• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বিদায় বেলায়

আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে সুমিতা। সত্যি কি ও পাগল হয়ে গেছে, যে, সোনার গয়না নিয়ে এখন ভাবতে বসেছে! এটা কি তার গয়না নিয়ে ভাবার সময়!

কাল্পনিক চিত্র

সুরশ্রী ঘোষ সাহা

বাড়ির পাশের মাঠেই দুর্গামন্ডপে পুজো চলছে। আজ দশমী। ওদের পাড়ার পুজো এবার ত্রিশ বছরে পড়ল। সুমিতা ছোট থেকেই পাড়ার এই পুজোর সকল খুঁটিনাটি আনন্দ নিয়ে বড় হয়েছে। পঞ্চমী থেকে দশমী শুধু পূজামণ্ডপেই কাটিয়ে দিয়েছে। সেভাবে কখনো অন্য পাড়ায় ঘুরে বেরিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরুনো হয়নি। হয়নি বলা ভুল। বাবার কড়া শাসনে বড় হয়ে সেই সুযোগ ওর জীবনে আসেনি। অথচ পাড়ার বন্ধুরা দল বেঁধে ঘুরতে যেত দু’বেলাই। দিনে সাইকেল চালিয়ে দূরের পাড়াগুলোর ঠাকুর দেখে আসত। আর রাতে কাছের পাড়াগুলোয় দেখত। সুমিতাকে ওরা আর নতুন করে ডাকাডাকি করত না। সুমিতা একা নয়, বন্ধুরাও ভয় পেত সুমিতার বাবাকে। তবুও বিয়ের পর এক-দুদিনের জন্য হলেও সুমি পুজোর সময় বাপের বাড়ি চলে আসতে পছন্দ করে। সুমির বাবা-মায়েরও খুব ভালো লাগে তখন। একমাত্র মেয়ে বিয়ের পর থেকে সেই যে শ্বশুরঘর করতে চলে গেছে, সারাবছর একেবারেই আসতে পারে না তেমন। তাদেরও ওই পুজোর কটা দিনের অপেক্ষাতেই তো থাকা।

Advertisement

পাড়ার বন্ধু শর্মিতা সুমির বাড়ির জানলার দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় সুমিকে ডাকে। পূজা প্রাঙ্গণে যাওয়ার কথা বলে। যদিও সুমিও ইশারায় তাকে যাবে না বুঝিয়ে দেয়। শর্মি মুখখানা ঘুরিয়ে ঠাকুর বরণের জন্য নিজের লাইন আসার অপেক্ষা করে।

Advertisement

ওদের পাড়াটা বিরাট বড়, পুজোও একটাই মাত্র হয়। তাই অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি থেকে শুরু করে দশমীর বিদায় বেলায় ঠাকুর বরণ সবেতেই লাইন পড়ে বিশাল। সুমিতা জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে সকল মহিলাদের হাতের দিকে। সেখানে ছোট থালায় সিঁদুর, এক টাকার কয়েন, মিষ্টি, পান পাতা, সুপারি, দূর্বা মিলেমিশে ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে। এভাবে মানুষ কেন মিলেমিশে থাকতে পারে না, কে জানে! গত কয়েক বছর সেও ওই লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুর বরণের শেষে বাড়ি ফিরেছে এক মুখ সিঁদুর মেখে। কারণ, ঠাকুর বরণের পর বহুক্ষণ ধরে এয়োস্ত্রীদের সিঁদুর খেলা চলে। আজকাল আবার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াও শুরু হয়েছে। পাড়ার বাচ্চা থেকে বুড়ো ছেলেগুলোকেও ধরে ধরে সিঁদুর মাখিয়ে ভূত বানিয়ে দেয় সবাই। কেউ কেউ তো ঘর থেকে লুকিয়ে সিদ্ধিও বানিয়ে নিয়ে আসে। ঠাকুর বিদায়ের দুঃখ ভুলতে নানা ছলনা আর কী!

