• facebook
  • twitter
Wednesday, 20 August, 2025

জল এবং জীবনের জয়যাত্রা

সেই আদিমকাল থেকে মানুষের বিবর্তনের অগ্রগতি এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতি জল প্রবাহের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে এবং মানব সভ্যতা আজও একান্তভাবে জল নির্ভর।

প্রতীকী চিত্র

প্রমথরঞ্জন ভট্টাচার্য

জল ছাড়া এই পৃথিবীতে সম্ভব হত না জীবন, তাই জলের অপর নাম জীবন। জল ছাড়া এই পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই যা তুষ্ট করতে পারে সকল জীবকে। মানুষের সবচেয়ে পরিচিত এককোষী জীব (ব্যাকটেরিয়া) ইকোলাই–এর মধ্যে জলের পরিমাণ প্রায় ৭৪%। মানবদেহের বেশির ভাগই জল, পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরে জলের পরিমাণ প্রায় ৬০%। আমাদের মস্তিষ্কে জলের পরিমাণ প্রায় ৮৩% হৃদযন্ত্রে প্রায় ৭৯%, পেশীতে প্রায় ৭৫%, যকৃতে প্রায় ৮৫%, মূত্রাশয়ে প্রায় ৮৩%, ত্বকে ৬৪%, ফুসফুসে প্রায় ৮৩%, এমনকি আমাদের হাড়েও রয়েছে জল, প্রায় ৩১%। সুতরাং জল ছাড়া আমরা ভাবতে পারি না আমাদের জীবনকে। জল যে শুধু মানুষের জীবনধারণের জন্যই প্রয়োজনীয় তাই নয়, স্মরণাতীতকাল থেকে মানুষের এগিয়ে চলার পথের দিশারি হয়েছে জল।
‘মানুষের জন্য জল চাই, অমৃত নয়। অমৃতে তৃষ্ণা মেটে না।’ জল যে শুধু মানুষের তৃষ্ণা নিবারন করে তাই নয়, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্তরকমের জৈবিক ও প্রাণরাসায়নিক (বায়োকেমিক্যাল) ক্রিয়াকর্মের জন্যও জল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর মানুষের ‘তৃষ্ণার শান্তি’ এই জল তাঁর বিবর্তন (এভোলিউশন), ক্রমোন্নতি ও ক্রমবিকাশের মূলে। মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর এই জল, মানুষের ক্রমবিকাশের পথ প্রদর্শক হয়েছিল। মানুষের বিবর্তনকে সম্ভব এবং সার্থক করে তুলেছিল জল এবং বিবর্তন মানুষকে তৃষ্ণার্ত করে তুলেছিল এবং পিপাসার্ত হতে শিখিয়েছিল।

বিবর্তনই জীবকে তৃষ্ণার্ত হতে শিখিয়েছিল, পিপাসার্ত করেছিল। মানুষের তৃষ্ণার মূলে বিবর্তনজনিত কারণ। আমরা, মানবেরা, অনেকদিক থেকেই খুবই রহস্যময়। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় রহস্য হল অত্যন্ত আবশ্যিকভাবে এবং শারীরিকক্রিয়াসংক্রান্ত ব্যাপারে আমরা সিক্ত (আৰ্দ্ৰীকৃত) না থেকে একদমই পারি না। জল আমাদের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

বিবর্তনের পথে মানুষের অগ্রগতির মূলে এবং মানুষের ইতিহাস কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূলে জল এক অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি (ড্রাইভিং ফোর্স)। বাস্তবিকপক্ষে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূলে জল।

জলের বিশেষ ধর্ম এবং বৈশিষ্ট্য
অপূর্ব গুণে, রহস্যে এবং বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে গঠিত জল প্রকৃতির এক আশ্চর্য এবং অতুলনীয় সম্পদ যা জীবন, জীব এবং সভ্যতার বিকাশকে সম্ভব এবং সার্থক করে তুলেছে। জীব, জীবন এবং সভ্যতা গড়ে উঠেছে জলকে অবলম্বন করে সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে।

তাই পৃথিবীতে জীবনের জন্য জল অপরিহার্য… এবং সম্ভবত মহাবিশ্বের বাকী অংশের জন্য আমরা যখন আমাদের বিশ্বের বাইরে মহাবিশ্বের অন্য গ্রহে প্রাণের সন্ধান করি, তখন আমরা গ্রহগুলির মধ্যে তরল জলের সন্ধান করি। জল এবং বিশেষত তরল জল, জীবনের সৃষ্টি এবং ভরণপোষণের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় যে খুব কম বিজ্ঞানীই এটি ছাড়া পৃথিবীতে বিদ্যমান জীবনের সম্ভাবনাকে স্বীকার করেন।

