স্বপনকুমার মণ্ডল
এমনিতেই ওপার বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে এপার বাংলার বাঙালি হিন্দুদের গভীর উৎকণ্ঠা জেগে রয়েছে, তার মধ্যে সরস্বতী পুজো করতে না দেওয়াকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ছায়া স্বাভাবিক ভাবেই ক্রমশ সম্প্রীতির কায়াকে গ্রাস করার আতঙ্ক জাগিয়ে তুলেছে। বাঙালির যে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি বাংলার গর্ব ছিল,তাই বিগত বছর ২০২৪-এর ৫ আগস্টে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেখানে মৌলবাদী ধর্মীয় উগ্র বিদ্বেষের কাছে ধর্মীয় পরিচয়ই প্রাধান্য লাভই করেনি, ভিন্ন ধর্মের অস্তিত্বকেই অস্বীকারে বিপন্ন করে তোলে। সেই ধারা আজও অব্যাহত। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের উপরে নির্বিচারে নৃশংস নির্যাতন নেমে আসে। তার ট্র্যাজিক পরিণতিতে নতুন করে ওপার বাংলার বাঙালি হিন্দুদের অস্তিত্ব সংকট তীব্র আকার ধারণ করে,এপার বাংলার বাঙালি হিন্দুদের ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকারে দেশভাগ থেকে ছিন্নমূল শরণার্থী জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাকেও আবার ফিরিয়ে আনে। সেখানে বাংলাদেশে একেবারেই অভাবিত সরকার উৎখাতের পালাবদলে বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ অস্তিত্বই আজ ঘোরতর সন্দেহের, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিশ্বাসের ছবিটিই সেখানে অস্তমিত সূর্য। সেক্ষেত্রে এপার বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গৌরবও আজ অবিশ্বাসের বাতাবরণে পারস্পরিক সন্দেহের আধার হয়ে উঠেছে। সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেয়ে ধর্মীয় অস্তিত্বে শক্তি জাহির করার প্রবণতা স্বাভাবিক ভাবেই উগ্র মূর্তি লাভ করে।
এই রাজ্যে বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজাকে নিয়ে স্কুলে-কলেজে এতদিনের বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিবিড় পরিচয়ই আজ পূজা করতে না দেওয়ার বিদ্বেষে অভাবিত মৌলবাদের অশনি সংকেত খুঁজে পাওয়ার আতঙ্ক জেগে ওঠে। কলকাতার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী ল কলেজে হাইকোর্টের রায় গতকাল ২ ফেব্রুয়ারি পুলিশি ঘেরাটোপে সরস্বতী পূজার আয়োজনের মধ্যেই নিরাপত্তার অভাববোধে ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠে আরজি করের আন্দোলনের মতো We want Justice শ্লোগান শোনা যায়। তার দিনকয়েক আগেই নদিয়ার হরিণঘাটার একটি প্রাইমারি স্কুলে সরস্বতী পূজা করতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত হওয়ায় তা নিয়ে জনমানসে তীব্র হৈচৈ পড়ে যায়। সেখানে অস্বাভাবিক ঘটনায় প্রশাসনিক তৎপরতা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। পুলিশি বন্দোবস্তের সঙ্গে RAFও নামাতে হয়েছে পুজোর দিনে। তার মধ্যেই ব্রেকিং নিউজে জানা যায় নন্দীগ্রামের একটি কলেজেও পুলিশি নিরাপত্তায় সরস্বতী পূজা হচ্ছে। এ সবেই পুলিশের সহায়তায় সরস্বতী পুজোর আয়োজনের চূড়ান্ত বাধা বিপত্তিতে এপার বাংলার মৌলবাদী শক্তির পরিচয় অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই সামনে চলে আসে। অথচ তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলেও অদ্ভুত নীরবতা লক্ষ করা যায় ! এ তো আমাদের অচেনা বাংলা !
