• facebook
  • twitter
Wednesday, 26 March, 2025

মোদী-ট্রাম্প দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে কি চাপ বাড়ল ভারতের?

ভারতে পারমাণবিক চুল্লি বাড়িয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাইছে ট্রাম্প। তেল ও গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে আমেরিকার বড় একটি ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধি হতে চলেছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ভারত ও মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে মোদী ও ট্রাম্পের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়ে গেল হোয়াইট হাউসে। দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু, কার্যত কার কী লাভ হল, ভারত এব্যাপারে ঠিক কতটা সুবিধা পেল, নাকি মাঝপথে ট্রাম্প মোদিকে পাঁচ গোল দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, তা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকেই দাবি করেছেন, এই বৈঠকে চাপ বাড়ল ভারতের। আবার অনেকে দাবি করেছেন, এই বৈঠকের ফলে ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোনও ইতিবাচক সুরাহা হয়নি।

বড় মুখ করে আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু আমেরিকা ও ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে গিয়ে কার্যত মোদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবসায়িক সুবিধা করে দিলেন। বিনিময়ে দেশের বড় কোনও বাণিজ্যিক মুনাফা হল না। এমনকি বাংলাদেশ ও চীনের সীমান্ত সুরক্ষার ব্যাপারে কোনও গঠনমূলক পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেল না।

প্রসঙ্গত, মোদী ও ট্রাম্পের মধ্যে যে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার ১০টি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দশটির মধ্যে রয়েছে—
১. মাগা + মিগা = মেগা অর্থাৎ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) এবং ‘মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেইন’ মিগা।
২. বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ভারত মার্কিন তেল ও গ্যাস আমদানি বাড়াবে।
৩. তাহাউর রানাকে প্রত্যর্পণ।
৪. প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করা। পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করা।
৫. অবৈধ অভিবাসন সম্পর্কে ভারতের অবস্থান।
৬. একবিংশ শতাব্দীর জন্য মার্কিন-ভারত চুক্তি।
৭. বাণিজ্য এবং শুল্ক।
৮. ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ বাণিজ্য করিডরের উপর আলোকপাত।
৯. মোদীর প্রতি আস্থা।
১০. ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব।

এই দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে ভারতের ক্ষেত্রে কোনটা লাভজনক? আর আমেরিকার কোনটাতে ঠিক কী অর্থনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে রয়েছে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষত মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আগেই ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর পাল্টা আমদানি শুল্ক চাপানোর ঘোষণা করেন। এমনকি যৌথ সাংবাদিক বৈঠকেও সেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ভারত যে হারে আমেরিকান পণ্যে আমদানি শুল্ক চাপিয়ে রেখেছে, আমরাও ঠিক ততটাই চাপাব। ফলে ভারতের ক্ষেত্রে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি যে যথেষ্ট ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ ভারত যদি আমেরিকায় রপ্তানি করা পণ্যে শুল্ক কমাতে চায়, তাহলে ভারতকেও সেখান থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমাতে হবে। আর এই বিষয়টাই কার্যত ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, আমদানি শুল্ক কমালে দেশীয় শিল্পের বাজারে বিদেশি পণ্য তুলনায় অনেক সস্তা হয়ে যাবে। আবার আমেরিকার ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কে এই সুবিধা দিলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিকেও একইভাবে আমদানি শুল্কে ছাড় দিতে হবে। ফলে দেশীয় সংস্থাগুলি স্বদেশে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাদের পণ্যের চাহিদা তুলনায় কমে যাবে। দেশীয় শিল্প মার খাবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটি নাড়ির বন্ধন রয়েছে। সেদেশে অস্থিরতা তৈরি হলে ভারতে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। এমনকি বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের অস্থির পরিস্থিতির ব্যাপারে ট্রাম্প কোনও দায়িত্ব না নিয়ে সম্পূর্ণ মোদীর ঘাড়ে বিষয়টি চাপিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা সঙ্গে না থাকলে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের পক্ষে বড় কোনও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে কি? এই প্রশ্ন উঠছে বার বার। বিশেষত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গোলযোগে ভারত কতটা নাক গলাতে পারবে, সেদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনে আন্তর্জাতিক আইন মেনে কতটা হস্তক্ষেপ করতে পারবে? সে বিষয়েও যথেষ্ট সংশয় থেকে যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত হাসিনাকে দেশে স্থান দেওয়া এবং বিদেশমন্ত্রকের মাধ্যমে চিঠি প্রেরণ ও মৌখিক আলোচনা ছাড়া বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার।

এদিকে ২০২০-র আগস্টে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিনা ফৌজের হামলায় ২০ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয়। এখনও মাঝে মধ্যেই উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে ভারত-চিন সীমান্তে। কিন্তু চিনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা ও অন্যান্য ব্যাপারে এখনও নরম মনোভাবাপন্ন ট্রাম্প প্রশাসন। বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিনের গুরুত্বের কথা বেশি করে প্রাধান্য দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যা নিয়ে মধ্যস্থতা করতে চেয়ে প্রকারান্তরে ভারতের সার্বভৌম শক্তির ওপরেই হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছে। এমনকি চিনকে মোকাবিলার নামে ভারতের কাছে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম বিক্রি করে নিজেদের ব্যবসায়িক মুনাফার দিকে নজর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সরবরাহ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ এর প্রযুক্তিগত গুণমান নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, সেটি হল আমেরিকায় অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের হাত-পা বেঁধে অসম্মানজনক অবস্থায় দেশে ফেরত পাঠিয়ে ভারতীয়দের আবেগে আঘাত করা হয়েছে। মোদী ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে এ ব্যাপারে কোনও সুরাহা করতে পারেননি। ট্রাম্প প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে চাপ বাড়াতে পারেননি।

এছাড়া ভারতে পারমাণবিক চুল্লি বাড়িয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে ট্রাম্প। তেল ও গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে আমেরিকার বড় একটি ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধি হতে চলেছে। কিন্তু সেই ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকার কাছ থেকে ভারত কতটা সুবিধা পাবে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। এক কথায়, বুকে টেনে নিয়ে, বই উপহার দিয়ে, আর মোদীর ভূয়সী প্রশংসা করে ট্রাম্প প্রমাণ করে দিলেন তিনি মোদীর চেয়েও অনেক বড় মাপের সেলসম্যান।