• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

দলাই লামা, তাওয়াং, ভেরিয়ার এলউইন

নিয়ম অনুযায়ী অধিষ্ঠিত দলাই লামা একমাত্র নতুন দলাই লামা নির্বাচন করার অধিকারী এবং তাঁর এই কাজে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

Photos by Tenzin Choejor

১৪তম দলাই লামা, তেনজিন গিয়াতসো, নিশ্চিত করেছেন যে আমৃত্যু তিনি দলাই লামা পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। নিয়ম অনুযায়ী অধিষ্ঠিত দলাই লামা একমাত্র নতুন দলাই লামা নির্বাচন করার অধিকারী এবং তাঁর এই কাজে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তবে সেই সমাধা করার জন্য তিনি এক ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছেন।

প্রত্যেক দলাই লামাকে বলা হয়  ‘জীবন্ত বুদ্ধ’। বর্তমান দলাই লামা তিব্বত ত্যাগ করে ১৯৭৯ সালে ভারতে আসেন। তার আগে সেখানে সংঘটিত হয় চিনা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিদ্রোহ। বর্তমান দলাই লামা তিব্বতে অবস্থান করলে কোনও সমস্যা ছিল না। যেহেতু তিনি তিব্বতের বাইরে ভারতে অবস্থান করছেন তাই তাঁকে পরবর্তী দলাই লামা নির্ধারিত করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে তাঁকে চিনের বাইরে বসবাস করছেন এমন কাউকে দলাই লামা নিয়োগ করতে হবে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন লেখায় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ‘মুক্ত বিশ্ব’  থেকে পরবর্তি দলাই লামা নির্বাচিত হবে। চিন সেটা মানতে রাজি নয়। চিনের বক্তব্য চিনা কমিউনিস্ট পার্টির পছন্দ কেউ (তিব্বত থেকে) দলাই লামা হবেন। কিন্তু দুঃ। দলাই লামা কি একসঙ্গে থাকতে পারেন?

Advertisement

এই বছর দলাই লামার বয়স ৯০ বছর হল। জন্মদিনে সারা বিশ্ব থেকে সন্ন্যাসি এবং ভক্তরা জমায়েত হয়েছিলেন। আশা ছিল তিনি সেই দিন পরবর্তি দলাই লামার নাম ঘোষণা করবেন। কিন্তু বর্তমান দলাই লামা অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী। তিনি বুঝতে পারছেন তিনি নিজের পছন্দমত চিনের বাইরে থেকে দলাই লামা ঘোষণা করলে চিন প্রশাসনের দিক থেকে কী প্রতিক্রিয়া হবে। চিন অধিকৃত তিব্বতী সমাজ এবং চিনা সরকারের মধ্যে এক নির্মম উত্তরাধিকারের লড়াই শুরু হবে। চিনা সরকার জানিয়ে দিয়েছে তারা দলাই লামার সিদ্ধান্ত মানবে না। তারা নিজেদের পছন্দমত কাউকে চিন অধিকৃত তিব্বতী সমাজ থেকে বেছে নেবেন। এদিকে মার্কিন সরকার দলাই লামার পিছনে আছেন। বর্তমান চরম অনিশ্চয়তার কারণে তিনি এমনও নাকি ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পরে আর কোনও দলাই লামা ‘জীবন্ত বুদ্ধ’। হিসেবে আবির্ভূত হবেন না।

