতিক হ্রদ, নানা রঙের ফুল, পাখি, প্রজাপতি… না, কোনও সিনেমার দৃশ্য নয়। উত্তর পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ। ভালুকপং থেকে তাওয়াং, বিশ্বাস করতেই হল, পথে একটা ম্যাগনেটিক পাওয়ার আছে। আপনার মন আবারও আসতে চাইবে!

Advertisement