পূর্ব ভারতের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ হাওড়া–খড়্গপুর শাখায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহণকে আরও নিরাপদ ও শক্তিশালী করতে বড় সিদ্ধান্ত নিল ভারতীয় রেল। দক্ষিণ পূর্ব রেলের অধীনে থাকা এই শাখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ নম্বর ৫৭ পুনর্নির্মাণের জন্য ৪৩১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকার প্রকল্পে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। রেল দপ্তর সূত্রে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রেল চলাচলের নিরাপত্তা যেমন বাড়বে, তেমনই ভবিষ্যতের বাড়তি চাপ সামাল দেওয়ার ক্ষমতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
ব্রিজ নম্বর ৫৭ গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে হাওড়া–খড়্গপুর রেলপথে রেল পরিষেবার ভার বহন করে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত এই সেতুর ভিত্তি মজবুত হলেও বয়সজনিত কারণে কাঠামোর উপর চাপ বাড়ছিল। সেই কারণেই আধুনিক মান অনুযায়ী নতুন করে সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। অনুমোদিত প্রকল্প অনুযায়ী, পুরনো সেতুর বদলে আরও শক্তপোক্ত ও আধুনিক কাঠামো গড়ে তোলা হবে, যাতে দীর্ঘমেয়াদে রেল চলাচল আরও নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য হয়।
Advertisement
নতুন পথে সেতু ও ভায়াডাক্ট নির্মাণ
এই প্রকল্পের আওতায় সেতুর সাবস্ট্রাকচার বা ভিত্তিভাগকে আংশিকভাবে সরিয়ে নতুন পথে নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি একটি সম্পূর্ণ নতুন ভায়াডাক্ট তৈরি করা হবে, যা বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং মানদণ্ড অনুযায়ী অনেক বেশি টেকসই। রেল আধিকারিকদের মতে, এই নতুন নকশা সেতুর স্থায়িত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি ধাতু ও নির্মাণসামগ্রীর বয়সজনিত ক্ষয় কমাতে সাহায্য করবে।
Advertisement
কোলাঘাটে নতুন রেল স্টেশন
এই প্রকল্পের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কোলাঘাটে নতুন রেল স্টেশন নির্মাণ। ডেউলটি থেকে কোলাঘাট স্টেশনের মধ্যবর্তী অংশে যাত্রী পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন স্টেশনে আধুনিক প্ল্যাটফর্ম, যাত্রী প্রতীক্ষালয়, জল, আলো ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা উন্নত করা হবে। এর ফলে স্থানীয় যাত্রীদের যাতায়াত আরও স্বচ্ছন্দ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের চাপ মাথায় রেখে নকশা
বর্তমানে রেলপথে মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। ভারী পণ্য পরিবহণের কারণে অ্যাক্সেল লোড বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দ্রুতগতির ট্রেন চালানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। এই বিষয়গুলি মাথায় রেখেই নতুন সেতুর নকশা তৈরি করা হয়েছে। রেল দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুন সেতু প্রতি ঘণ্টায় একশো তিরিশ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হবে এবং সাতান্ন গ্রস মেট্রিক টনের বেশি ভার বহনে সক্ষম হবে।
এই উন্নত নকশার ফলে শুধু নিরাপত্তাই নয়, বরং গোটা রেলপথের কার্যক্ষমতাও বাড়বে। একই সঙ্গে এই সেতু হাওড়া–খড়্গপুর শাখার সমান্তরাল লাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণ করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে ট্রেন চলাচলে কোনও অসামঞ্জস্য না তৈরি হয়।
চতুর্থ লাইনের প্রস্তুতি
ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই প্রকল্পে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করা হয়েছে। অনুমোদিত কাজের মধ্যে চতুর্থ রেললাইনের জন্যও প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। জায়গার প্রাপ্যতা, প্রযুক্তিগত দিক এবং খরচ—এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করে এমন একটি যৌথ সাবস্ট্রাকচার তৈরি করা হবে, যা একদিকে আপ লাইনের জন্য ব্যবহৃত হবে, আবার ভবিষ্যতে চতুর্থ লাইন বসানোর ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো যাবে। এতে ভবিষ্যতে আলাদা করে বড় নির্মাণকাজের প্রয়োজন কমে যাবে।
ব্যস্ত রেল করিডরে বড় স্বস্তি
হাওড়া–খড়্গপুর রেলপথ পূর্ব ভারতের অন্যতম ব্যস্ত করিডর। এই পথে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি ভারী মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। সেতু পুনর্নির্মাণের এই প্রকল্প সম্পূর্ণ হলে রেল চলাচলের ক্ষমতা, সংযোগ ব্যবস্থা এবং সার্বিক দক্ষতা অনেকটাই বাড়বে বলে মনে করছে রেল দপ্তর।
রেল আধিকারিকদের বক্তব্য, এই প্রকল্প শুধু একটি সেতু নির্মাণের কাজ নয়, বরং গোটা রেল করিডরের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের অংশ। নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রী পরিষেবার মান উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণ করাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।
অর্থনীতি ও যোগাযোগে প্রভাব
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কেবল রেল পরিষেবাই নয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থনীতিও উপকৃত হবে। নির্মাণকাজ চলাকালীন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, পাশাপাশি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপেও গতি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, ৪৩১ কোটি টাকার এই প্রকল্প হাওড়া–খড়্গপুর শাখার রেল পরিকাঠামোয় এক নতুন অধ্যায় যোগ করতে চলেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও ভবিষ্যতমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমে এই সেতু আগামী কয়েক দশক ধরে পূর্ব ভারতের রেল চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্র হয়ে উঠবে—এমনটাই মনে করছেন রেল বিশেষজ্ঞরা।
Advertisement



