দেবেশ মজুমদার
কলিংবেল বাজতেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে দরজা খুলল পিয়ালি। দরজা খুলে দেখল বুকান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। “কীরে কেমন রেজাল্ট হল?” সুজাতার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা বাড়িতে ঢুকে সোফায় বসল বুকান। রিপোর্ট কার্ডটা এগিয়ে দিল মাকে। চোখ বুলিয়েই আঁতকে উঠল পিয়ালি। “এ কী রেজাল্ট করেছিস রে? তোর বাবা তো ভয়ানক রেগে যাবে!”
আর ঠিক সেই মুহূর্তে সৌমেনের ফোন এল। রেজাল্টের কথা শুনেই আগুন। বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিল পিয়ালিকে। ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল পিয়ালি। একদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে। বুকান উদাসীন। সোফা থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগোল।
“কোথায় যাচ্ছিস, শোন, আমার কিছু প্রশ্ন আছে, সত্যি কথা বলবি। কিচ্ছু লুকোবি না”।
“দাঁড়াও মা, খুব ক্ষিদে পেয়েছে। আমি চেঞ্জ করে আসছি”।
সৌমেনের কথাগুলো তখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল পিয়ালির কানে। এমনিতেই বুকানের ব্যাপারে পান থেক চুন খসলেই, বাড়ি মাথায় তুলে নেয় সৌমেন তার ওপর এই রেজাল্ট! সৌমেন রেগে ফায়ার হয়ে আছে। যা মুখে এল বলে গেল। পিয়ালি বরাবর যা করে এক্ষেত্রেও তাই করল। চুপচাপ সব শুনে গেল, উত্তর দিল না। পিয়ালি বুকানের ব্যাপারে কোনও ত্রুটি তো রাখে না। তবুও জবাবদিহি ওকেই করতে হয়। আজ বুকানের এই রেজাল্ট কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল।
একমাত্র সন্তান। তেরো বছর বয়স। ক্লাসে স্ট্যান্ড না করলেও বুকান পড়াশোনায় বেশ ভালো। এক থেকে দশের মধ্যে থাকে। কিছু কিছু বিষয়ে তো সর্বোচ্চ নম্বরও পায়। প্রাইভেট টিউটর থাকলেও পিয়ালি আর সৌমেন দুজনেই ওকে পড়ায়। তবে পিয়ালির ওপর দায়িত্বটা একটু বেশি। ছেলেকে নিয়েই পিয়ালির জীবনযাপন। সৌমেন তো সাতসকালে বেড়িয়ে রাত করে ফেরে। দুর্গাপুরে অফিস। উইকএন্ড ছাড়া সেইভাবে ছেলের দিকে নজর দেওয়া সম্ভবও হয় না। পিয়ালি ছেলেকে কতটা সময় দিচ্ছে সৌমেনের নজর থাকে তার ওপর। অফিসের ইয়ারলি অডিটের মতো পিয়ালিরও দৈনিক অডিট করে সৌমেন। গরমিল পেলেই শো-কজ।
বুকানের খাবার নিয়ে রেডিই ছিল পিয়ালি। বুকান এসে বসতেই ওর সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। গরম ভাত, আলুপোস্ত আর মাছের ঝোল বেশ যত্ন করেই পরিবেশন করল ছেলেকে। বুকান তখনও বেশ নির্বিকার। কোথাও এতটুকু লজ্জা, ভয় বা আপরাধবোধের ছিঁটেফোঁটা নেই। একে তো নম্বরের এই ছিরি তার উপর এইরকম গাছাড়া ভাব? মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছিল পিয়ালির। খাওয়া শেষ করে বুকান ওর নিজের রুমে চলে গেল। থালাবাসন গুলো টেবিল থেকে তুলে রান্না ঘরের সিঙ্কের তলায় রেখে এল পিয়ালি। বুকানের রুমে গিয়ে ওর পাশে বসল। গায়ে আলতো হাত রেখে বলল, “এরকম কেন হল বুকান? নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলি? আমাকে বল না রে! তোর বাবাকে আমি সামলে নেবো।”
“তোমাকে ভাবতে হবে না মা। এ ব্যাপারে যা বলার আমি বাবাকেই বলব। তখন শুনে নিও।”
“সেটা আমাকে বলা যাবে না?”