নাসার মত সংস্থাগুলির দ্বারা বহির্জাগতিক জীবনের অনুসন্ধান প্রায়শই একটি সহজ কৌশলের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে… জল অনুসন্ধান করুন।

তাহলে জল এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কারণ রয়েছে, তবে সেগুলি সবই জলের অন্যান্য রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। এইচ টু ও নামে পরিচিত রাসায়নিক পদার্থ দুটি ছোট ধনাত্মক তড়িতাধানযুক্ত হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি বড় ঋণাত্মক তড়িতাধানযুক্ত অক্সিজেন পরমানু দ্বারা গঠিত একটি সাধারণ অনু। এটি অনেক অনুর ধর্ম এবং পদার্থের নিজেরই একটি বৈশিষ্ট্য (জড় গ্যাস বা ইনার্ট গ্যাসগুলো ছাড়া) যাকে বলা হয় “পোলারিটি” বা “প্রান্তিকতা” (বৈদ্যুতিক ধণাত্মকতা বা ঋণাত্মকতার দুই বিপরীত মেরুত্ব) । এবং এই পোলারিটির ফলে জলের একটি অনু অপর অনুকে আকর্ষণ করে এবং একে অপরের সাথে লেগে থাকে এবং তরল পদার্থের আকার ধারণ করে। তবে তার অর্থ এই নয় যে জল অন্যান্য তড়িতাধানযুক্ত উপাদানগুলির সাথে পরস্পর বিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া (ইন্টারঅ্যাকশন) করে। প্রায়শই তাদের বিচ্ছিন্ন করতে এবং দ্রবীভূত করতে সহায়তাকরে।
আমাদের শরীরে যে হাজারো রকমের প্রাণরাসায়নিক ক্রিয়াবিক্রিয়া ঘটে চলেছে খুব নিপুণ দক্ষতা এবং কুশলতার সাথে, তার জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট অনুদের পরস্পরের সাথে সহজে এবং মুক্তভাবে মিশ্রণ– তাদের কোন পদার্থে পরিপূর্ণভাবে দ্রবীভূত হওয়া । জল এমন একটি পদার্থ যা সহজেই অনেক পদার্থকে সুন্দরভাবে দ্রবীভূত করতে সক্ষম -যার ফলে জল-কে বলা হয় ‘সর্বজনীন দ্রবণ বা ইউনিভারশ্যাল সলভেন্ট’। যদিও আরও অনেক পদার্থের জলের মত দ্রবণ ক্ষমতা আছে কিন্তু তাদের উপযুক্ত রাসায়নিক স্থিতিশীলতা নেই এবং তারা অম্ল এবং ক্ষারকে প্রশমিত করতে বা নিরপেক্ষ (নিউট্রিলাইজ) করতে সক্ষম হয় না । জলের পোলারিটি খুব সূক্ষ এবং জটিল ঝিল্লি (মেমব্রেন) গঠনে সহায়তা করে যা প্রত্যেক জীবিত কোষকে আবদ্ধ অবস্থায় (এনক্যাপসুলেটেড)ধরে রাখতে সক্ষম হয়। জলীয় ঝিল্লিতে বিশেষ স্নেহপদার্থ (লিপিড) সাড়ি সাড়ি সজ্জিত থাকে জলের স্নেহপদার্থ প্রিয়(লিপোফিলিক) প্রান্তের দিকে এবং তারা বহির্মূখী অবস্থায় সজ্জিত থাকে সাড়ি দিয়ে এবং জলের স্নেহপদার্থ বিরূপ(লিপোফোবিক) প্রান্তগুলো অন্তর্মুখী অবস্থায় সাড়ি দিয়ে সজ্জিত থাকে ফলে একটি অবিরাম এবং নমনীয় দ্বিস্তরীয় পাতলা পর্দা (ফিল্ম) উৎপন্ন রপে যা নাকি অনেকটা সাবানের বুদবুদের বহিরাবরণের মত। এই স্নেহপদার্থ সমন্বিত ঝিল্লি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ করে জীবদেহে এবং কোষে। কোষে কেন্দ্রীভূত জীবনের জটিলতা বজায় রাখা এবং কেন্দ্রীভূত অংশগুলোর স্বকীয়তা এবং তাদের নিজস্ব প্রানরাসায়নিক ধর্ম এবং ক্রিয়াবিক্রিয়ার যথাযথ সক্ষমতা ও স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা এবং একটিকে অপরটির থেকে পৃথকভাবে রেখে এবং কোষে তাদের পরিবেশের মধ্যে পৃথকভাবে রেখে তাদের কার্যকারিতা পরিপূর্ণভাবে বজায় রাখতে সাফল্যের সঙ্গে সক্ষম হওয়া খুবই গুরুত্বপুর্ণ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মৌলিক ক্রিয়াকর্মবিশেষ যা কোষের পক্ষে এবং জীবদেহের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যক অংশ। জলের ধর্ম অণুগুলোর একে অপরের সংযুক্ত থাকা যা নাকি জলকে আরেকটি বৈশিষ্ট্য প্রদান করে অর্থাৎ সংহতি বা কোহেশন। যার মানে জল খুব সূক্ষ নলের মধ্য দিয়ে বেয়ে উঠতে পারে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানের বিরোধিতা সত্বেও। যার ফলে জল মাটি থেকে কয়েকশ ফুট উঁচু পৰ্য্যন্ত গাছের উপরে উঠতে পারে। ফলত, জল পরিপোষক পদার্থসমূহ (নিউট্রিয়েন্টস) পরিবহন করতে, পরিশোধন কার্যে. এবং কোষের বিভিন্ন উপাদান সমূহের পরিকাঠামোর বিন্যাস গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।

