চলচ্চিত্র জগতের নেপথ্য কারিগর প্রমথেশ বডুয়া

Written by SNS April 28, 2024 2:38 pm

রাজু পারাল

বাংলা চলচ্চিত্রের আদি পর্বের সঙ্গে যে ক’জনের নাম জড়িয়ে রয়েছে প্রমথেশ বড়ুয়া তাঁদের অন্যতম৷ কর্মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, নিরলস পরিশ্রম দ্বারা নিজের জীবনকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় প্রমথেশ বড়ুয়া তার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত৷ যে কাজই তিনি করেছেন, সফল হয়েছেন চূড়ান্তরূপে৷ অল্প বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক৷ বাবা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া ছিলেন প্রগতিশীল সংস্কৃতিবান মানুষ৷ পরবর্তীকালে তাঁর অর্থানুকূল্যেই প্রমথেশ চলচিত্রের দুনিয়ায় জায়গা করে নেন৷ প্রভাতচন্দ্র ছেলেমেয়েদের যে আধুনিক শিক্ষা ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তা সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের পরিচয় মেলে৷ প্রমথেশের মা সরোজবালা ছিলেন ধর্মপরায়ণ বৈষ্ণবীয় এক সাধারণ নারী৷ সারাজীবন মায়ের স্নেহ প্রমথেশের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে৷

প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন অসমের গৌরীপুর রাজপরিবারের সন্তান৷ জন্ম ১৯০৩ সালের ২৪ অক্টোবর৷ পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে প্রমথেশ ছিলেন সবার চাইতে বড়৷ রাজপরিবারের আভিজাত্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তাঁকে মানুষ করা হয়৷ বাল্যকাল থেকেই তিনি বহুগুণের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন৷ বিলিয়ার্ড, টেনিস, ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল৷ শিকার করা ও সঙ্গীত চর্চাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন৷

জীবনের প্রারম্ভে রাজবাড়ির ঐতিহ্য অনুসারে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শুরু করলেও পরে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন৷ ১৯২০ সালে এখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে৷ ১৯২৪-এ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই বিএসসি পাশ করেন৷ সে সময়টায় কলকাতায় পড়তে আসা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রমথেশের জীবনে৷ কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে থাকা প্রমথেশের জীবনের মোড় ঘোরে এখান থেকেই৷

প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীনই নিয়মিত নাটক দেখতে শুরু করেন প্রমথেশ৷ ক্রমশ তা নেশায় পরিণত হয়৷ কলকাতায় তখন নাটক-অভিনয়ের রমরমা৷ প্রখ্যাত সব অভিনেতাদের উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত রঙ্গমঞ্চগুলি৷ সে সময়ে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুডির অভিনয় তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে ‘ষোড়শী’ নাটকটি তিনি এগারোবার দেখেছিলেন৷ ছুটিতে জন্মস্থান গৌরীপুরে গেলে বন্ধুবান্ধদের নিয়ে মেতে উঠতেন নাটক অভিনয়ের আয়োজনে৷ নিজে অভিনয়ের পাশাপাশি রঙ্গমঞ্চ সাজানো, রিহার্সাল করানো, কাহিনির নাট্যরূপ দেওয়া, নাটকে গানের ব্যবহার, পোশাক পরিচ্ছদ নির্বাচন— সব কিছু খুঁটিনাটির তত্ত্বাবধান করতেন স্বয়ং নিজেই৷ বলাবাহুল্য, গৌরীপুরের মতো একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলকে কলকাতার আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছিলেন রাজকুমার প্রমথেশ বড়ুয়া৷ পরবর্তী জীবনে বাংলা চলচ্চিত্র যে এক অসমীয়া যুবকের প্রতিভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার প্রস্ত্ততিপর্ব যেন শুরু হয়েছিল নাটক পরিচালনা ও অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই৷ নিজের পরিচালনায় ও অভিনয়ে মঞ্চস্থ করেছিলেন ‘খাসদখল’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘ষোড়শী’, ‘ফেলারামের স্বাদেশিকতা’, ‘ফুলসর’, ‘কিন্নরী’ প্রভৃতি নাটকগুলি৷

১৯২৫ সালে মা সরোজবালার মৃতু্য হলে প্রমথেশ বড়ই একলা হয়ে পড়েন৷ কারণ মা ছিলেন তাঁর জীবনের পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়৷ মায়ের মৃতু্যশোক ভুলতে পরের বছর প্রমথেশ বিলেতভ্রমণে বেরোলেন৷ সেখান থেকেই ‘অসম ব্যবস্থা পরিষদে’র সদস্য নির্বাচিত হন৷ পরে দেশবন্ধু প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ পার্টির অসম শাখাতেও যোগ দেন প্রমথেশ৷ ভারতীয় রাজনীতির কিছুটা ছাপ তাঁর মনে প্রভাব ফেললেও দেশে ফিরলে প্রমথেশের হাতে স্টেটের দায়িত্ব তুলে দেন তাঁর বাবা৷ প্রজাশাসন ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় হাতে পেলেও তা থেকে অব্যাহতি পেতে চাইছিলেন প্রমথেশ৷ একসময়ে গৌরীপুর স্টেটের দায়িত্ব, স্ত্রী, ভাই-বোন, বাবা সকলকে ছেড়ে কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন প্রমথেশ৷ ঘোরাফেরা করতে থাকেন কলকাতার অভিজাত মহলে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হওয়ায় বাড়তি একটা পরিচিতি ছিলই৷ কলকাতায় এসে প্রমথেশ নিজেকে চলচ্চিত্রের জগতে যুক্ত করতে চাইছিলেন৷ ১৯৩১ সালে নিজের প্রচেষ্টাতে গড়ে তুললেন ‘বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট’৷ ঠিকানা, ১৪ নম্বর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড৷ পরিচালক দেবকী কুমার বসু ও ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণগোপালকে সঙ্গে নিয়ে বড়ুয়া ইউনিটের প্রথম নির্বাক ছবি ‘অপরাধী’ তৈরি হল৷ এই ছবিতে প্রমথেশ নিজেই অভিনয় করেছিলেন৷ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩১-এর ২৮ নভেম্বর৷

