চাপের মুখে থেকেও ভারতীয় ক্রিকেটাররা কীভাবে লড়াইয়ের মধ্যে আসতে পারেন, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন শনিবার তৃতীয় দিনে। একটা সময় ভাবা হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়া যেভাবে বড় রানের অঙ্কে ভারতীয় দলের সামনে প্রথম ইনিংসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল, তা দেখে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন রোহিত শর্মারা আবার হারের মুখে পড়তে পারেন। কিন্তু সেই জায়গা থেকে উঠে এসে ভারতীয় দল যেভাবে দাপট দেখাতে পেরেছেন, তাতে প্রমাণ হয়েছে, খুব সহজেই কেউই ভয় দেখাতে পারবে না। খেলার দ্বিতীয় দিনের শেষে ভারতীয় দলের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু তৃতীয় দিনে সাহসী ভূমিকা নিয়ে শেষের দিকের ব্যাটসম্যানরা অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের দাপট স্তব্ধ করে দিয়ে ভারতের স্কোরবোর্ডকে ভালো জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। দিনের শেষে ভারতীয় দল ৯ উইকেটে ৩৫৮ রানে পৌঁছে গেছে। হাতে একটা উইকেট থাকলেও ভারতীয় দল এখনও পর্যন্ত ১১৬ রানে পিছিয়ে রয়েছে।
তবে আশার কথা, ব্যাট করছেন নীতিশ কুমার রেড্ডি। তিনি ১০৫ রানে অপরাজিত রয়েছেন। আর অন্য প্রান্তে খেলছেন মহম্মদ সিরাজ মাত্র ২ রানে। সেই কারণেই ভারতীয় দলের ভরসা বলতেই এখন নীতিশ কুমার। এই নীতিশ একটা সময় বাদের তালিকায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুভমন গিলের পরিবর্তে বিশাখাপত্তনমের এই ক্রিকেটার জায়গা পেয়ে আট নম্বরে খেলতে নেমে ভারতীয় দলের নাটকীয় মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, চতুর্থ দিনে ভারতীয় দল আর কত রান করতে পারে। তবে সেই অর্থে হাতে বেশি উইকেট নেই। নির্ভর করতে হবে নীতিশ কুমারের উপরেই। যদি মহম্মদ সিরাজ নীতিশকে ঠিকমতো সহযোগিতা করতে পারেন, তাহলে ভারতের স্কোরবোর্ড বদলে যেতে পারে। ভারতীয় দলের সাহসিকতাকে অবশ্যই তারিফ করতে হবে। দ্বিতীয় দিনের শেষে যে বিরাট অঙ্কের রানে পিছিয়ে ছিল ভারতীয় দল, সেই জায়গা থেকে একটা ভালো ফর্মে নিয়ে আসতে পেরেছেন ব্যাটসম্যানরা।
রবীন্দ্র জাদেজা এবং ঋষভ পন্থ উইকেটে ছিলেন। তৃতীয় দিনের শুরুতেই ঋষভ পন্থের উইকেটটা হারাতে হয়। স্কট বোল্যান্ডের বলে ঋষভ নাথান লিওনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন। তাঁর ব্যাট থেকেএসেছে ২৮ রান। খেলেছেন ৩৭টি বল। মেরেছেন তিনটি বাউন্ডারি। রবীন্দ্র জাদেজা ১৭ রান করে আউট হয়ে যান নাথানের বলে এলবিডব্লু হয়ে। নীতিশ রেড্ডি খেলতে এসে প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের প্রথমে পরখ করে নেন। তারপরেই নীতিশ নিজের ছন্দে খেলতে থাকেন। তাঁকে সাপোর্ট দিতে থাকেন ওয়াশিংটন সুন্দর। দু’জনের বোঝাপড়া ছিল দারুণ। নীতিশ ধীরে ধীরে শতরানের দিকে পা বাড়াতে থাকেন। ওয়াশিংটন সুন্দর পাশে থেকে নীতিশকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিতে থাকেন। ওয়াশিংটন সুন্দর অর্ধ শতরান করে প্যাভিলিয়নে ফেরত যান। তিনি ১৬২টি বল খেলেছেন। আর তাঁর ব্যাট থেকে মাত্র একটি বাউন্ডারি এসেছে। এই খেলা দেখেই স্পষ্টই বোঝা যায়, নীতিশকে কীভাবে তিনি সহযোগিতা করেছেন। এটাই হল একজন