প্রবীর মজুমদার
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছ’মাস পর বুধবার রাতভর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বুলডোজার দিয়ে ভবনটির একাংশ ভেঙে দেয়া হয়। যেসময় এই ভাঙচুর চলছিল তখন পূর্বনির্ধারিত এক ভার্চুয়াল ভাষণে এর সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, যিনি গত পাঁচই অগাস্ট দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। বৃহস্পতিবার সকালেও ভবনটিকে বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে দেখা যায়। দেখা গেছে, বাড়ির ভিতরে কয়েকশো মানুষ ঢুকছে, যার যা সম্ভব হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছে। কারও হাতে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের লেখা বইয়ের কার্টন, কেউ বা হাতে কয়েকটি বই নিয়েই চলে যাচ্ছেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা বইগুলির মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ভলিউম-৩)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বই। বইগুলি সোজা চলে যাচ্ছে পথচারীদের ব্যাগে, হয়তো বিক্রিও হয়ে যাবে জলের দরে। ভবন থেকে বেরিয়ে আসা লোহা, স্টিল ও কাঠের টুকরাগুলোরও একই পরিণতি। কারও হাতে লোহার রড, কেউ কাঠের দরজা টেনে নিচ্ছেন। আর এসব সংগ্রহ করে রিকশায় তুলে বিক্রির উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছে লোকজন।
একসময়ের ধানমন্ডি-৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি। যার পরিবর্তিত ঠিকানা হয়েছিল ১০ নম্বর বাড়ি, রোড নম্বর-১১, ধানমন্ডি-ঢাকা। এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে ছিল ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ নামে। ১৯৬১ সাল থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে এখানেই থাকতেন। এ বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১০ জুন পর্যন্ত এই বাড়িটি বাংলাদেশ সামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর ঘাতকচক্র এই বাড়িটি সিল করে রাখে এবং বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্যকেই এ বাড়িতে ঢুকতে দেননি। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার ছ’বছর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে ফিরলেও তাঁকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এর কিছুদিন পর হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ঋণে নির্মিত ভবনটি নিলামে ওঠানো হয়। তৎকালীন প্রায় ১২ হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ না হওয়ায় নিলামে চড়ানো হয় বাড়িটি। সে টাকা পরিশোধ করে বাড়ি বুঝে পান শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের জুন মাসের ১০ তারিখে বাড়িটি বুঝে নেওয়ার পর দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘোষণা করেছিলেন ঐতিহাসিক এই বাড়িটি হবে জনগণের। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উদ্বোধন করা হয়।
১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১-এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এসব আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়, সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৩২ নম্বরের এই বাড়ি। এখান থেকেই ট্রাঙ্ককলে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন কাঙ্খিত স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখন্ড ও লাল সবুজের পতাকা। এই বাড়িতেই শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায় রূপান্তরিত হয়েছেন। এই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের এই বাড়ি জাদুঘরে রূপান্তরিত করার কাজে যারা শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। প্রয়াত কবি সুফিয়া কামাল, সাংবাদিক বেবী মওদুদ, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, ফটো সাংবাদিক পাভেল রহমান প্রমুখ নানা সময়ে জাদুঘর সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ নামে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে হত্যা ও গণহত্যা চালায়। এ খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু এই বাড়ির নিচতলায় তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার থেকে টেলিফোনে রাত ১২টা ৩০ মিনিটে স্বাধীনতার ঘোষণা করে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ওয়্যারলেস ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই বাড়ি থেকেই ২৫ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিট তথা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি জাতির পিতাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মিওয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি করে রাখে। বাংলাদেশ বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাড়িটি দখল করে রাখে। অন্যদিকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে মুজিব পরিবারকে বন্দি করে রাখা হয়।