• facebook
  • twitter
Friday, 13 December, 2024

সিমলাগড় কালী মন্দির আজও ভক্তদের টানে

সেবাইত দেবব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, সিমলাগড় কালীবাড়ি প্রতিদিন সকাল ছ’টা থেকে দুপুর একটা এবং বিকেল চারটে থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে।

চিত্র: সমাজমাধ্যম।

সুব্রত সামন্ত

কয়েক দশক আগের কথা। জি.টি. রোড দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল রাস্তার ধারে এক কালী মন্দিরের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন দীর্ঘদেহী এক পুরুষ। ইতস্তত তাকিয়ে দেখার পর প্রবেশ করলেন মন্দিরের ভিতর। ঘুরে দেখলেন কালী মন্দির। দীর্ঘদেহী ব্যক্তি আর কেউ নন, সত্যজিৎ রায়। কথাগুলো বলছিলেন একজন ভক্ত।

চলার পথে নজরে আসে নানা মন্দির, দেউল, পুরাকীর্তি। সেসবের ইতিহাস জানার কৌতুহল নিয়ে খোঁজখবর আর ক’জন করেন?
সেরকমই পথ চলতে চলতে হঠাৎ নজরে আসে পাণ্ডুয়ায় জি.টি. রোডের পাশে এক কালীবাড়ি। রাস্তার ধার ঘেঁষে রয়েছে বহু প্রাচীন এক কালীমন্দির। যদিও বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার প্রাচীনত্ব। সিমলাগড় কালীবাড়ি। রাস্তার একদিকে কালীমন্দির, অপরদিকে সারি দেওয়া পুজোর সামগ্রীর দোকান। সকাল বিকেল ভিড় লেগে আছে মন্দিরে। অনেকে আবার একে শ্মশানকালী বা ডাকাত কালীও বলে থাকেন।

সিমলাগড় কালী মন্দির হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ার সিমলাগড় গ্রামে অবস্থিত। এই মন্দিরের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে সেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ শেরশাহের সৃষ্টি করা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড।

প্রায় ৮০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই মন্দির এক সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি শ্মশানে অবস্থিত ছিল। সিমলাগড় নামটা তখনও আসেনি, জায়গাটার নাম ছিল হরিহরপুর। তালপাতার এক কুটির আর তার মধ্যে স্থাপিত মৃন্ময়ী কালীমূর্তি। হুগলি জেলার এক অখ্যাত কালীমন্দির। তালপাতার কুটিরে কালীমূর্তি, আর কুটিরের পাশে একটা পুকুর। পাশেই ছিল শ্মশান। এক কাপালিক তন্ত্র সাধনা করতেন পঞ্চমুণ্ডির আসনে। শ্মশান ছিল বলে অনেকেই একে শ্মশানকালী বলতেন। কালক্রমে জায়গার নাম পরিবর্তন হয়ে হল সিমলাগড়, আর তালপাতার কুটির বদলে হল পাকা মন্দির। মাটির মূর্তি বদলে গেল কষ্টি পাথরের মূর্তিতে।

জঙ্গলে ঘেরা শ্মশানের মধ্যে কালীবাড়ি বা শ্মশান কালী বলদে গেল শেরশাহের আমলে। শেরশাহ বাংলা থেকে নিজের মাতৃভূমি আফগানিস্তান পর্যন্ত তৈরি করলেন বাদশাহি সড়ক পরে যা জি.টি. রোড নামে পরিচিত লাভ করে। কালের সঙ্গে শ্মশানও দূরে সরে গিয়েছে। চারদিকে গড়ে উঠেছে বসতি।

হুগলি জেলা একসময় ছিল ডাকাতির জন্য কুখ্যাত। গঙ্গার কাছে বলে এখান থেকে নৌকা করে ডাকাতি করার সুবিধা হতো। ‘হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গ সমাজ’ বইতে সুধীরকুমার মিত্র লিখেছেন বলাগড়ের ডাকাতের কথা। বলাগড় ছিল খাস ডাকাতের গ্রাম। সেখানে নাকি প্রায় সবার পেশা ছিল ডাকাতি। ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে সেখানে বিশ্বনাথ রায় নামে এক ব্যক্তি ডাকাতির জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তাকে ধরার জন্য ইংরেজরা নানারকম ফাঁদ পেতেছিল, কিন্তু তার বুদ্ধি ও কৌশলে বারবার সে রয়ে যায় অধরা। বাংলার ইতিহাসে সে ‘বিশে ডাকাত’ নামে পরিচিত। নৌকার সাহায্যে ডাকাতির স্রষ্টা বিশে ডাকাত ছিল বড়লোক আর জমিদারের ত্রাস। আগে থেকে খবর দিয়ে বা চিঠি পাঠিয়ে ডাকাতি করত বিশে ডাকাত। আর পুলিশে খবর দিলে ডাকাতির সঙ্গে প্রাণ পর্যন্ত সে কেড়ে নিত। দেখতে নাকি বেশ সুপুরুষ ছিল এই ডাকাত। ফলে ডাকাত হিসাবে তাকে ভাবা বেশ কষ্টকর ছিল।

