তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
৭.
সুরঞ্জনা
Advertisement
তমোনাশের সামনে তখন মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে সঞ্চালক মালবিকা সোম মৃদুকণ্ঠে বলল, এবার শুরু করুন৷
Advertisement
তমোনাশ হাত বাড়িয়ে বুঝে নিল মাইক্রোফোনের অবস্থান৷ সামান্য সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনাদের সবাইকে আমার শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা৷ রবীন্দ্রসদনে এই আমার প্রথম অনুষ্ঠান৷ আমার গায়কজীবনের শুরুতে এটি এক শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত৷ আমার বিশেষ গর্বের বিষয় আমি আজ গাইতে পারছি বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুরঞ্জনা বসুর সঙ্গে একই মঞ্চে৷ আমার কষ্টের বিষয় আমি আপনাদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু অন্তরের চোখ দিয়ে দেখছি শহরের বহু গুণী মানুষ উপস্থিত হয়েছেন এই অনুষ্ঠানে৷
তমোনাশ একটু থেমে বলল, অনুষ্ঠানের সঞ্চালক একটু আগে খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করলেন বসন্তের রূপ৷ বসন্তের গায়ে কত রঙ৷ রবীন্দ্রনাথের গানে উল্লেখ থাকে রঙের ঝরনাধারার কথা৷ কত রঙের ফুল৷ কত রঙের নিসর্গ৷ কিন্তু আমার জীবনে কোনও রঙ নেই৷ আমার দু’চোখে শুধু একটাই রঙ, সেই রঙ কালো৷ সেই অন্ধকার পৃথিবীতে বাস করে খুঁজে বেড়াই রঙের জগৎ৷ রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে এনে দিয়েছেন সেই রঙের পৃথিবী৷ আমি প্রথম গানটা গাইছি একটু অন্যরকমের গান৷ ‘সংসার যবে মন কেড়ে লয়’৷ মানুষের দু’চোখে লেগে থাকে মায়ার কাজল৷ তার পরিণামে মানুষ নিমগ্ন থাকে ধনসম্পদের টানে, তার ফলে প্রাণ জাগে না, ভুলে থাকে ঈশ্বরকে৷ তখন কবির ইচ্ছে জাগে ঈশ্বরের গান গাইতে৷
রবীন্দ্রনাথ এই গানের মাধ্যমে যে নিবেদন করেছেন, এই গায়কও রবীন্দ্রনাথের বাণী ধার করে তার আকুতিও নিবেদন করছে ঈশ্বরকে৷
তমোনাশের উদাত্ত কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বাণী :
সংসার যবে মন কেড়ে লয়, জাগে না যখন প্রাণ,
তখন হে নাথ, প্রণমি তোমারে গাহি বসে তব গান৷
অন্তরযামী, ক্ষমো সে আমার শূন্য মনের বৃথা উপহার
পুষ্পবিহীন পূূজা-আয়োজন, ভক্তিবিহীন তান৷
তমোনাশের কণ্ঠ খুবই মন্দ্র, গলা খুলে গান গায়, তবে এই গানে বারবার জেগে উঠছে কী এক বিষাদ৷ ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদন করছে তার গান, কিন্তু সেই গান যেন শূন্য মনের বৃথা উপহার৷ গায়ক ক্ষমা চাইছেন ঈশ্বরের কাছে৷ তাঁর এই পূজার আয়োজন পুষ্পবিহীন, তাঁর তান যেন ভক্তিবিহীন৷
তমোনাশের পাশে বসে সুরঞ্জনা লক্ষ্য করছিল তমোনাশের নিবেদন৷
সামনে প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি শ্রোতারাও চুপ করে শুনছেন নবীন গায়কের এই নিবেদন৷
ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে, আশা করি প্রাণপণে
নিবিড় প্রেমের সরস বরষা যদি নেমে অসে মনে
সহসা একদা আপনা হইতে ভরি দিবে তুমি তোমার অমৃতে,
এই ভরসায় করি পদতলে শূন্য হৃদয় দান৷
তমোনাশের কণ্ঠের ওঠাপড়া, সুরধ্বনি, কিন্তু তার কণ্ঠের বিষাদ কি স্পর্শ করছে শ্রোতার হৃদয়?