তাছাড়াও, জল সালোকসংশ্লেষে (ফটোসিনথেসিস) সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করে যার ফলে উদ্ভিদেরা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারে। সুতরাং এখনও পর্য্যন্ত আমাদের জানা এমন কোন তরল পদার্থ নেই যা জীবনের ক্ষেত্রে জলের বিকল্প হতে পারে।

জলের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যক্ত করতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী জীববিজ্ঞানী অ্যালবার্ট ভন সেন্ট-জর্জি বর্ননা করেছেন-
জল হ’ল জীবনের ‘ম্যাট্রিক্স, মাদার এন্ড মিডিয়াম’। তাছাড়াও বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক এবং পদার্থবিদ ফিলিপ বল জীববিদ্যায় লিখেছেন, ‘ইউ ক্যুড বী ফরগিভেন ফর কনক্‌লুডিং দ্যাট দ্য সাবজেক্ট ইজ অল অ্যাবাউট প্রোটিনস, অ্যান্ড জিনস, এমবডিড ইন ডি এন এ। বাট দিস ইজ ওনলি অ্যা ফর্ম অফ শর্টহ্যান্ড ; ফর ব্যায়োলজি ইজ রিঅ্যালি অল অ্যাবাউট দ্য ইন্টারঅ্যাকশনস অফ সাচ মলিক্যুউলস ইন অ্যান্ড উইথ ওয়াটার’। সুতরাং জীবনের সবকিছুর মূলে জিন, প্রোটিন প্রভৃতি পদার্থের সাথে জলের পারস্পরিক ক্রিয়াবিক্রিয়া অর্থাৎ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে জল যা নাকি জীবনের পক্ষে অপরিহার্য।

