১ ফেব্রুয়ারি সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামান। আর তার ঠিক ১১ দিনের মাথায় ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাজ্যের বিধানসভায় বাজেট পেশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তার ঠিক পরের দিন কেন্দ্রকে নিশানা করলেন রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অভিযোগ করেন, বাজেটে ভোটের মুখে কেন্দ্র বিহারকে ভরিয়ে দিয়েছে, আর বাংলার ক্ষেত্রে শুধুই বঞ্চনা। এভাবে বাংলাকে বঞ্চনা করা হয়েছে। কেন্দ্র বাংলার জন্য কী করেছে, তা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জানাক। শুধু তাই নয়, রাজ্য বাজেটে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন অভিষেক। তিনি বলেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে কেন্দ্র সহযোগিতা না করলেও রাজ্য নিজের চেষ্টাতেই এই প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ করবে।
প্রসঙ্গত ১০০ দিনের কাজ ও আবাস যোজনায় কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও মমতা সরকার বাজেটে বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। এমনকি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কেন্দ্র সহযোগিতার হাত না বাড়ালেও রাজ্য সরকার বসে নেই। সেই প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষের টার্গেট নিয়েছে।
এদিন অভিষেক স্মরণ করিয়ে দেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে একাধিকবার কেন্দ্রের দ্বারস্থ হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরাও গিয়েছেন। রাজ্যের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিবরাও কেন্দ্রের কাছে দরবার করেছে। এবং সেই কথা মতো ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে কেন্দ্রকে ১২০০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা হয়েছিল। গত লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে অর্থাৎ ২০২৪ সালের প্রথমের দিকে মমতা আরামবাগ থেকে একটি সভায় প্রতিশ্রুতি দেন, কেন্দ্র যদি আগামী এক বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের টাকা না দেয়, তাহলে রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে আমরা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ করব।
বৃহস্পতিবার সাতগাছিয়ায় ‘সেবাশ্রয়’ শিবির থেকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ তথা তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় নেতা। সেখানে একাধিক বিষয় নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেন। ছাব্বিশের নির্বাচনে মমতার কথামতো ‘একলা চলো’ নীতি থেকে দিল্লির ভোটে ‘ভূতুড়ে ভোটার’ তত্ত্ব, আপ-কংগ্রেসকে ‘শিক্ষা’, কেন্দ্রীয় বাজেটে বাংলাকে ‘বঞ্চনা’ – তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে কড়া সমালোচনার আভাস দেন অভিষেক।
এদিকে বুধবার তৃতীয় মমতা সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ হয়েছে। এই বাজেটকে মানুষের বাজেট বলে দাবি করেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বাজেট ইস্যুতে কার্যত এদিন অভিষেক কার্যত কেন্দ্রকে তুলোধোনা করেন। সংখ্যালঘু বিভাগে বাজেট ১৫৭৫ কোটি টাকা থেকে ৫৬ শতাংশ কমিয়ে ৬৮৩ কোটি টাকা করা হয়েছে কেন? মাইনরিটিরা ভোট দেয় না বলে? ভোট দিলে লাড্ডু, আর ভোট না দিলে বঞ্চনা! রাজ্য সরকার যে বরাদ্দ করে, সেগুলি কি ধর্ম দেখে করা হয়? শিক্ষা দপ্তরে ৪৪ হাজার কোটি, পঞ্চায়েত দপ্তরে ৪০ হাজার কোটি টাকার ওপরে দিচ্ছে রাজ্য। এছাড়া যারা লক্ষ্মীর ভান্ডার পাচ্ছে, যারা কন্যাশ্রী পাচ্ছে, যারা শিক্ষাশ্রী পাচ্ছে, তা কি দল বা ধর্ম দেখে দেওয়া হয়? তিনি বলেন, ‘জাতির রাজনীতি করে এরা মুখ থুবড়ে পড়েছে।’
তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে আক্রমণ করে বলেন, ‘নির্মলা সীতারামন যে বাজেট পেশ করেছেন, সেটা বাংলা বিরোধী বাজেট। সুপরিকল্পিতভাবে বাংলার উন্নয়নযজ্ঞ রুখে দেওয়ার চেষ্টা।’
অভিষেক এদিন রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারকেও একহাত নিয়েছেন। তিনি বলেন, সুকান্ত মজুমদারের উচিত আত্মবিশ্লেষণ করা, বালুরঘাটে যদি পাঁচ হাজার ভোট বিজেপি কম পেত, তাহলে হেরে যেত, পরের বার আসন ধরে রাখতে পারবে না। দ্রুত বিশ্লেষণ করুক এবং মানুষ তাঁকে ভোটে জিতিয়েছে, এনডিএ সরকার তাঁকে মন্ত্রী করেছে, উনার উচিত গত ন’মাসে বাংলার জন্য কী করেছে, শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তিনি তার প্রমাণ দিন।’
অভিষেক দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আপ সরকারের পতনের পিছনেও কেন্দ্রের শাসকদলের কারসাজির ইঙ্গিত করেন। তিনি দিল্লির ভোটার তালিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। বলেন, গত আট মাসে ৪ লক্ষ ভোটার নথিভুক্ত হয়েছে। যা গত দশ বছরে হওয়ার কথা। এই প্রসঙ্গে তিনি ভুতুড়ে ভোটার তত্ত্ব তুলে ধরে দাবি করেন, এই ভুয়ো ভোটারের সূক্ষ্ম হিসেব বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে।
দিল্লির পরাজয় প্রসঙ্গে মমতার সুরেই কথা বলেছেন অভিষেক। ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটারদের নাম তোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেকের গলাতেও শোনা গেল সেই একই অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘দিল্লিতে ভোটের ৭,৮ মাস আগে থেকে ধাপে ধাপে প্রায় ২০ হাজার ভোটারের নাম উঠেছে। আবার কিছু বাদও গিয়েছে। একেকটা বিধানসভায় একেকরকম হয়েছে। এটা খুব একটা সঠিক বলে আমার মনে হচ্ছে না।’
এদিকে দিল্লি ভোটে আপ-কংগ্রেসের ভরাডুবিতে সমন্বয়ের অভাবকেও দায়ী করেছেন মমতা। একই সুরে অভিষেক বলেন, ‘দিল্লির ফলাফল থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। গণতন্ত্রে জনরায়কে সবসময় সম্মান জানাতে হয়।’
একইভাবে ২০২৬-এ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক কি নীতি গ্রহণ করবে সেই প্রশ্নও ওঠে। ছাব্বিশে তৃণমূল কি ‘একলা চলো’ নীতি নেবে? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে অভিষেক বলেন, ‘আমরা তো সেই ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রতিটা নির্বাচনে একাই লড়েছি। লড়ে নিজেদের শক্তিও প্রমাণ করেছি। আর দিদিও বলেছেন, কাউকে দরকার নেই, নিজেরাই লড়াই করে আবারও প্রমাণ দেব। আমাদের সংগঠন অতি মজবুত।’