আসলে মানবিক পরিচয়কে অস্বীকার করে যখন মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ই তার অস্তিত্ব মনে হয়,তখন তাতে পারষ্পরিক ধর্মীয় বিদ্বেষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার ধর্মীয় চেতনায় উগ্র ধর্মান্ধতায় মৌলবাদী শক্তির আধিপত্য বিস্তার শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাংলাদেশে তারই সদ্য পরিচয়ে স্বাভাবিক ভাবেই এপার বাংলার বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেখানে প্রতিবেশী দেশকে আক্রমণ করাই দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠে,সেখানে অন্য ধর্মের বা বিধর্মীদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ অত্যন্ত স্বাভাবিক। আবার ধর্মীয় পরিচয় বড় হয়ে উঠলে ধর্মের ধ্বজাও প্রসারিত হয়। অন্যের ধর্মকে আঘাত করাতেও শক্তি প্রদর্শন থেকে আত্মজাহির আয়োজন সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওপার বাংলায় সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের ধর্মীয় পূজাদিতে বারবার আক্রমণের ধারাতেই তা প্রতীয়মান হয়ে চলেছে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত। অন্যদিকে এই বাংলায় ধর্মীয় বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিতে পারেনি। সেখানে বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তির জাগরণে এপার বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সহাবস্থান যে ব্যাহত হতে পারে,তার মনে করার জন্য কষ্ট কল্পনার প্রয়োজন পড়ে না। ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায় ?’ বিশ্বাসের বাতিঘর নিভে গেলে, শুধু অবিশ্বাস জেগে ওঠে না, তার সন্দেহ আতঙ্ক ছড়ায়।
শুধু তাই নয়, ধর্মীয় পরিচয়ই যখন একমাত্র হয়ে ওঠে,তখন ধর্মীয় ধ্বজা ধারণ করে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয়ে যায়, অন্য ধর্মের মানুষকে অস্বীকার করার প্রবণতায় তাদের ধর্মীয় পূজা-উৎসবকে বানচাল বা বন্ধ করায় নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করে। শুধু তাই নয়, সেখানে উগ্র ধর্মান্ধতায় সমাজ বা সংস্কৃতিবোধও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সরস্বতী পূজা তো শুধু হিন্দুদের পূজা হয়ে থাকে, তা বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনীষীর কথাও সেখানে অমান্য হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৮-এ ব্রাহ্মদের পরিচালিত সিটি কলেজে রবীন্দ্রনাথ সরস্বতী পুজো করা নিয়ে বিতর্কে বিপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। আজও সরস্বতী পুজো সগৌরবে চলেছে। সেখানে হিন্দুদের পূজা বলে নয়, বাঙালির সংস্কৃতিতেই তার বিস্তার। শিক্ষা সংস্কৃতির সঙ্গে সরস্বতী পূজাকে বাঙালি উৎসবে মিলিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে ধর্মীয় ধ্বজায় যখন একপক্ষ নিষেধাজ্ঞায় আত্মজাহিরে সক্রিয় হয়ে ওঠে, অন্যপক্ষও তার মধ্যে ধর্মীয় অস্তিত্ব বিপন্ন বলে জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখিয়ে পাল্টা পালে হাওয়া নেওয়ায় আত্মশক্তির জাগরণে প্রয়াসী হয়। শুধু তাই নয়, ধর্মীয় সংকট