(পর্ব – ১০)
মৌলিক অধিকার ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান স্থপতি, ড. বি আর আম্বেডকর বিশ্বাস করতেন যে, মৌলিক অধিকার আইনের একটি উপহার। এটি ন্যায়সঙ্গত হওয়া উচিত। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, মৌলিক অধিকার নিরঙ্কুশ নয়। বরং সীমাবদ্ধতা থাকা উচিৎ। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘খসড়া সংবিধানে’ নিরঙ্কুশ অধিকার এড়ানোর জন্য মৌলিক অধিকারের সীমাবদ্ধতা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। মৌলিক অধিকার শুধুমাত্র আইন দ্বারা নয়, সমাজের সামাজিক ও নৈতিক বিবেক দ্বারা সুরক্ষিত হওয়া উচিৎ। তাঁর মতে, মৌলিক অধিকার প্রয়োগের জন্য ‘সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার অধিকার’ – নিজেই একটি মৌলিক অধিকার।
• মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুকরণে, ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights) গৃহীত হয়েছে। নাগরিক জীবনের প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে, এই অধিকার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এটি খর্ব হলে, আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যায়।
• মৌলিক অধিকার আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য। এই অধিকারগুলি, আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত।
• ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অংশে (Part-III), ১২ নং থেকে ৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকারগুলি বিবৃত আছে।
বর্তমানে ৬টি মৌলিক অধিকার স্বীকৃত রয়েছে, যেমন –
১) ১৪-১৮ ধারাতে, সাম্যের অধিকার।
২) ১৯-২২ ধারাতে, স্বাধীনতার অধিকার।
৩) ২৩-২৪ ধারাতে, শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার।
৪) ২৫-২৮ ধারাতে, ধর্মীয়-স্বাধীনতার অধিকার।
৫) ২৯-৩০ ধারাতে, সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার।
৬) ৩২-৩৫ ধারাতে, শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।
• ১৯৭৮ সালে ৪৪তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৩১ নং ধারাতে বিবৃত ‘সম্পত্তির অধিকার’কে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে, এটি একটি আইনি অধিকার।
• মূল সংবিধানে সাতটি মৌলিক অধিকার ছিল।
• মৌলিক অধিকার, আইন ও শাসনবিভাগের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত এবং আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য। কিন্তু, অন্যান্য অধিকারগুলি, তা নয়।
সাম্যের অধিকার (১৪-১৮ নং ধারা)
ক) ১৪ নং ধারা: ‘আইনের কাছে সমতা’ (Equality before Law)। এর অর্থ হল – সাধারণ ভাবে কেউ আইনের উর্ধ্বে নন। প্রত্যেকেই আইনের অধীন এবং আইনের চোখে সমান অধিকার-প্রাপ্ত।
খ) ১৫ নং ধারা: পৃথকাচরণ বিলোপ। এই ধারায় বলা হয়েছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, নারী-পরুষ বা জন্মস্থানগত কারণে রাষ্ট্র জনগণের প্রতি পৃথকাচরণ (Discrimination) করতে পারবে না। সর্বসাধারণের জন্যে রেস্তোরা বা সরকারি খরচে পরিচালিত পুকুর বা কোনও স্থান ব্যবহারের ক্ষেত্রে, কোনও রূপ শর্ত আরোপ করা যাবে না।
গ) ১৬ নং ধারা: চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধার অধিকার। সরকারি চাকরিতে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের অধিকার রয়েছে। বলা হয়েছে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, নারী-পুরুষ, বাসস্থান এবং জন্মস্থানের পার্থক্যকে বিবেচনা করা যাবে না।
ঘ) ১৭ নং ধারা: অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ। গান্ধিবাদের আদর্শকে গ্রহণ করে এই অধিকার বলবৎ করা হয়েছে। অস্পৃশ্যতার কারণে যে কোনও রকম অপরাধ অইিনের চোখে দন্ডনীয়।
ঙ) ১৮ নং ধারা: পদবি বা খেতাব নিষিদ্ধকরণ। সরকার কর্তৃক ব্যক্তি বিশেষকে খেতাব প্রদান সাম্যনীতি বিরোধী। শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সামরিক গুণের পরিচারক নয়; এমন কোনও খেতাব রাষ্ট্র কাউকে দিতে পারবে না। রাষ্ট্রপতির অনুমতি যাতীত, ভারতের কোনও নাগরিক বিদেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও খেতাব গ্রহণ করতে পারবেন না। উল্লেখ্য, ‘ভারতরত্ন’, ‘পদ্মবিভূষণ’, ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মশ্রী’ প্রভৃতিকে সম্মান বা পুরস্কার (Award) হিসাবে গণ্য করা হয়। কোনও খেতাব বা পদবি নয়।
স্বাধীনতার অধিকার (১৯-২১ নং ধারা)
ক) ১৯ নং ধারা: ১) বাক স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকার। নাগরিকের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য নিজস্ব মতামত, বিশ্বাস ও চিন্তাধারা – মৌখিক বা লিখিত ভাবে প্রকাশ করার অধিকার। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার। ২) শাস্তিপূর্ণ ভাবে সভা-সমিতি গঠনের অধিকার, ৩) নিরস্ত্র সমাবেশের স্বাধীনতা, ৪) ভারতবর্ষের যে কোনও স্থানে যাওয়ার বা বসবাসের অধিকার, ৫) বৃত্তি ও পেশায় স্বাধীনতা।