জল কেন জীবনের পক্ষে অপরিহার্য
বিজ্ঞানীরা যখন অন্য গ্রহে জীবনের অনুসন্ধান করেন তখন তাঁরা খুঁজে দেখেন সেই গ্রহে জলের অস্তিত্ব আছে কিনা ? কেননা এখন পর্য্যন্ত আমাদের ধারণায় এমন কোন জীব পাওয়া যায়নি যে বা যারা জল ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে । যদিও কিছু জীব আছে যারা অন্যান্যদের থেকে কম পরিমান জলের সাহায্যে জীবনধারণ করতে সক্ষম যেমন, সাইয়ানোব্যাকটেরিয়া ক্রুকোসিডিওপসিস । এটি এত অল্প পরিমান জলের সাহায্যে বেঁচে থাকতে সক্ষম, যে বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি মঙ্গল গ্রহের শুষ্ক পৃষ্ঠদেশে বেঁচে থাকতে সক্ষম। সুতরাং, এই সহজ, সরল জীবটি থেকে শুরু করে জীব জগতের অত্যন্ত জটিল উদ্ভিদ এবং প্রাণী সমূহের জীবনধারণ নির্ভর করে জলের উপর। মানুষের ক্ষেত্রে জল দ্রবণ হিসাবে ছাড়াও সরবরাহ কার্যক্রমের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। জল খাদ্য সামগ্রী থেকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং পুষ্টি সামগ্রী বা পরিপোষক পদার্থ দ্রবীভূত করে বিভিন্ন কোষে তা সরবরাহ করে এবং জীবের পুষ্টি, বৃদ্ধি, উন্নতি এবং বেঁচে থাকার পক্ষে তা আবশ্যক হয়।তাছাড়াও আমাদের শরীরের বিভিন্ন দূষিত পদার্থ নিষ্ক্রমনের জন্য, শরীরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখার জন্য এবং আমাদের বিপাক ক্রিয়ায় (মেটাবলিজম) সাহায্য করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন হয়। তাই আমাদের শরীরের প্রায় ৬০% জল এবং জল ছাড়া আমরা কয়েক দিনের বেশী বেঁচে থাকতে পারি না। জল আমাদের জীবনের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হওয়া ছাড়াও, অন্যান্য বিভিন্ন ভাবে জল আমাদের বেঁচে থাকাকে সহায়তা করে। জল ছাড়া, আমরা শস্য উৎপাদন করতে পারিনা, জীবজন্তু পুষতে পারি না, আমাদের শরীর, খাদ্য সামগ্রী, পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে পারি না। সভ্যতার অগ্রগতিতেও জলের অবদান আসামান্য। পরিবহনের জন্য জল সমগ্র বিশ্বে একটি প্রয়োজনীয় মাধ্যম এবং কল কারখানা প্রভৃতিতে শক্তির প্রয়োজনে জল একান্ত আবশ্যক। যেহেতু জল বাস্পাকারে থাকতে সক্ষম, তাই আবহাওয়ায় মজুত থেকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বৃষ্টির মাধ্যমে জল সরবরাহ করা থেকে, চাষ আবাদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর সমুদ্রগুলো সমস্ত পৃথিবীর জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

গরমের সময় তাপ শোষণ করে এবং শীতের সময় তাপ মুক্ত করে, পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে । এবং জীবজগতের অগণিত সদস্যরা এই সমুদ্রের বাসিন্দা।

জল এবং জীবনের উদ্ভব
জীবনের উৎস কি? বিজ্ঞানীদের আগে ধারণা ছিল যে জীবনের উৎপত্তির আদিম স্থান আবদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে ‘আদিম স্যুপ বা প্রিমরডিয়াল স্যুপ’। পরে বিজ্ঞানীদের ধারণা পালটায় এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন বিশ্বে প্রাণের প্রথম স্পন্দন জাগে গভীর সমুদ্রের জলতাপ কুণ্ডে (হাইড্রোথারমাল ভেন্ট)-দের মধ্যে। কিন্তু এই ধারণার সমর্থনে বিজ্ঞানীরা আজও পরীক্ষাগারে সেই অবস্থার অনুরূপ অবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে সৃষ্টি করতে পারেন নি। এমনকি সমুদ্রের জলের মত অনুরূপ অবস্থায় তাঁরা সহজ, সরল কোন কোষের ঝিল্লি (সেল মেমব্রেন) ও তৈরি করতে সমর্থ হন নি, যা জীবিত প্রাণীর সৃষ্টির পক্ষে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীরা যে সব উপাদান ব্যবহার করেছিলেন তা কোষ-ঝিল্লি তৈরির পক্ষে যথেষ্ট এবং উপযুক্ত ছিল না বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা, যারা প্রাণের সৃষ্টির জন্য হাইড্রোথারম্যাল ভেন্ট উপযুক্ত বলে বিশ্বাস করেন তাদের মতে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে সঠিক উপাদানের সমন্বয়ে সামুদ্রিক ভেন্টের অবস্থাই অবশ্য প্রয়োজনীয় কোষ-ঝিল্লি উৎপাদনের জন্য এবং তাঁরা এই মতবাদে গভীরভাবে আস্থা পোষণ করেন।