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়েছিল এই বাড়িটি। তাই তিনি নিজ বাড়িতে উঠতে পারেননি। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। বাড়ির মেরামত কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পরিবার নিয়ে সরকারি বাসভবনে না উঠে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এই বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু এই বাড়ি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোররাতে মুজিব আর তার পরিবারের আট সদস্যের রক্তে ভেসে যায়। ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ ৩৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১১ সালের ২০ আগস্ট মূল ভবনের উত্তরে এর সম্প্রসারিত ভবন উদ্বোধন করা হয়। এই ষষ্ঠতলা ভবনে ২৬টি পর্বে বঙ্গবন্ধুর তথ্য ও সচিত্র ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই ঐতিহাসিক ভবনকে আজ ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হলো। ইউনূস ক্ষমতা দখল করার পর যে কটি বিষয়ের উপর নজর দিয়েছেন তার অন্যতম হল মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লিগকে মুছে দেওয়া। তিনি ক্ষমতা দখল করার পরপরই তাঁর বাহিনী একাত্তরের সব স্মারক ধ্বংস করেছে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিষিদ্ধ করেছেন। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের সময়টাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করার দরকার তার সব কিছুই তিনি করেছেন। আওয়ামী লিগ বা তার কোনও অঙ্গ-সংগঠনের দূরবর্তী সম্পর্কও থাকলেও কারাগারে যেতে অথবা ইউনুসের সমর্থক গোষ্ঠীর হাতে চরম লাঞ্ছিত হয়ে মরতে হয়েছে। তাতে সহায়তা করেছে জামায়াত শিবির ও হিযবুত সদস্যরা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শগত দুটি ধারা হল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিরোধী শক্তি। দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ বিরোধীরা সংখ্যায় কম হলেও বৌদ্ধিক জগতে, এলিট সমাজে তাঁদেরই কদর বেশি। সেই বাংলাদেশ থেকে গত ৫ অগাস্ট হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশ জুড়ে শেখ মুজিবের কত মূর্তি ভাঙা হয়েছে, তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। সেই ধ্বংসলীলার টুকরো দৃশ্য দেখে অনুমান করা যায়, সংখ্যাটা কয়েকশো হওয়া অসম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ছয় মাস পর বুধবার রাতভর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। বুলডোজার দিয়ে ভবনটির একাংশ ভেঙে দেয়া হয়। যেসময় এই ভাঙচুর চলছিল তখন পূর্বনির্ধারিত এক ভার্চুয়াল ভাষণে এর সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গত বছর ৫ অগাস্ট একদল মানুষ বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে।
এরও আগে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়নি। ছিল না তাঁর কোনও প্রতিকৃতি। প্রথা মেনে উচ্চারিত হয়নি সে দেশের জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, মুহাম্মদ মনসুর আলির নাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে শুধু কোরান পাঠ হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের চালু প্রথা মেনে কোরানের পর গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক থেকে পাঠ করা হয়নি। হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলেও ৫ থেকে ৮ অগাস্ট রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক হিংসায় নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের বালাই ছিল না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ সবই আসলে শেখ মুজিবকে সরকারিভাবে মুছে ফেলার আয়োজনের অংশ।
যাদের হাত ধরে এই উল্টে পথে যাত্রা, গণ অভ্যুত্থানের দিনগুলিতে সেই ছাত্ররা আওয়াজ তুলেছিল, ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি রাজাকাররা শত শত খুন আর হাজার হাজার নারীর উপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছিল। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর বেনজির আক্রমণ চালিয়েছে। মহম্মদ ইউনুসের নানা পদক্ষেপে স্পষ্ট, রাজাকারদের অভিভাবক জামায়াতি ইসলামী তাঁর আসল উপদেষ্টা।
সমস্ত অধ্যায়ই এখন ধূলিস্যাৎ। বুধবার রাত থেকে এই ৩২ নম্বর বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ‘বিপ্লবী ছাত্র জনতা’-র ব্যানারে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার মানুষ। ইতিহাসকে শেষ করতে চাওয়া এ ‘বিপ্লব’ বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা সময়ই বলবে। শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন এই নিয়ে। বলেছেন, ‘দেশের স্বাধীনতা কয়েকজন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলবে এই শক্তি তাদের হয়নি। তারা একটা দালান ভেঙে ফেলতে পারবে, কিন্তু ইতিহাস মুছতে পারবে না।’
আজ সকালেই এক বাংলাদেশী বন্ধু জানালেন যে তিনি নিশ্চিত – ৩২ নম্বর যাদুঘর ছিল। একদিন তা আবার বাংলাদেশীদের তীর্থস্থান হবে।