তবে এর আগে প্রমথেশ ‘ব্রিটিশ ডোমিনিয়ান ফিল্মস লিমিটেডে’র পরিচালনায় নির্বাক ছবি ‘পঞ্চশর’ (১৯৩০) ও ‘টাকায় কী না হয়’ (১৯৩১) ছবি দুটিতে অভিনয় করেন৷ ১৯৩৪ সালে প্রমথেশ বড়ুয়ার প্রথম সবাক ছবি ‘রূপলেখা’ মুক্তি পেলেও তা সাফল্যের মুখ দেখেনি৷ ১৯৩৫ সালে মুক্তি পায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে ‘দেবদাস’৷ প্রমথেশ পরিচালিত ও অভিনীত এই ছবিটি কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গিয়েছিল৷ পরবর্তীকালে হিন্দি, বাংলা এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় ছবিটি হলেও জনপ্রিয়তায় প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’কে কেউই ছাড়িয়ে যেতে পারেনি৷ ‘দেবদাস’ চরিত্রটির সৃষ্টিকর্তা শরৎচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল না তাঁর কাঁচা বয়সের লেখা ‘দেবদাস’ নিয়ে ছবি তৈরি হোক৷ তাঁর কাছে ছবি তৈরির অনুমতি চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘তোরা কি আমার অন্য ভালো লেখা পেলি না? যত সব মুখু্যর দল জুটেছে৷ ’

‘দেবদাস’ মুক্তি পাবার পর দর্শকরা অভিভূত হয়ে দেখেছিলেন প্রমথেশের স্বাভাবিক আত্মমগ্ন অভিনয়৷ বুকে আগুন নিয়ে যে মানুষটি নারী ও মদে আচ্ছন্ন হয়ে পরিবার-সমাজ এমনকী নিজের কাছেও অধঃপতিত হয়ে পড়েছেন, বেশ্যা বাড়ি যাবার কথা স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করেছেন৷ সমাজের চোখে একেবারে নীচে নেমে গেলেও নিজের অন্যায় কাজের জন্য নিজেকে ক্ষমা করেননি— নিজেকে শেষ করে দিয়ে পাপ ও অন্যায় থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন৷ ‘দেবদাস’ ছবিটির অভাবনীয় সাফল্যে প্রমথেশ ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর আত্মবিশ্বাস৷ যা তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত মানসিকতায় খুবই প্রয়োজন ছিল৷ ছবিটি তাঁকে বাংলা ছবির পরিচালক ও অভিনেতার খ্যাতির শীর্ষে পেঁৗছে দিয়েছিল৷

প্রমথেশ বড়ুয়া চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রায় ২০-২১ বছর৷ ওই সময়ের মধ্যে তিনি বহু ছবি পরিচালনা ও অভিনয় করেছেন৷ তাঁর অভিনীত ও পরিচালিত ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘বেঙ্গল ১৯৮৩’ (১৯৩২), ‘রূপলেখা’ (১৯৩৪), ‘দেবদাস’ (১৯৩৫), ‘গৃহদাহ’ (১৯৩৬), ‘মায়া’ (১৯৩৭), ‘শাপমুক্তি’ (১৯৪০), ‘মায়ের প্রাণ’ (১৯৪১), ‘উত্তরায়ণ’ (১৯৪১), ‘শেষ উত্তর’ (১৯৪২), ‘চাঁদের কলঙ্ক’ (১৯৪৪), ‘মায়াকানন’ (১৯৫৩), ‘অগ্রগামী’ প্রভৃতি৷

চিদানন্দ দাশগুপ্ত প্রমথেশ বড়ুয়ার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘যে যুগে ভারতীয় চলচ্চিত্র ইংরেজের তৈরি কারাগারে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল, সে যুগে প্রমথেশ বিদেশযাত্রা করে ইউরোপের নানা পরিচালকের সংস্পর্শে এসে আধুনিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাংলা ছবির যোগসূত্র স্থাপন করেন৷ এই যোগসূত্র আজকের তুলনায় ক্ষীণ হলেও সে যুগে তার মূল্য ছিল অপরিসীম৷’

১৯৫১ সালের ২৯ নভেম্বর বিষণ্ণ বিকেলে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে জীবনের যবনিকা পতন ঘটে চলচ্চিত্র জগতের কারিগর প্রমথেশ বড়ুয়ার৷ বর্তমানকাল তাঁর খবর না রাখলেও প্রমথেশ বড়ুয়া কিন্ত্ত একেবারে হারিয়ে যাননি৷