খ) ২০ নং ধারা: কোনও অপরাধের জন্য নাগরিককে আইন-বহির্ভূত ও অতিরিক্ত শাস্তি প্রদান করা যাবে না।
গ) ২১ নং ধারা: আইন নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া কাউকে তাঁর জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
ঘ) ২২ নং ধারা: এই ধারায় গ্রেপ্তার ও আটকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ১) গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন কোনও বাক্তিকে, সত্বর গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। ২) আটক ব্যক্তিকে আইনজীবীর সঙ্গ্যে পরামর্শের সুযোগ দিতে হবে। ৩) ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকটবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থিত করতে হবে।
শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার (২৩-২৪ নং ধারা)
ক) ২৩ নং ধারা: এই ধারায় মানুষ বেচা-কেনা, বিনা পারিশ্রমিকে ‘বেগার খাটানো’ বা ‘জোর করে কাজ করানো’ নিষিদ্ধ।
খ) ২৪ নং ধারা: এই ধারায় ১৪ বছরের কম-বয়সী কোনও শিশুকে কারখানা, খনি যা অন্য কোনও বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫-২৮ নং ধারা)
ক) ২৫ নং ধারা: এই ধারায় নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক ব্যাক্তি ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং যে কোনও ধর্ম স্বেছা-গ্রহণের, ধর্মীয় উপাসনায় ও ধর্মীয় প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবেন। মূল সংবিধানে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতা’র কথা বলা না হলেও; ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইনে, ‘সেকুলার’ বা ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ শব্দটি প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হয়।
খ) ২৬ নং ধারা: প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজের ধর্মীয় সংগঠন ও কার্যাদি পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও মালিকানার অধিকার লাভ করবে।
গ) ২৭ নং ধারা: ধর্মীয় কারণে, কোনও নাগরিককে কর দানে বাধ্য করা যাবে না।
ঘ) ২৮ নং ধারা: এই ধারা অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া যাবে না। ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি তাঁদের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন।
সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার (২৯-৩০ নং ধারা)
ক) ২৯ নং ধারা: ভারতের যে কোনও অংশের নাগরিকেরা, নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণ করতে পারবেন। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, সমস্ত ভারতীয় সমান সুযোগ লাভ করবেন। কোনও নাগরিককে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
খ) ৩০ নং ধারা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করার অধিকার। পৃথক ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে কোনও সম্প্রদায়কে আর্থিক অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্র কোনও রকম বৈষম্য করতে পারবে না।
শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার (৩২-৩৫ নং ধারা)
ক) ৩২ নং ধারা: মৌলিক অধিকারগুলি থেকে যদি কেউ বঞ্চিত হন, তা হলে তিনি সুপ্রিমকোর্ট বা হাইকোর্টে সরাসরি প্রতিবিধান দাবি করতে পারেন। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, সুপ্রিমকোর্ট বা হাইকোর্ট ‘বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ’ (Habeas Corpus), ‘পরমাদেশ’ (Mandamus), ‘প্রতিষেধ’ (Prohibition), ‘উৎপ্রেষণ’ (Certiorari), ‘অধিকার পৃচ্ছা’ (Quo Warrarto) ইত্যাদি লেখগুলি (Writ) জারি করতে পারে।
খ) ৩৩ নং ধারা: ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর মৌলিক অধিকারগুলি,পার্লামেন্ট (আইসসভা) আইন প্রণয়নের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
গ) ৩৪ নং ধারা: দেশের কোনও অঞ্চলে সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালীন সময়ে, ওই অঞ্চলে মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হতে পারে।
ঘ) ৩৫ নং ধারা: মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন।
গ্রন্থ সহায়তা: ইন্ডিয়ান পলিটি; লেখক – এম লক্ষ্মকান্ত, ম্যাকগ্রহিল ইন্ডিয়া প্রকাশনী।
(বিশেষ কারণে এই সপ্তাহে এমসিকিউ প্রশ্নবলি ও গত সপ্তাহের উত্তর দেওয়া সম্ভব হল না। আগামী সপ্তাহে থাকবে।
এই বিভাগটি তোমাদের কেমন লাগছে, আর কী কী বিষয়ে জানতে চাও। আমাদের ইমেল করে জানাও। ইমেল: [email protected])।