তমোনাশের কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে— তা হলে একদিন ঈশ্বরের অমৃত নিজে থেকে এসে ভরে যাবে আমার হৃদয় এই ভরসায় ঈশ্বরের পদতলে দান করব শূন্য হৃদয়৷
গান থামিয়ে তমোনাশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দ৷
তমোনাশের গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুরঞ্জনা ভেবেছিল তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়বে প্রেক্ষাগৃহ, কিন্তু কী আশ্চর্য, কী এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে শ্রোতাদের মধ্যে৷
তা হলে কি তমোনাশের গান ভালো লাগেনি শ্রোতাদের? সুরঞ্জনা একবার চোখ ফেলল উইংসের পাশে দাঁড়ানো রত্নদীপবাবুর দিকে৷ তিনিও খুব উদ্বিগ্ন নবীন গায়কের গানে কোনও সাড়া না-মেলায়।
নৈঃশব্দ্য যখন বেশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে, তমোনাশ শুকনো গলায় বলল, সুরঞ্জনাদি, কেউ কোনও কথা বলছেন না কেন?
sবাউলের গান৷
বলে সুরঞ্জনা বসন্তের তুমুল উচ্ছ্বাস কণ্ঠে এনে গাইতে শুরু করল :
বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা
বইল প্রাণে দখিন-হাওয়া আগুন-জ্বালা৷৷
দু’বার আস্থায়ী অংশ গাইতেই প্রেক্ষাগৃহে সঞ্চারিত হল একটা উল্লাসের ধ্বনি৷ সুরঞ্জনা উপলব্ধি করল শ্রোতারা এসেছেন বসন্তের গান শুনতে৷ তমোনাশের গলায় বিষাদ শুনে তারা কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলেন৷ বিষাদের বাতাবরণ সরিয়ে শ্রোতাদের মনে আনতে হবে বসন্তের রঙিন উন্মাদনা৷ আরও উচ্ছ্বসিত হয়ে চলে গেল সঞ্চারীতে :
পিছের বাঁশি কোণের ঘরে মিছে রে ওই কেঁপে মরে—
মরণ এবার আনল আমার বরণডালা৷৷
গান থামিয়ে সুরঞ্জনা বলল, বসন্ত আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু৷ শুধু আমার কেন, আমার অনুমান প্রেক্ষাগৃহে যাঁরা গান শুনতে এসেছেন, সবারই প্রিয় ঋতু৷ কারণ বসন্ত ভালোবাসার ঋতু৷ বসন্ত ভালোলাগার ঋতু৷ বসন্ত ভুলিয়ে দিতে পারে আমাদের মনের অনেক দুঃখ৷ পরিষ্কার করে দিতে পারে অনেক ক্লেদ৷ একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ একবার পুরুলিয়া গিয়েছিলাম এরকমই এক ফাল্গুন মাসে৷ পথে হাঁটছি এলোমেলো, যেদিকে তাকাই শুধু রঙ আর রঙ৷ একটা রাস্তার দু’ধারে এত পলাশ গাছের সারি, মনে হচ্ছে কেউ এসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে রাস্তা বরাবর৷ আমি দাঁড়িয়ে দেখছি তো দেখছিই৷ হঠাৎ গাড়ির পিঁক পিঁক শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি আমি দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার মাঝখানে, আমার সামনে পিছনে প্রচুর গাড়ি থমকে দাঁড়িয়ে৷ রাস্তা জ্যাম, আমি সরে না গেলে কেউ যেতে পারছে না।
প্রেক্ষাগৃহে তখন তুমুল হাততালি৷ সুরঞ্জনা স্বরে উল্লাস ফুটিয়ে ধরল গানের সঞ্চারী :
যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ-পাতালে৷