দক্ষ খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় চরিত্র সতীর্থ খেলোয়াড়কে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে। নীতিশ কুমার রেড্ডি ১০৫ রানে এখনও নট আউট রয়েছেন। তিনি ১৭৬টি বল খেলেছেন। তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ১০টি বাউন্ডারি ও একটি ছক্কা। তিনি যে একজন দক্ষ ক্রিকেটার, তাঁর খেলার মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মহম্মদ সিরাজ তাঁর সঙ্গী হয়ে রয়েছেন উইকেটে।
অস্ট্রেলিয়া দলের বোলারদের মধ্যে অবশ্যই অধিনায়ক প্যাট কামিন্স ও স্কট বোল্যান্ড সবার নজর কেড়েছেন। কামিন্স তিনটি উইকেট যেমন দখল করেছেন, তেমনই স্কট বোল্যান্ডও তিনটি উইকেট পেয়েছেন। তবে নাথান লিওন দুটো উইকেট দখল করেছেন। রবিবার যদি অস্ট্রেলিয়া দলের বোলাররা খুব তাড়াতাড়ি ভারতের এই দুই ব্যাটসম্যানের মধ্যে কাউকে আউট করে দেন, তাহলে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে একটা নির্দিষ্ট রানের লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়ে হয়তো দান ছেড়ে দিতে পারে। তার জন্য অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে রোহিত ব্রিগেডকে। এখন দেখার বিষয়, রবি ও সোমবার খেলার চরিত্র কীভাবে প্রকাশ পায় তার উপরেই নির্ভর করছে কোন দল জয়ের বার্তা দিতে পারে।
নীতিশ রেড্ডি যখন ব্যাট করতে নামেন তখনও ভারতীয় দলের ২০০-র গণ্ডি পার হয়নি। এই অবস্থায় ভারতীয় দলের অন্যতম ভরসা ঋষভ পন্থ একটা আক্রমণাত্মক শট নিতে গিয়ে আউট হয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরে যান। তাহলে কি তিন টেস্ট খেলায় নীতিশ কুমারের উপরেই ভারতের ভাগ্য নির্ভর করছিল? হয়তো সেই সময় হায়দরাবাদের এই ক্রিকেটার নিজেও জানতেন না, দিনের শেষে তিনি শতরান করে নটআউট থাকবেন। আসলে নতুন টেস্ট খেলোয়াড়দের কাছে সবসময় একটা চাপ থাকে। তিনি যখন ব্যাট হাতে নিয়ে দিনের শেষে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটছিলেন, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই কিছু কথা বলছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, এখনও ব্যাট নিয়ে মাঠে নামার জন্য তৈরি রয়েছেন। তাঁর নামের পাশে রয়েছে অপরাজিত ১০৫ রান। মেলবোর্নের উইকেটে তাঁর ক্রিকেট জীবনে প্রথম শতরান করার কৃতিত্ব দেখালেন। তাই বীর নায়ককে অভ্যর্থনা জানাতে ভারতীয় দলের খেলোয়াড়রা সাজঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি যখন ড্রেসিং রুমে ফিরছিলেন। ড্রেসিং রুম থেকে সবাই এগিয়ে এসে নীতিশকে অভ্যর্থনা জানালেন, যা তাঁর কাছে বিরাট প্রাপ্তি। নীতিশের সঙ্গী ওয়াশিংটন সুন্দর সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। এটা অনেকটা সিনেমার কোনও দৃশ্যের মতো। প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। এই অভিজ্ঞতা নীতিশকে আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিল। নীতিশের সঙ্গে ওয়াশিংটন সুন্দর যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ভারতীয় দলের স্কোরবোর্ডকে অনেকটাই বদলে দিলেন, এটা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। দলের জন্য শেষের দিকের ক্রিকেটাররা রানকরতে পারেন, তা প্রমাণ হয়ে গেল।