অনেকেই মনে করেন পৃথিবীর অবস্থা আজ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে হেডেনের মত এমন নারকীয় অবস্থা ছিল না । লাভার সমুদ্র, অগণিত আগ্নেয়গিরি, ঠিক এমন অবস্থা ছিল না যদিও তাদের অস্তিত্ব ছিল। তার পরিবর্তে অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা আদিম বিশ্বের সামুদ্রিক জলে ঘেরা ছোট ছোট পাথুরে পৃষ্ঠতল। তবে আমরা আজকের যে সমুদ্রকে জানি তার মত নয় । সেই সমুদ্র ছিল অনেক উত্তপ্ত, অনেক পরিমাণে আম্লিক এবং লৌহ উপাদানে সমৃদ্ধ। আবহাওয়া ছিল অধিকাংশে নাইট্রোজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড সমৃদ্ধ কিন্তু অক্সিজেন ব্যতীত।এবং কোথাও প্রাণের কোন স্পন্দন ছিল না, কিন্তু সমুদ্রের অতল গভীরে সৃষ্টির এক প্রয়াস চলছিল।

সমুদ্রতল থেকে উঠে আসা উত্তপ্ত রাসায়নিক পদার্থ, হাইড্রোজেন এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড এর মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটনে সক্ষম হয়েছিল ফলে সাধারণ এবং সরল জৈব পদার্থের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল । এই জৈব পদার্থগুলোর পারস্পরিক বিক্রিয়ার ফলে জটিল অনেক পদার্থের সৃষ্টি হয়েছিল। এই জটিল পদার্থগুলো ক্রমশ আবদ্ধ হয়ে উৎপন্ন করে জীব কোষের সাধারণ ঝিল্লি এবং ক্রমশ আরও জটিল পদার্থের সূচনা করে এবং যে সকল পদার্থ সংবাদ পরিবহনে সক্ষম সেইসব জটিল পদার্থের সৃষ্টি হয় এবং পরিনামে ডি এন এ (ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লেয়িক অ্যাসিড) এর উৎপত্তি হয়। এই প্রথম জীবিত কোষ যারা বৃদ্ধি, বিভাজন এবং উদ্ভবে সক্ষম হয়েছিল ।

হয়ত এইভাবেই পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন জেগেছিল এবং জীবনের সূচনা সম্ভব হয়েছিল। যদিও প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। ঠিক কোথায়, কখন, কিভাবে জীবনের উদ্ভব হয়েছিল অর্থাৎ জলতাপ কুণ্ডে, বরফের চাদরের মধ্যে, নাকি বহির্বিশ্বে তা নিয়ে এখনও অনেক মতদ্বৈধ রয়েছে। এর মধ্যে কোন পদ্ধতিটির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী এবং কোনটি সবচেয়ে অনুকূল প্রাণের সৃষ্টির পক্ষে তা স্থির করার জন্য বিজ্ঞানীরা জীবনের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো পরীক্ষাগারে সেইসব অবস্থায় সৃষ্টি করা সম্ভব কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছেন। এবং একটি সর্বজনীন সিদ্ধান্তে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই সম্ভাবনা দূর অস্ত। জীবন আসলে কি –তা নিয়ে অনেক মত পার্থক্য আছে, কিন্তু একটা বিষয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায় একমত সৃষ্টির প্রথম জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কোষ ঝিল্লি বা সেল মেমব্রেন। কোষের ঝিল্লি সাধারণত ফসপোলিপিড (লিপিড বা স্নেহ পদার্থের ফসফেট যৌগ) যা নাকি গঠিত সাধারণ ফ্যাটি অ্যাসিড দ্বারা, আইসোপ্রেনয়ডেস (হাইড্রোজেন এবং কার্বন ঘটিত যৌগ) এবং শর্করা দিয়ে। ফসপোলিপিডস কেবলমাত্র জীবিতপ্রাণীদের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব। যদিও ফ্যাটি অ্যাসিড পরীক্ষাগারে তৈরী করা সম্ভব শিলাখণ্ড (রকস) এবং জলের মধ্যে বিক্রিয়ার সাহায্যে এবং আইসোপ্রেনয়েডস এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলোও পরীক্ষাগারে তৈরী করা সম্ভব এই পদ্ধতিতে।