“না। যা বলার বাবার সামনেই বলব।”
“ঠিক আছে বাবা এলেই না হয় সব বলিস। কিন্তু আমার বিষয়গুলোতে এরকম মার্কস এলকী করে? সেটা তো আমাকে বল! তুই তো বেশ ভালোই তৈরি ছিলিস। তাহলে?”, বুকানের হাত দুটো ধরে প্রশ্ন করল পিয়ালি। তা সত্ত্বেও বুকান কিছু বলল না। শুধু চোখের কোনে জল চিকচিক করছে মনে হল।
“চুপ করে থাকিস না। বল কী হয়েছে?”
“তোমার বিষয় মানে? আমি বুঝতে পারলাম না মা।”
“কেন সোশ্যাল সায়েন্স আর ইংলিশ যে বিষয়গুলো আমিই তো তোকে দেখিয়ে দিই।”
বুকান হাত দুটো সরিয়ে নিল। কোনও উত্তর দিল না। পিয়ালি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ছেলের ঠিক কী হয়েছে, কেন এমন করছে। পড়াশোনা নিয়ে কি বুকানের মনে ভীতি তৈরি হয়েছে! যদি তাই হয় তাহলে তো ইমিডিয়েট কাউন্সেলিং দরকার। আর প্রথম কাউন্সেলিং ঘর থেকেই হওয়া উচিত। খুব ভাল হয় যদি সৌমেন এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে। সৌমেনের কথা মনে হতেই পিয়ালির ভেতরটা কেঁপে উঠল। প্রমাদ গোনা শুরু করে দিল পিয়ালি। সৌমেন এসেই না শুরু করে দেয়! ছেলের উপর তো চড়াও হবেই আর তার সাথে পিয়ালিকে অনেক কথা শুনতে হবে। এসব ভেবে পিয়ালির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল ওর।
বুকান এমনিতে খুব ভালো ছেলে। একটু কম কথা বলে। ওর বয়সী অন্য ছেলেদের মতো ছোটাছুটি দাপাদাপি করে না। বেশ শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনা করে আর অবসর সময়ে হয় ছবি আঁকে না হয় গল্পের বই পড়ে। তবে সায়েন্স ফিকশন পড়তে বুকানের খুব ভালো লাগে। বাবাকে দিয়ে তাই অনলাইনে অর্ডার করে প্রচুর বই কেনে। অপ্রয়োজনীয় কথা নেই মুখে, অন্যায় আবদার নেই, নেই কোনও বাজে কৌতূহল কিন্তু লক্ষ্য করে সব, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীব্র। বুদ্ধিও রাখে গভীর। পিয়ালির দুশ্চিন্তা ঠিক এই জন্যই।
পিয়ালি পইপই করে সৌমেনকে বুঝিয়েছিল যাতে অফিস থেকে ফিরলে খাওয়া দাওয়ার আগে কোন রকম অশান্তি যেন না করে। বুকানকে কিছু না বললেও পিয়ালিকে ছাড়লো না সৌমেন। বেডরুমে ডেকে নিয়ে অনেক কথা শোনাল। প্রতি বারের মতো এবারেও ও চুপচাপ শুনলো। আসলে সৌমেনের প্রশ্নগুলোই এমন যে তার ঠিক-ঠাক উত্তর কী হবে বুঝে উঠতে পারে না পিয়ালি। চোখে জল এসে গেল। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বেরতেই পিয়ালি দেখে বুকান পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে। বাবা-মায়ের সব কথপোকথনই শুনেছে কিন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। বরং মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেল।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই বুকান হঠাৎ তীরের মতো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “বাবা, তুমি মাকে কী বলেছিলে যে মা কাঁদছিল?”