হঠাৎ কলিংবেলটা বাজছে বলে মনে হয় সুমির। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দ্যাখে, একেবারে গায়ে লাগানো বাড়ির ছোটবেলার বান্ধবী বিপাশা দাঁড়িয়ে আছে।
‘কী রে, কানে শুনতে পাস না, নাকি! কখন থেকে বেল বাজিয়ে যাচ্ছি’ মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠে বিপু।
‘অত ঢাক, উলু, আর শাঁখ বাজানোর শব্দ তো, তাই শুনতে পাইনি…’
‘গেলি না কেন মন্ডপে? চল, বাইরে চল, তোকে সিঁদুর মাখিয়ে লাল করতে এসেছি!’
‘না, না! দিস না, প্লিজ। শরীর খারাপ হয়েছে। তাই তো গেলাম না পূজামণ্ডপে। বুঝিস না! নইলে ঘরে বসে থাকব কেন? তুই বরং ঘরে আয়। তোর তো সিঁদুর খেলা হয়ে গেছে দেখছি। প্রথম বিজয়ার মিষ্টিমুখ তোকে দিয়েই শুরু করি।’
‘না রে, বাবু। মিষ্টি খেতে পরে আসবখন। ঠাকুর বিজয়া হয়েছে কোই, যে মিষ্টি খাব! তুই ঠাকুর বরণ না করিস, ঠাকুরের সঙ্গে বিসর্জন দেখতে নদী পর্যন্ত তো যেতে পারবি। মলি, সুদীপা, বিপাশা, রণিতা আমরা সবাই যাচ্ছি। তুইও চল। এতে তো কোন বাধা নেই রে, বাবা! কাকু নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো অত নিষেধাজ্ঞা জারি করে না’, বলে বিপাশা হাসতে শুরু করে।
‘এবছরটা থাক। ইচ্ছে করছে না। তোরা যা। ঘুরে আয়। ভালো করে ছবি তুলিস, কেমন।’
‘ধুর! কীরকম যেন হয়ে উঠছিস দিন দিন।’ ব’লে ঠিক যেমন ধুপধাপ করে এসেছিল, তেমনই ধুপধাপ করে বিপাশা বেরিয়ে যায়।

সুমি আবার গিয়ে জানলার ধারের টুলটায় বসে। ঠাকুরকে নামানো হয়ে গেছে বেদি থেকে। পাড়ার ছেলেরা বাঁশের উপর দেবীকে তুলে লরিতে ওঠানোর কসরত করছে। তাদের মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে ‘বলো দুগ্গা মাঈকি’ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। এই সময় বড্ড বেশি মনখারাপ হয়। মনে হয় যেন, দেবী মায়ের মুখখানাও করুণ হয়ে উঠেছে। ঠোঁট ভর্তি সন্দেশ, কপালে আর গালে লেপটানো সিঁদুর। সকল হাত থেকে অস্ত্র খুলে নেওয়া ওই চেহারা যেন বড় বেমানান। এই কটা দিন কত গয়না দিয়ে সাজিয়ে মাকে পূজার মাধ্যমে কত সম্মান দেওয়া হল। আবার এখন তাকেই আভরণহীন নিরস্ত্র করে দিয়ে এই জগত সংসার ছেড়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে। ঠিক এমনভাবেই তো সুমিকে তার বর সঞ্জীব সেদিন বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিল।

দেবী মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সুমি। শ্বশুরবাড়ি থেকে গয়নাগুলো ফেরত পাবে তো সে? কত কষ্ট করে বাবা সেসব গড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। বিয়ের পর ওবাড়িতে ঢুকে রাত পার হতেই শাশুড়ি-মা বলেছিল, ‘গয়নাগাটি সব আমার আলমারিতেই থাক, বৌমা। যখন পরবে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পরো। এসব বহু মূল্যবান সোনা। শাড়ি তো নয়। যে যখন তখন লাগবে। তোমরা যখন তখন বাড়ি থেকে বেরুবে। একশোবার আলমারি খুলবে। আমার আলমারি ছ’মাসে-ন’মাসে একবার খোলা হয়। আমার কাছেই সেসব যত্নে থাক।’

নতুন বৌ নতুন বাড়িতে কোনও কথাই বলতে পারে না যে প্রতিবাদ করবে। সুমিও পারেনি। ঘাড় হেলিয়ে সব গয়না তুলে দিয়েছিল শাশুড়ির হাতে। হালে কালে একটা দুটো বিয়েবাড়িতে চেয়ে পরেছে। তারপর ছেড়ে দিয়েছে। নিজের গয়না হলেও চেয়ে পরতে কার ভালো লাগে!

আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছে সুমিতা। সত্যি কি ও পাগল হয়ে গেছে, যে, সোনার গয়না নিয়ে এখন ভাবতে বসেছে! এটা কি তার গয়না নিয়ে ভাবার সময়! ওর যে জীবনের সবচেয়ে বড় গয়নাটাই খোলা বাজারে হারিয়ে গেছে। যার জন্য বিয়ে, শ্বশুরবাড়ি, বিবাহিত জীবন, সেই বরটাই তো আর নিজের নেই! কিছু মাস আগেই জানতে পেরেছে ওর বর সঞ্জীবের অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তারপর থেকে তো ঝগড়া, মান-অভিমান, না-খাওয়া, ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা, এমন কত কিছু করে দিন কেটেছে। শেষে সুমি জেদ ধরেছিল, আর যাই হোক ওই বাড়ি ছেড়ে ও কিছুতেই বেরুবে না। মধু খেতে এসে মাছি যেভাবে মধুতেই ডুবে মরে, সুমির এখন সেই অবস্থা। তারও যে ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল’। ওই সংসারটুকু ছাড়া আর কোথাও কিছুই নেই! বিবাহিত মেয়ের বাপের বাড়িতে এসে পড়ে থাকা কি মানায়! এই জন্যই কি সুমির বাবা ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন! আবার অনেকের মতো সুমি যে পারে না, পরপরুষের সঙ্গ লাভ করার ইচ্ছা পোষণ করতে, পরনারীর সংসার ভাঙতে। অনেকের চেয়ে আজো সে নিজেকে আলাদা করে রাখতে চায়। চার দেয়ালের মধ্যেকার সুখেই তৃপ্তি খুঁজে পায়। কিন্তু যার সঙ্গে সে বিবাহ বন্ধনে জড়িয়ে ছিল, সে-ই যে বদলে গেল রাতারাতি!

হয়তো এই পুজোতে সুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসত না। আসার মতন সেই মানসিক অবস্থাও ছিল না। কিন্তু প্রতি বছরের মতো এ বছরও মায়ের ফোন যায় সুমির শাশুড়ির কাছে। পুজোর ক’টাদিন মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠানোর কথা বলেন। সুমি আসে, কিন্তু তার বাবা-মাকে কিছু টের পেতে দেয় না। মা তো মা-ই হয়। নিশ্চয়ই কিছু আন্দাজ করেছেন। তাই বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছেন, ‘সঞ্জীব একবারও এল না কেন, রে? কিছু হয়েছে নাকি! আগে তো কখনো এমনটা করেনি ছেলেটা! ফোন-টোন করে তো তোকে? গোটা পুজোটাই বেরুলি না, পাড়ার মন্ডপেও গেলি না। মনমরা হয়ে পড়ে রইলি ঘরে। এমন কেন করছিস! বছরে একবার তো আসিস, এমন করে থাকবি জানলে কি ডাকতাম!’

মায়ের প্রশ্নের কোন উত্তরই দিতে পারে না সে। নিরস্ত্র-নিরাভরণ সুমি মনে মনে ঠাকুরকেই ডেকে চলে দিনরাত। বাপের বাড়ি আসাটা যেন তার চিরকালের জন্য না হয়ে যায়, ঠাকুর। মা-বাবা আর সমাজের মুখ চেয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা যেন কোনভাবে টিঁকে যায়! আজকাল একটাই চিন্তা দিনরাত মাথায় ভর করছে, যে, সঞ্জীব সেই মহিলার জন্য তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে না তো? মিথ্যা অজুহাতে এবছরটা না হয় ঠাকুর বরণ করেনি। যদি ডিভোর্সি ছাপ পড়ে যায় জীবনে, আর কি পারবে ঠাকুর বরণ করতে? ছোট থেকেই তো দেখে এসেছে, ঠাকুরের পূজার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু নিয়ম একমাত্র সধবা-স্ত্রীদের জন্যই বাঁধা। আইবুড়ো মেয়ে বা বিধবা মহিলাদের এই রিচুয়ালটা পালন করতে যেমন দেখা যায় না তেমনি আইনত আলাদা হওয়া সধবারা কি তা করতে পারে! ডিভোর্সিরা তখন কোন দলে পড়ে? কোন গোত্র তাদের? বিয়ের আগের বাবার বাড়িরটা, নাকি বিয়ের পরের শ্বশুরবাড়িরটা! মনে নানা প্রশ্ন এসে ভিড় করে সুমিতার। খুব ভয় হয়, কারণ, আর কিছুই নয়, সঞ্জীবের যে মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক, শুনেছে সেই বিবাহিত মহিলা তার বরকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে। এখন সঞ্জীবের বা সেই মহিলার জীবনের একজন পথের কাঁটা আর নেই, সম্পূর্ণ সরে গেছে। কেঁপে ওঠে সুমি। সেও যে এখন তাদের কাছে কাঁটার স্বরূপ।

মন্ডপ ছেড়ে বেরিয়ে ঠাকুর লরিতে চেপে এগোতে থাকে একটু একটু করে। মুখটা ঝাপসা দেখায় সন্ধ্যার কমে যাওয়া আলোয়। এই ক’টাদিন কত আলো ছিল ওই মুখের উপর, আর এখন…
বসার টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সুমি। দু’হাত কপালের কাছে তুলে বিসর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া দেবী প্রতিমার কাছে প্রার্থনা জানায়— আর কিছু চাই না, শুধু আমার শ্বশুরবাড়ির প্রতিমা বিসর্জনটা আটকে দিও, মা।

Advertisement