এই সাধারণ যৌগগুলো কোষের ঝিল্লির কাঠামো অর্থাৎ স্ফোটক (ভেসিক্যলস) তৈরি করে যা নাকি কোষসদৃশ এই অর্থে যা তারা দ্বিস্তরীয় ঝিল্লি উৎপন্ন করতে সক্ষম যা নাকি জলকে আবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম । বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই স্ফোটকেরা ঝিল্লির অনুরূপ অনেক কার্য সম্পন্ন করতে সক্ষম। তাই বিজ্ঞানীদের ধারনা যে স্ফোটকরাই সম্ভবত আদিতে প্রথম জীব কোষের ঝিল্লি হিসাবে উৎপন্ন হয়েছিল এবং তাদের আখ্যা দেওয়া হয় ‘আদিম কোষ বা প্রোটোসেলস’।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেন যে এই প্রোটোসেল-রা জীবকোষের মত অনেক কাজই করতে সক্ষম যেমন তাদের জলে উৎপন্ন করা সম্ভব, তারা জল এবং জলীয় পদার্থকে আবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম, তাছাড়াও অনেক জৈব পদার্থ এবং ডি এন এ-র মত পদার্থ যেমন আর এন এ (রাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড) প্রভৃতি তাদের মধ্যে উৎপন্ন করা সম্ভব। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এই প্রোটোসেল-রা লবনাক্ত বা লবন জাতীয় কোন কিছু সহ্য করতে পরে না।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা ম্যাগনেসিয়াম বা ক্যালসিয়াম প্রভৃতি লবণের দ্রবণে এই আদিম কোষ বা প্রোটো সেল তৈরী করা সম্ভব নয়। অথচ সমুদ্র জলে এইসব লবণের অস্তিত্ব পর্যাপ্ত পরিমাণে। এই ঘটনা সমুদ্রে জীবনের সৃষ্টির মতবাদের বিরুদ্ধস্বরূপ।

তাই প্রাণের উৎস এবং উদ্ভব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও সঠিক কোন মতবাদের বশবর্তি নন । তাদের মধ্যে মতদ্বৈধতা আছে। তবে জল যে জীবনের পক্ষে অত্যন্ত আবশ্যক তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন মত পার্থক্য নেই ৷
জল এবং মানুষের বিবর্তন

আজ থেকে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছর আগে, মানুষ দুপায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটতে শেখে, মানুষের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটে, মানুষের খাদ্যনালী হ্রাসপ্রাপ্ত হয় । আমাদের সেই আদিম পূর্বপুরুষ, হোমো ইরেক্টাস, ছোট খাটো অস্ত্র ব্যবহার করতে জানত এবং শিকার করতে পারত । তাদের খাদ্যসামগ্রী মূলত মাংস-ভিত্তিক ছিল, উদ্ভিজ-ভিত্তিক খাদ্যের চাইতে। ফলে মানুষের শরীরে শক্তির যোগান বৃদ্ধি পেল, কারণ উদ্ভিজ-জাত খাদ্যের চাইতে প্রাণী-জাত খাদ্যের ক্যালরি বেশী। মানুষ বৃক্ষাচারী থেকে স্থল-বাসী হয়ে উঠল। গাছে গাছে খাদ্যের সন্ধানে মানুষের অনেক সময় লাগত, কিন্তু মানুষ শিকারজীবী হওয়ার ফলে অনেক দূরদূরান্ত পরিক্রমা করে শিকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। সোজা হয়ে হাঁটা এবং মাংসাশী হওয়ার ফলে এটা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। মানুষের এই রূপান্তরের ফলে, যা খুবই সফল হয়ে উঠেছিল মানুষের বিবর্তনের পক্ষে, আমরা আধুনিক মানুষেরা যারা হোমো ইরেক্টাসদের বংশধর এবং উত্তরসূরি তারা বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে পৌঁছতে এবং উপনিবেশ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই সারা বিশ্ব জুড়ে আজ মানুষ। বিজ্ঞানী রিচার্ড র্যাং হামের মতে রান্না করতে শেখার ফলে আদিম বনমানুষেরা মানুষে রূপান্তরিত হতে সক্ষম হয়েছিল। কাঁচা মাংস হজম করা খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। রাঁধতে শেখার ফলে খাবারের খাদ্যগুণের এবং পুষ্টিগুণের বৃদ্ধি ঘটে। ফলে মানুষের শক্তি এবং কর্মতৎপরতার বৃদ্ধি ঘটে। হোমো ইরেক্টাসেরা প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছর আগে আগুনের সাহায্যে রান্না করা শিখতে সক্ষম হয়েছিল। এই উন্নতির ফলে বিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা অগ্রগতির জোয়ার আসে যার ফলে আজকের আধুনিক মানুষের এই পরাক্রম এবং কর্তৃত্ব।

