• facebook
  • twitter
Monday, 11 August, 2025

বইপ্রেমীদের হাতেই ১২৫ বছরের বেলুড় পাবলিক লাইব্রেরি

প্রাথমিকভাবে বিদ্যোৎসাহী মানুষের দান করা বই এবং একটি আলমারির ছিল লাইব্রেরীর সম্পদ। সেই পথ চলা শুরু ১৮৯৫ সালে।

উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙ্গালীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারে অন্তহীন উদ্যোগী বিদ্যাসাগর। সেই আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে বিদ্যালয়। এমনই উদ্যোগের ফল হিসেবে এলাকার অগ্রণী মানুষের সহায়তায় বেলুড়ে গড়ে উঠলো ‘বেলুড় মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়’। কয়েকবছরের মধ্যেই এলাকার মানুষজন উপলব্ধি করলেন শুধু বিদ্যালয় নয় এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারও গড়ে তুলতে হবে লাইব্রেরীও। অবশেষে তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেই স্কুলের একটি কক্ষের মধ্যে গড়ে উঠলো লাইব্রেরী।

প্রাথমিকভাবে বিদ্যোৎসাহী মানুষের দান করা বই এবং একটি আলমারির ছিল লাইব্রেরীর সম্পদ। সেই পথ চলা শুরু ১৮৯৫ সালে। ছাত্রদের বিনা শুল্ক এবং সাধারনের জন্য দু আনা চাঁদা নিয়ে চলতে থাকল এই লাইব্রেরী। এই ‘বেলুড় মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ ছাত্রদের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এলেন স্বামী বিবেকানন্দ। কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিলেন এই লাইব্রেরী কক্ষে। পরিদর্শনও করলেন। তিনি লাইব্রেরীর যে চেয়ারে বসেছিলেন সেই চেয়ারটি আজও এই স্কুলে সংরক্ষিত, বর্তমানে এই বিদ্যালয় বেলূড় উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত। তবে লাইব্রেরীর কলেবর এবং ব্যবহারিক উপযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে স্থানান্তরিত হয় অন্যত্র। ১৯৩১ সালে ৩১ জানুয়ারি বালি পৌরসভা গৃহনির্মাণের জন্য বেলুড় জিটি রোড চৌমাথার পূর্ব পাড়ে জমি মঞ্জুর করে। শুরু হয় নির্মাণ কার্য। নির্মাণ কার্যে সহায়তা করেন স্বর্গীয় অনাদিনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখ। অবশেষে ১৯৪১ সালে নতুন ভবনের দ্বারোটঘটনের মধ্য দিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করে এই লাইব্রেরি।

স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই বর্তমান সময় পর্যন্ত এই লাইব্রেরি শিক্ষা সচেতনতার ব্যাপারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ক্ষিতি মোহন সেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, শিবরাম চক্রবর্তী, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, আশাপূর্ণা দেবী থেকে শুরু করে হাল আমলের বিভাস চক্রবর্তী, অজিত পান্ডে, প্রকাশ কর্মকার এর মত গুণীজনের সমাবেশে এ লাইব্রেরী হয়েছে সমৃদ্ধ। নানান আলোচনা সভা এবং অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে এর অগ্রগতি, পাঠকও ঋদ্ধ হয়েছে সমানতালে। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এটি একটি সরকারি অপোষিত পাবলিক লাইব্রেরি। আরম্ভের প্রথম দিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত লাইব্রেরি সচল থেকেছে এলাকার অগ্রণী মানুষের স্বেচ্ছা শ্রমদানে। কিছু সমাজ সচেতন মানুষই এই লাইব্রেরীকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। একটা সময় বালি পৌরসভা থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যেত কিন্তু সেই সাহায্যের গতিপথ এখন প্রায় রুদ্ধই বলা যেতে পারে। প্রাচীন সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃত সাহিত্যের ভান্ডার এই বেলুড় পাবলিক লাইব্রেরী। পুরনো এই সব বইগুলিকে সংরক্ষণ ও ল্যামিনেশন এর জন্য শুধু শ্রম নয় অর্থের দরকার। কিন্তু যারা যুক্ত আছেন তারা লাইব্রেরীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হলেও অর্থ সমস্যায় নাজেহাল। যেহেতু এটি সরকারি অপোষিত লাইব্রেরী তাই কোন কর্মী নেই।

কাজেই বেলুড়ের মত ঐতিহ্যের জায়গায় এই লাইব্রেরীটি শতবর্ষের বেশি সময় ধরে কিভাবে আজ মানুষকে পরিষেবা দিয়ে চলেছে তা বিস্ময়ের। আর এই কাজটি বর্তমানে করে তুলেছেন বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত সমাজ মনস্ক মানুষ। যাঁদের মধ্যে আছেন শংকর জ্যোতি ঘোষ, তরুন দত্ত, অজয় কুমার দে, সমীর কুমার চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয় রায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বিশাল পরিকাঠামো বেলুড় পাবলিক লাইব্রেরীর। ত্রিতল বিল্ডিং, প্রথম তলায় পুস্তক ও লাইব্রেরির পাঠকক্ষ, দ্বিতীয় তলায় ‘রবিতীর্থ কক্ষ’ যেখানে রয়েছে আধুনিক এক মঞ্চ, তৃতীয় তলায় বিবেক তীর্থ যেখানে তৈরী হয়েছিল এক আর্ট গ্যালারি কিন্তু তা আর সযত্নে রক্ষা করা যায়নি। এখন তা সেমিনার হল হিসেবেই ব্যবহৃত।

এমন একটি লাইব্রেরীর ভার কয়েকটি মানুষের সৎ প্রচেষ্টা এবং শ্রমের উপর দাঁড়িয়ে যাঁদের বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। না, নতুন উদ্যোগী সাংস্কৃতিক কর্মীর সেভাবে প্রবেশ ঘটছে না যারা এই লাইব্রেরীকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাই আগামী দিনে এই লাইব্রেরী কি ভাবে চলবে এমন অজানা আশঙ্কা পুস্তক প্রেমী অনেক মানুষের। এখনো বেলুড় পাবলিক লাইব্রেরীতে বেশ কিছু পাঠকের ভিড়। পাঠ বা পাঠক সমস্যা নয়, লাইব্রেরীকে আগামীদিনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই প্রকৃত সমস্যা। এই ধরনের লাইব্রেরীগুলো বাঁচাতে হবে। কিন্তু কে বাঁচাবে সরকার না দু চারজন অগ্রণী মানুষ? এটাই আজকের জরুরী প্রশ্ন?