আচমকা বাড়ির পরিবেশটা নিঝুম হয়ে গেল। পিনপতন স্তব্ধতা সারা বাড়ি জুড়ে। এঁটো থালাবাসন তুলতে গিয়ে থমকে গেল পিয়ালি। ধীরে ধীরে আবার বসে পড়ল চেয়ারটায়। সৌমেন স্থির হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে। বুকানের পশ্নে হতবাক। এ কী শুনছে সৌমেন? বুকান জবাবদিহি চাইছে! তাও বাবার কাছে! যা আগে কোনও দিন হয়নি। মায়ের সঙ্গে বাবা কী ব্যবহার করেছে, কী বলেছে? ভাবতে পারছিল না সৌমেন।
সাময়িক ঝটকা সামলে সৌমেন চড়া গলায় বলে, “তোর এত সহস হয় কীকরে? তোর মায়ের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে সেটা তুই জিজ্ঞেস করতে পারিস না।”
“সরি বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু এটা তো সত্যি যে তুমি প্রায়ই আমার সামনে আমার পড়াশোনা নিয়ে মাকে বকাবকি করো? আমার পরীক্ষা ভালো-খারাপ নিয়ে মাকে দোষারোপ করো।”
“হোয়াট! কী বলছিস তুই, তুই ভালো মার্কস আনলেও আমি তোর মাকে দোষ দিই?”
“দাও তো, সেদিনই তো দিলে… ওই দিন যেদিন আমার ফাস্ট টার্ম পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড এল।”
মাথা ঘুরছে পিয়ালির। একটা অজানা আশঙ্কায় স্থানু হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে ঝড় উঠবে। কোনও রকমে একবার বুকানকে চুপ করতে বলল। কিন্তু শব্দগুলো এত নিঃশব্দে উচ্চারিত হল যে বুকানের কানে তা পৌঁছলো না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে দম বন্ধ হয়ে আসার মত অবস্থা।
বুকানের চোখে জল। কিন্তু আজকে যেন কোনও অলৌকিক শক্তি ভর করেছে। বাবার সামনে এতটুকুও ঘাবড়ালো না। হাত-পা শক্ত করে বাবার চোখে চোখ রেখে বলল, “ফাস্ট টার্মে যখন আমার ম্যাথ আর সায়েন্সের মার্কস বেশি ছিল সোশ্যাল সায়েন্স আর ইংলিশের চেয়ে… তুমি মাকে কী বলেছিলে? তোমার হয়ত মনে নেই, আমার মনে আছে। বলেছিলে পড়ানোর জন্য টেকনিক লাগে, তুমি সেটা জানো না। মা জানে না আর তাই তোমার বিষয়ে বেশি মার্কস এসেছিল।”
সৌমেন নির্বাক! বুকান বলে চলল, “লাস্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় যখন ম্যাথের চেয়েও ইংলিশে বেশি মার্কস এসেছিল, তখন মায়ের কী আনন্দ! রিপোর্ট কার্ড হাতে পেয়েই মা বলেছিল, “আসুক তোর বাবা। এবার কী বলে দেখি”।
এরপর আর চুপ করে থাকা যায় না। ঝাঁঝালো গলায় পিয়ালি বলে উঠে, “অনেক হয়েছে, এবার থাম। তোর লজ্জা করে না? বাজে রেজাল্ট করেছিস, তারপর আবার বাবার মুখে মুখে তর্ক করছিস”।
“মনে করে দ্যাখো মা, এটাই তুমি বলেছিলে। আজ রিপোর্ট কার্ড দেখে বললে, ‘আমার বিষয়গুলোতে বাজে মার্কস হল’, তুমি আর বাবা বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছ, তোমাদের মধ্যে অলিখিত কম্পিটিশন চলে। কিন্তু কেন মা, কেন?”
ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে পিয়ালি সৌমেনকে অনুরোধ করল ঘরে চলে যেতে। আর বুকানকে বলল “রেজাল্ট খারাপ করে এই ভাবে তুই অন্যের উপর দোষ চাপাস না। এগুলো অসভ্যতা। তুই তো এমনি ছিলিস না। হঠাৎ তোর মাথায় এসব কে ঢোকাল”?
“আমার রেজাল্ট খারাপ হয়নি।”
সৌমেন এবার আর থাকতে পারলো না, চিৎকার করে বলে উঠল, “ইংলিশে বি, সোশ্যাল সায়েন্সে বি-প্লাস, সায়ন্সে বি-প্লাস, ম্যাথে সি এমন কি বেঙ্গলিতেও তুই বি-প্লাস পেয়েছিস। এটা যদি ভালো হয় তাহলে খারাপ কোনটা রে?”
“ওগুলো সব ইচ্ছাকৃত।”
“মানে?”
“আমার এই রেজাল্টের কারণ অবশ্যই তোমরা।”
“কেন রে, আমরা কী করলাম”, সৌমেন বলে উঠে।
“প্রতিবার রেজাল্ট বেরোলে তোমরা দ্যাখো, কার বিষয়ে আমি বেশি মার্কস পেয়েছি। এটা দ্যাখো না রিপোর্ট কার্ড কেমন এসেছে। সুযোগ পেলেই মায়ের পড়ানোর টেকনিক নিয়ে সমালোচনা করো, কেন বাবা? অথচ মনে মনে খুশি হও তুমি জিতে গেছ বলে। আবার উল্টোটা হলে মা আনন্দ পায়। তোমার মত হয়ত কিছু বলে না, কিন্তু আমি জানি মা খুশি হয়। কিন্তু সবটাই কি টেকনিকের জন্য? আমার পরিশ্রমের কোনও দাম নেই? কখনো তো আমাকে বল না, ‘ইউ হ্যাভ ডান ওয়েল’? মা তুমিও তো এরকম কিছু বল না, উল্টে বল, ‘দিলি তো তোর বাবার কাছে আমার নাক কেটে?’ তোমরা কেন আমাকে নিয়ে কম্পিটিশন কর? প্লিজ ইউ বোথ স্টপ ফাইটিং অন মি।” এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল বুকান। তারপর সোফায় বসে পড়ল।
পিয়ালি আর সৌমেন দুজনেই বাকরুদ্ধ। আত্মগ্লানির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে ওদের চোখেমুখে। পিয়ালির চোখে জল। ওদের ইগোর লড়াই বিশ্রী ভাবে ক্ষত-বিক্ষত করেছে সন্তানকে। শুধু তাই নয় এই সর্বনাশা কম্পিটিশনের চূড়ান্ত ফলফল হল ওদের দু’জনারই পরাজয়। সমস্ত ঘর জুড়ে অসীম নীরবতা। পিয়ালি মাথা নিচু করে বসে আছে। সৌমেন চুপ। বুকানের চোখে জল। তারপর ধীর পায়ে উঠে এসে সৌমেন বুকানের পাশে এসে বসে। আলতো করে বুকানের পিঠে হাত রেখে বলে, “সরি, বুকান।”
বুকান কেঁদে ফেলে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। মাথায় হাত দিয়ে সৌমেন বলল, “তুই তোর ইচ্ছে মতন এগিয়ে চল। আমরা তোর পাশে থাকব।”
এক ঝলক টাটকা বাতাস ছড়িয়ে পড়ল গোটা বাড়িতে। বুকানের মুখে হাসির ঝিলিক। সোফা থেকে উঠে এসে মাকে আঁকড়ে ধরল। পিয়ালির চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়ল ওর মাথায়।