হাতিয়ার করে রাজনৈতিক সুবিধা লাভে ক্ষমতায়নের সুযোগ খোঁজে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদীর শক্তি প্রদর্শনী প্রতিযোগিতাই সময়ান্তরে সাম্প্রতিক দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে, ঝরে যেতে পারে অসংখ্য তাজা প্রাণ, নেমে আসতে পারে শ্মশানের শান্তি। তাতে অবশ্য আধিপত্যকামী মৌলবাদীদেরই লাভ। তাদের শুধু যেনতেন ভাবে ক্ষমতা ভোগ করাই লক্ষ্য। এজন্য তাদের কাছে যুদ্ধ মানেই ধর্মযুদ্ধ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে রসবতী সরস্বতীও বিদ্যাশিক্ষা ও সংস্কৃতির অস্ত্রে যুদ্ধ করার সামিল করেন। আসলে জীবন মানেই যুদ্ধ। এজন্য জীবনকে গড়ে তুলতেও জীবনযুদ্ধ জরুরি। সেই জীবনযুদ্ধের দেবী সরস্বতী আমাদের সহায়। সেখানে সাধনার সারদা সরস্বতী আমাদের জীবনযুদ্ধে এগিয়ে দেন। তাঁর হাতে কোনও অস্ত্র নেই,আছে সুরেলা বীণা। শ্বেতশুভ্র সরস্বতীর সঙ্গে সারস্বত সাধনার যোগ অত্যন্ত নিবিড়। শুধু তাই নয়, তাঁর বাহন রাজহাঁস আমাদের কাছে পরমহংস হয়ে ওঠে। জল থেকে দুধ আলাদা করে খেতে পারে এই রাজহাঁস। শিক্ষার লক্ষ্যেই থাকে বাছাইয়ের আভিজাত্য। ভালো মন্দ,আলো অন্ধকার, সৎ অসৎ প্রভৃতির মধ্যে বেছে চলার শিক্ষাও সরস্বতীর বাহনের মধ্যে প্রতীয়মান। শুধু তাই নয়, পলাশের মতো গন্ধহীন ফুলও দেবীর কৃপায় আভিজাত্য লাভ করে। প্রাকবসন্তে দেবী সরস্বতীর পুজোর মধ্যেই কচিকাঁচা থেকে তরুণ-তরুণীরা জীবনে বর্ণরঙিন বাসন্তিক আবহ খুঁজে পায় ,নতুন জীবনের পরশ লাভ করে।
এজন্য এই পূজা শিক্ষায়তনের পরিসর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাশোভন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। দিনচারেকের শারদোৎসবের পরে বাগদেবীর একদিনের পুজোতেও আয়োজনের ঘনঘটা, উৎসবমুখর বিস্তার। স্বাভাবিক ভাবেই তার প্রতি মৌলবাদীদের অস্তিত্ব জাহির অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের মৌলবাদী অভ্যুত্থানের প্রভাব যে সেক্ষেত্রে এপার বাংলার স্পর্শকাতর পরিসরে কোনওভাবে মাথাচাড়া দিতে পারে,তার পরিচয় গণমাধ্যমেই প্রকট হয়ে উঠেছে এবার। অসংখ্য বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য সর্বত্র যে ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রভাব বা যোগসূত্র নেই, দলীয় বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বর্তমান,তাও অনস্বীকার্য। কিন্তু তাতে মৌলবাদী চেতনার নিম্নমুখী চলনে উপরের সব ধারার জল একজায়গায় পড়ার মতো সব ঘটনাই একাধারে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে মিলে যায়। তার সুযোগ নিয়ে যাতে পালে হাওয়া লাগিয়ে তা পারস্পরিক ধর্মীয় অস্তিত্বের ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী লড়াইয়ে পরিণত না হয়,সেদিকে রাজ্য সরকারের সতর্ক দৃষ্টি ও সমূলে বিনাশে দল-মত,জাত-ধর্ম কিছু না দেখে কঠোর পদক্ষেপ একান্ত জরুরি। ভোটরাজনীতিতে তা না করলে তা অচিরেই হাতের বাইরে চলে যাবে, ওপার বাংলার মতো এপারেও বাঙালির পরিচয়ের চেয়ে হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মীয় অস্তিত্ব বড় হয়ে উঠবে। একটি সোনার বাংলা হারিয়েও আমরা এখনও মানুষ, মনেপ্রাণে বাঙালি।