Advertisement

এখন ভাবতে হবে যদি দলাই লামা চিনের বাইরে থেকে পরবর্তি দলাই লামা নির্বাচন করেন তবে কোথা থেকে? একমাত্র জায়গা হল তাওয়াং সহ বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ। ম্যাকমোহন লাইন অনুযায়ি ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে বর্তমান অরুণাচল প্রদেশের অবস্থান থাকলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকারের কোনও প্রশাসনিক অধিকার ছিল না। ১৯১৫-২০ সাল থেকে ব্রিটিশ এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে প্রশাসনিক অধিকার স্থাপন করতে চেষ্টা করে। আর এই সময়েই বিভিন্ন স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণে খুব বেশি একটা কাজ হয়নি।
এখানে আসি ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক ভেরিয়ার এলউইনের কথায়। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বস্তার অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে গবেষণাধর্মী কাজ করেন। তিনি মুরিয়া, মারিয়া, আগারিয়া, বাইগা ইত্যাদি অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি এবং জীবনধারা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন।
বস্তারের পর কিছুদিন তিনি ওড়িশাতেও আদিবাসী উন্নয়নে কাজ করেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভেরিয়ার ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরু উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চলের আদিবাসীগত সমস্যার নিরসনের জন্য ভেরিয়ারকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এজেন্সি বা নেফার নৃতাত্ত্বিক পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ করেন। এই অঞ্চলের সঙ্গে তিব্বতের সীমারেখা অস্বচ্ছ ছিল। কারণ হিমালয় পর্বত, ভয়ঙ্কর ব্রহ্মপুত্র নদী, দুর্গম বনাঞ্চলের ফলে তিব্বত বা ভারত কোনও রাষ্ট্রেরই প্রশাসন এখানে ছিল না বললেই চলে। ঐতিহাসিক দিক থেকে এই অঞ্চলের বরং তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং সামান্য প্রশাসনিক সম্পর্ক ছিল।

নেহরু সঠিক ভাবেই এই অঞ্চলের উপর ভারত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক অধিকারের ব্যাপারে সচেষ্ট হন। নাহলে অরুণাচলের উপর চিনের দাবির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করা ভারতের পক্ষে বর্তমানে সম্ভব হত না।

নিজের পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতা এই অঞ্চলে কাজে লাগাতে ভেরিয়ারের অসুবিধা হয়নি। বরং তিনি উৎসাহ নিয়ে অঞ্চলের প্রশাসনিক কার্যপদ্ধতির উন্নতির জন্য নেহরুর কাছে ‘ইন্ডিয়ান ফ্রন্টিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ (আইএফএসএ) প্রবর্তনের সুপারিশ করেন এবং নেহরু তা মেনে নেন। ১৯৫৬ সালে শুরু হওয়া এই সার্ভিসে প্রথম ১৪ জন অফিসারের সবাই ছিলেন প্রাক্তন সেনা কর্মী। এদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত কে সি জোহোরি, ইউসুফ আলি, ইউ চাকমা, বব কাটিং এবং মেজর এস এম কৃষ্ণাত্রি।

এই বব কাটিং মাত্র ২০০ জন সেনা নিয়ে ১৯৫১ সালে তাওয়াং-এর উপর ভারত রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব নিশ্চিত করেন। মেজর রালেনগাও ‘বব’ কাটিং ছিলেন মণিপুর থেকে আগত এক দূরদর্শিতাসম্পন্ন নাগা অফিসার। তাঁকে এই অভিযানের নির্দেশ দেন আসামের গভর্নর জয়রামদাস দৌলতরাম। ভেরিয়ার নেফা-তে যোগ দেবার আগেই তাওয়াং ভারতের দখলে এলেও ২৩টি প্রধান উপজাতি এবং ১০০টি উপ–উপজাতি অধ্যুষিত তাওয়াং সহ সমস্ত নেফা অঞ্চলে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে ভেরিয়ার এলউইনের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।

এই অঞ্চলে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন উপজাতির সংস্কৃতি সংকলিত করে ভেরিয়ার ১৯৫৭ সালে প্রকাশ করেন তাঁর গ্রন্থ ‘এ ফিলসফি ফর নেফা’। এতে এক সৎ দায়িত্ববান মানুষ হিসাবে এই অঞ্চলের উপজাতি মানুষের বিষয়ে তাঁর গভীর উপলব্ধি লিপিবদ্ধ আছে, যা এখনও অরুণাচলের প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে এক নীতিনির্দেশিকা হিসাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

সবশেষে জানাই, ষষ্ঠ দলাই লামা সানগিয়ান গিয়াতসো ১৬৮৩ সালে তাওয়াং অঞ্চলে মন তাওয়াং-এ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬৯৭ সালে দলাই লামা পদে অভিষিক্ত হন। ১৪তম দলাই লামা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন কোনও সমস্যা হবে না। আর যদি তিনি অরুণাচল প্রদেশ থেকে পরবর্তি দলাই লামা নির্বাচন করার কথা ভাবেন তাহলে ভেরিয়ার এলউইন এবং বব কাটিং-এর অবদানের কথা ভুলে গেলে চলবে না। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা এখন দেখার।

Advertisement