অন্য একজন বিজ্ঞানী, প্রাণীবিদ এবং নৃতত্ত্ববিদ, ক্লাইভ ফিনলেসন, মানুষের ৭ মিলিয়ন বছর ব্যাপী বিবর্তনের অগ্রগতির ধারা এবং উন্নতির ধারাকে ব্যাখ্যা করেছেন অন্য এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাঁর মতে খাদ্য নয়, আসলে জল, মানুষের এই উন্নতি ও অগ্রগতির মূলে। তাঁর মতানুযায়ী হোমো সেপিয়েন্সদের বিশ্বব্যাপী বিস্তারের মূলে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং মিষ্টিজলের অনুসন্ধান। আদিম মানুষ মিষ্টি জলের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের বিবর্তনের অগ্রগতি এবং সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়। তিনি মানুষের উন্নতি এবং সভ্যতার অগ্রগতি ও বিকাশের মূলে প্রধানত জল বলেই ধারনা করেন ।

আদিম মানুষ, প্রধানত উষ্ণঅঞ্চলের জঙ্গলবিস্তীর্ন এলাকা ছেড়ে উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে অগ্রসর হতে থাকে, পরে আরও সাহসিকতার সাথে তারা উন্মুক্ত প্রান্তরে বসবাসের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে এবং নিজেদের সেইভাবে তৈরি করে নেয়। এই আদিম মানুষেরা বনপ্রান্তর এবং নদী ও হ্রদের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাস করতে শুরু করে। এবং ধীরে ধীরে তারা গাছগাছালি ছেড়ে গুহার ভিতরে বসবাস করতে প্রবৃত্ত হয়।

ইতিমধ্যে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে । মধ্য প্লাইস্টসিন যুগে, যার শুরু হয় প্রায় ৮ লক্ষ বছর আগে, পর পর উষ্ণ এবং শীতলচক্রের ঘটনা ঘটতে থাকে এবং ভীষণ খরা এবং শৈত্য প্রবাহের (তুষার যুগ) ঘটনা ঘটতে থাকে। ফলে সাভানা প্রান্তর এবং মরুভূমির সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ জলের সন্ধানে আরও ছড়িয়ে পড়ে। বিবর্তনের ফলে, মানুষের এই কঠিন সময়ে বাহু লম্বা হতে শুরু করে, শরীরের ওজন হ্রাস পায় এবং মানুষ আরও কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। এই আদিম মানুষেরা যারা অপেক্ষাকৃত লম্বা, হালকা এবং দ্রুত পদক্ষেপে সমর্থ হয়ে ওঠে তারা বেশীমাত্রায় জল এবং খাদ্য খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনার পক্ষে উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বিজ্ঞানী ফিনলেসনের মতে, ‘হোমো সেপিয়েন্স ওয়াজ অ্যান এভোলিউশনারী রেসপন্স টু দ্য স্ক্যাটার্ড ডিস্ট্রিবিউশন অব ওয়াটার ইন স্পেস অ্যান্ড টাইম…। ইম্প্রুভড টেরেস্ট্রিয়াল মোবিলিটি ওয়াজ অ্যা রেসপন্স, ফার্স্ট অ্যান্ড ফরমোস্ট • টু দ্য নীড টু কুইকলি লোকেট ওয়াটার সোর্সেস ইন অ্যা ড্রাইং ওয়ার্ল্ড।’ মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে একটা প্রশ্ন সবাইকে নাড়া দিয়েছে যে মানুষ অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় এত প্রভাবশালী এবং কর্তৃত্ত্বশালী হয়ে উঠল কি করে? গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেনফরেস্টের বসবাস ছেড়ে ক্রমে সাভানার উন্মুক্ত প্রান্তরে বসবাস করতে শুরু করল এবং ক্রমে ক্রমে সমগ্র বিশ্বকে তুলল। এক কথায় মানুষ অন্যান্যদের থেকে অনন্য হয়ে উঠল কি ভাবে?