১৮১৮ সালে ডাকাতি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে বিশে ডাকাত। হুগলি জেলায় ফাঁসি হয় তার। বিশে ডাকাতেরও যোগাযোগ ছিল সিমলাগড় কালীবাড়িতে। যে কোনও বড় ডাকাতি করার আগে বিশে সহ এলাকার বহু ডাকাত সিমলাগড় মন্দিরে পূজো দিয়ে রওনা হতো ডাকাতিতে। তাতে নাকি কার্যসিদ্ধ হতো।
সেই সময়ে মা কালীর সামনে নরবলি দেওয়া হতো। ডাকাতদলের পুজো করার জন্য সিমলাগড় কালীবাড়ি ডাকাত কালী নামেও পরিচিত হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে সৈন্য চলাচল বাড়তে শুরু করল ওই এলাকায়। মানুষও ভয় কাটিয়ে মায়ের পুজো দিতে শুরু করে, ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল ভক্তের সংখ্যা। পরে মন্দির সংস্কার করে আরও বড় মন্দির তৈরি হল। সিমলাগড় কালীবাড়িতে পুজো শুরু হয় লক্ষণ ভট্টাচার্যের আদি পুরুষের সময় থেকে। ওই পরিবারের এক তান্ত্রিক একবার তন্ত্রসাধনা করতে এসে নরমুণ্ড দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তারপর থেকে নরবলির বদলে ছাগ বলি শুরু হয়। দক্ষিণাকালী রূপে পূজিতা মাকে কালীপুজোয় মাছ সহ ১০৮ রকমের ভোগ দেওয়া হয়।

সেবাইত দেবব্রত মুখোপাধ্যায় জানান, সিমলাগড় কালীবাড়ি প্রতিদিন সকাল ছ’টা থেকে দুপুর একটা এবং বিকেল চারটে থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে।
দীপান্বিতা অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয়। এছাড়াও শনি মঙ্গলবার ও অমাবস্যা তিথিতে মন্দিরে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এবং সারা পৌষ মাস ধরে মন্দিরে অনেক ভক্তই পুজো দিয়ে যান।

পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিষ্ঠিত কষ্টিপাথরের দক্ষিণাকালী মূর্তি প্রতিবছর কালীপুজোর আগে রং করা হয়। নরবলির চিহ্ন একন না থাকলেও নাট মন্দিরের কাছে রাখা হাড়িকাঠ তার প্রমাণ দেয়। নিত্য পুজো ছাড়াও এখানে বিয়ে, উপনয়ন, নতুন গাড়ির পুজো এমনকি মন্দিরের মধ্যে গাছে কাপড় বা ঢিল বেঁধে মানত করা হয়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, মন্দিরের গাছে কাপড় বেঁধে বা মাটির মূর্তি বেঁধে মানত করলে মাকালী সে মানত পূর্ণ করেন। মনোষ্কামনা পূর্ণ হলে, পরে এসে পুজো দিয়ে কাপড় বা ঢিল খুলে ফেলাই রীতি। প্রতিদিনই নিত্য পুজোর সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় আচার আচরণও সম্পন্ন হয়ে থাকে। এখানে মাকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করতে আসেন অনেকে। আবার অনেক নবদম্পতি আসেন বিয়ের পর মায়ের পুজো দিয়ে আশীর্বাদ পেতে।

নানা অলৌকিক কাহিনির সাক্ষী এখানকার সেবাইত, পুরোহিতেরা। তাঁদেরই মুখে শোনা গেল বেশ কয়েকটি আশ্চর্য ঘটনা। একদিন নিত্য পুজোর আগে অভাব দেখা গেল জবাফুলের। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না পুজোর জন্য পর্যাপ্ত জবাফুল। সেবাইতরা চিন্তিত হলেন। সেই সময়ই এক ব্যক্তি এক ঝুড়ি জবা ফুল এনে হাজির হলেন মন্দিরে। কোথা থেকে আনলেন, কেন আনলেন, তার হদিস পাওয়া গেল না।

পুজোর সময় বাহান্ন রকম ভোগে মাকে পুজো দেওয়া হয়। একবার পুজোর সময় ভোগের আয়োজন করতে গিয়ে দেখা গেল বাদ পড়েছে এঁচড়ের পদটি। কারণ বাজারে সে সময় এঁচড় অমিল। তবে কি বাদ পড়ে যাবে বাহান্ন ভোগের এক ভোগ? কোথা থেকে এক ভদ্রলোক ঘাড়ে করে এঁচড় এনে হাজির। জানালেন, তাঁর বাড়ির গাছের এঁচড় এনেছেন দেবীর ভোগের জন্য। এঁচড় যে দরকার সেটাও তিনি জানতেন না। এরকমই নানা ঘটনা বিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছে দেবীর মাহাত্ম বিষয়ে।
কলকাতা থেকে বর্ধমান যাওয়ার সড়ক পথে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি দর্শন করে গিয়েছেন এই কালী মন্দির। চলার পথে রাস্তার পাশেই কালীবাড়ি দেখে অনেকেই পুজো দিয়ে যান, যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার কামনায়।

দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মানুষ। যেমন সিমলাগড় গ্রাম এখন আর আগের মতো নেই। চারদিকে বসতি, দোকানপাট, বড় রাস্তা আলাদা গুরুত্ব দিয়েছে। জিটি রোডের পাশের এই মন্দিরে সহজেই যাওয়া যায় সড়ক পথে। রেলপথে সিমলাগড় স্টেশনে নেমে হেঁটে মিনিট দশেক। আছে টোটো, অটোও।