নাচের তালের ঝঙ্কারে তার আমায় মাতালে৷
দু’লাইন গেয়েই বলল, তমোনাশ শুরু করো৷ দ্বৈতকণ্ঠে গাই৷
তমোনাশ বেশ হতাশ হয়ে ছিল এতক্ষণ৷ সুরঞ্জনা বলতেই সেও কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ভরে সুরঞ্জনার সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গেয়ে ওঠে,
যৌবনেরই ঝড় উঠেছে আকাশ-পাতালে৷
নাচের তালের ঝঙ্কারে তার আমায় মাতালে৷
প্রেক্ষাগৃহের শ্রোতা তখন এক মুহূর্ত থমকে বুঝতে চাইল দু’জনের গাওয়ার রকম৷ পরক্ষণে একটা উল্লাসের স্রোত বয়ে গেল সবার মধ্যে৷ সুরঞ্জনা বিষয়টা উপলব্ধি করে চলে গেল আভোগ গাইতে :
কুড়িয়ে নেবার ঘুচল পেশা উড়িয়ে দেবার লাগল নেশা—
আরাম বলে ‘এল আমার যাবার পালা’৷
তমোনাশও সুরঞ্জনার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইল কলিদুটো৷ তারপর আস্থায়ীর দু’কলি৷ গাইতে গাইতে দু’জনেরই কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, উল্লাস৷ দু’জনের প্রাণোচ্ছ্বলতা শ্রোতাদের মনে ঝড় তুলে দিল অঝোর যৌবনের৷ প্রেক্ষাগৃহে আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ৷
সুরঞ্জনার সঙ্গে তমোনাশের দ্বৈতকণ্ঠে গানটি খুব পছন্দ হল শ্রোতাদের৷ সুরঞ্জনা দীর্ঘদিনের গায়িকা, জানে শ্রোতাদের মানসিকতা, জানে কোন গান কখন গাইলে শ্রোতাদের মন জয় করা যাবে। তমোনাশের এই প্রথম বড়ো প্ল্যাটফর্মে গাওয়া৷ প্রথম গানে সে ব্যক্ত করতে চেয়েছে তার জীবনের ট্র্যাজেডির কথা৷ প্রথম অনুষ্ঠানের প্রথম গানে ঠাঁই চেয়েছে ঈশ্বরের কাছে৷ শ্রোতারা কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দ থেকে বুঝতে চাইছিলেন নবীন গায়কের অভিপ্রায়৷
সুরঞ্জনা বলল, আমার পরের গান :
‘বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলি পরে’
—এই গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ষাটোর্ধ্ব বয়সে৷ লক্ষ্যণীয়, তাঁর যত বয়স বাড়ছে, কলম ভরে উঠছে যৌবনে৷ খুবই আশ্চর্য লাগে যে, জীবনের শেষ কুড়ি বছরে তিনি লিখে গেছেন আশ্চর্য সব প্রেমের কবিতা৷ এই গানটিতেও বসন্তের জয়গান৷ বসন্তকাল এসে আদর করে তার গান লিখে যাচ্ছে ধুলোর উপর৷ বসন্তের ধুলো-রাঙা যৌবনের উচ্ছ্বাস উদ্ভাসিত গানটির ছত্রে ছত্রে৷ গানটি জীবনের সৌন্দর্যবোধের অফুরন্ত প্রকাশ৷
এই গানটিও প্রশংসা পেল শ্রোতাদের হাততালিতে৷ সুরঞ্জনা অনুমান করল, তারা আস্থা ফিরে পেয়েছে শ্রোতাদের৷ ভাবছিল বলবে, পরের একক গান গাইবেন তমেনাশ গুপ্ত৷ কিন্তু তার আগেই শ্রোতাদের কেউ বলে উঠলেন, আর একটা ডুয়েট গান হোক৷ খুব ভালো লেগেছে আগের গানটা৷
অন্য একজন বললেন, তা হলে ‘মধুগন্ধে ভরা’ দ্বৈতকণ্ঠে হোক৷
সুরঞ্জনা বলল, না ‘মধুগন্ধে ভরা’ গাইব না৷ সবাই জানেন গানটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সুচিত্রা মিত্রর দ্বৈতকণ্ঠে রেকর্ড আছে৷ বরং এই গানটা শুনুন, ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’৷