বিজ্ঞান এর অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছে, মানুষের বৃহৎ মস্তিস্ক, দুপায়ে ভর দিয়ে দ্রুত হাঁটার সক্ষমতা, জটিল অস্ত্রসস্ত্র পাথরের, কাঠের, হাড়ের বা লোহার প্রভৃতি নির্মাণে দক্ষতা মানুষকে অন্যান্য প্রাইমেটদের থেকে জীবনযুদ্ধে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এইসব ছাড়াও মানুষের জলকে ধরে রাখার ক্ষমতার বিকাশ এবং জলকে কাজে লাগানোর অপুর্ব প্রয়াস মানুষের সার্বিক উন্নতির মূলে। মানুষের কাছে জলই জীবন। আমাদের শরীরের প্রায় ৬০% জল এবং প্রতিদিন আমাদের প্রয়োজন অন্তত ২ থেকে ৩ লিটার জল পান করা, আমাদের ঘাম, প্রস্রাব এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে যে জল শরীর থেকে নির্গত হয়ে যায় তা পরিপূরণ করার জন্য তানাহলে আমরা জলশূন্যতায়(ডিহাইড্রেশন) ভূগব।

তবুও বিজ্ঞানীদের ধারনা যে প্রাইমেটদের তুলনায় আমরা অর্থাৎ মানুষেরা কমপক্ষে ৩০-৫০% জল কম ব্যবহার করি প্রতিদিন আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের তুলনায়। বিজ্ঞানীদের মতে জলকে ধরে রাখার বা জল সংরক্ষণ করার যে পদ্ধতি আদিম মানুষেরা উদ্ভব করেছিল তার ফলে মানুষের প্রভূত সুবিধা হয়েছিল। জলাধার এবং জলের উৎসকে ছাড়িয়েও তাঁরা খাদ্যান্বেষনে বহুদূর যেতে সক্ষম হ’ত। জলের জন্য তাদের অতটা চিন্তা করতে হত না ফলে জীবনযাত্রায় অনেক সুবিধা হয়েছিল এবং সহজ হয়েছিল।

বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী হেরম্যান পন্তযার এর মতে ‘ইভন জাস্ট বিয়িং এবল টু গো অ্যা লিটল বিট লঙ্গার উইদাউট ওয়াটার উড হ্যাভ বীন অ্যা বিগ অ্যাডভানটেজ অ্যাজ আরলি হিউম্যানস স্টারটেড মেকিং অ্যা লিভিং ইন ড্রাই, সাভানা ল্যাণ্ডস্কেপস।’

জল এবং সভ্যতা সুদূর অতীতে, নোমাডিক মানুষের জলের প্রয়োজন হতো পান করার জন্য, তারা বন্যা ও প্লাবনকে ভয় পেত এবং জলাশয়কে ব্যবহার করত মাছ ধরা এবং শিকার করার জন্য। তারপর মানুষ যখন চাষবাষ করতে শিখল, বসে কাজ করতে (সীডেন্টারী) শিখল, বড় বড় নদীর তীরে বসবাস করতে শুরু করল তখন সে কূপ খনন করতে শিখল, জমি চষতে শিখল এবং মজুত শস্য সুরক্ষার জন্য শস্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে শিখল, বন্যা, প্লাবন প্রভৃতির হাত থেকে শস্য ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য। এর জন্য প্রয়োজন হল গোষ্ঠীবদ্ধ এবং সমাজবদ্ধ হওয়া। মানুষ ক্রমে ক্রমে তাই হল। শুরু হল সভ্যতার পথে দৃঢ় এবং দ্রুত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

সেই আদিমকালে মানুষ জলপথে পরিভ্রমণের জন্য ন্যাভিগেশন ব্যবহার শিখল, চাষআবাদে জলের প্রয়োজনে কাঠের জলচক্র তৈরি করতে শিখল এবং মাছ ধরার কৌশল আয়ত্ব করল।

আদিমকালে মানুষ জল কল (ওয়াটার মিল) তৈরি করেছিল গম পেষাইয়ের জন্য, জল নিকাশের সবন্দোবস্ত করেছিল এবং জল পরিবহনের জন্য নল তৈরি করেছিল। তারা জলের সুবন্দোবস্ত করেছিল এবং পূজা অর্চনার জন্য জলাধার প্রস্তুত করেছিল। চিন, গ্রীক সভ্যতায় এবং রোমান সভ্যতায় এইসব জলাধারের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতির মূলে জল। জলবিদ্যুৎ আজকের দিনে বিদ্যুতের এক প্রধান উৎস। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যত নগরী ও মহানগরী গড়ে উঠেছে তা সবই নদীর তীরে এবং নদী আশ্রিত।

সেই আদিমকাল থেকে মানুষের বিবর্তনের অগ্রগতি এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতি জল প্রবাহের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে এবং মানব সভ্যতা আজও একান্তভাবে জল নির্ভর। এবং জল ও জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।