শ্রোতার বললেন, তাই হোক৷ দ্বৈতকণ্ঠে হোক৷
সুরঞ্জনা বলল, গানটি গাইব বেহাগ রাগে, তাল— দাদরা৷ এই গানটি রচনার পিছনে একটি ইতিহাস আছে৷ শুনলে আপনাদের ভালো লাগবে, উনিশশো ছাব্বিশ সালে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন জার্মানিতে৷ বক্তৃতা করলেন নানা শহরে৷ জামার্নির স্টুটগার্ট শহরে এক পরিবারের আমন্ত্রণে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন৷ সেদিন বিকেলে তাঁদের বাড়ির ছাদে উঠে সমস্ত শহরটা দেখছিলেন দু’চোখ ভরে৷ সেসময় সূর্যাস্তের লাল আলো রবীন্দ্রনাথের সাদা চুলদাড়িতে পড়ে এমন আবিররঞ্জিত মনে হয়েছিল সবাই প্রকাশ করেছিলেন উচ্ছ্বাস৷ রবীন্দ্রনাথ সেই বিকেলটি স্মরণীয় করে রাখতে লিখেছিলেন এই গানটি৷ নাও, তমোনাশ, শুরু করো৷
শ্রোতাদের মতো তমোনাশও গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছিল সুরঞ্জনার কথাগুলো, তার কথা শেষ হতে গাইতে শুরু করল:
মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হল শেষ
ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ–আবেশ৷৷
দ্বৈতকণ্ঠের সেই গান সারা প্রেক্ষাগৃহে সৃষ্টি করছিল অপূর্ব মূর্ছনার৷ গানটি লেখার পিছনের কাহিনিটি শোনার পর গানের কলিগুলোর অর্থ হয়ে উঠলে আরও অর্থবহ৷
দিনান্তের এই এক কোনাতে সন্ধ্যামেঘের শেষ সোনাতে
মন যে আমার গুঞ্জরিছে কোথায় নিরুদ্দেশ৷৷
সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার ’পরে
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে৷
এই গোধূলির ধূসরিমায় শ্যামল ধরার সীমায় সীমায়
শুনি বনে-বনান্তরে অসীম গানের রেশ৷৷
গানের সঙ্গে তার সৃষ্টিকাহিনির অনুষঙ্গ স্পর্শ করে যাচ্ছে প্রতিটি শ্রোতার হৃদয়৷ ‘দিনান্তের এই এক কোনাতে সন্ধ্যামেঘের শেষ সোনাতে’ শব্দগুলি ফুটিয়ে তুলছে কবির আবিরমাখা অবয়ব৷
গানটি শেষ হতে সারা প্রেক্ষাগৃহে তুমুল উচ্ছ্বাস৷ হাততালি শেষ হলে একজন শ্রোতা বললেন, আপনাদের জুটিও কিন্তু আমাদের মন কেড়েছে৷ হেমন্ত–সুচিত্রার পর আমরা এমন জুটি আর পাইনি৷ আজ গাইলেন না, কিন্তু পরবর্তী অনুষ্ঠানে আপনাদের দ্বৈতকণ্ঠে গাইতেই হবে ‘মধুগন্ধে ভরা’৷
ততক্ষণে অনুষ্ঠানের সময়সীমা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷ পোডিয়াামের সামনে চলে এসেছেন সঞ্চালিকা মালবিকা সোম৷ তাঁর সুললিত কণ্ঠে বললেন, মাননীয় শ্রোতৃবৃন্দ, আজকের অনুষ্ঠান একেবারে শেষের দিকে৷ আপনারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন ‘রাগ-অনুরাগ’ সংস্থা আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রসংগীতের এক নতুন জুটি সুরঞ্জনা বসু ও তমোনাশ গুপ্ত৷ ভবিষ্যতে আমরা এই জুটিকে নিয়ে আরও অনুষ্ঠান করব৷ অপেক্ষায় থাকুন৷
সুরঞ্জনা তখনও প্রেক্ষাগৃহে চোখ রেখে দেখছে এ বাই টুয়েলভ সিটে কেউ অসেনি৷
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়
Advertisement



