সুবীর পাল
সেকি, এক ভদ্রলোক বাড়ির সামনের সুইমিং পুলে নামলেন। আবার ঘরের ছাদ থেকেও ঝাঁপ দিলেন। এক ব্যক্তি অথচ একই সময়ে দুই জায়গায় দুই রকমের ঘটনায় লিপ্ত হলেন!
এমনটা জানতে পেরে এসিপি প্রদ্যুমান ভাবগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, ‘আপাতত দৃষ্টিতে এটা টেলিপোর্টেশন মনে হচ্ছে অভিজিৎ। কিন্তু তাই বলে মানুষের দ্বারা টেলিপোর্টেশন কখনই সম্ভব নয়।’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত মানুষের টেলিপোর্টেশন সমর্থন করেনি। কুছ তো গড়বড় হ্যায় দয়া।’
এই পুরো সিকোয়েন্সটা কিন্তু জনপ্রিয় হিন্দি টিভি সিরিয়াল ‘সিআইডি’র একটি পর্বে সম্প্রচার করা হয়েছিল। আসলে ওই অভিনব ধারাবাহিকটি ছিল ‘টেলিপোর্টেশন’ কেন্দ্রিক।
এই টেলিপোর্টেশন নির্ভর টিভি সিরিয়াল কিন্তু আমাদের দেশে আরও বহুল পর্যায়ে প্রচারিত করা হয়েছিল। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘শক্তিমান।’ এখানে গঙ্গাধর ও শক্তিমান দুটো চরিত্রই কিন্তু আগাগোড়া টেলিপোর্টেশন উপাদানে চুড়ান্ত ভাবে ভরপুর। যা অভিনেতা মুখেশ খান্না অত্যন্ত সার্থকভাবে টিভি পর্দায় আপাদমস্তক ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর টেলিপোর্টেশন চরিত্রের জন্য পরিহিত বিশেষ ড্রেস একদা এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে তদানীন্তন সময়ের কিশোর কিশোরীরা ওই অনুকরনীয় পোশাক নিজেরা পরতে গর্ব অনুভব করতো। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য তৈরি অ্যানিমেশন টিভি সিরিয়াল ‘ডোরিমন’ তো পরতে পরতে নিখুঁত টেলিপোর্টেশনে ঠাসা।
টিভির ছোট পর্দার পাশাপাশি ২০১৬ সালে রিলিজ হওয়া সিনেমার বড় পর্দায় ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’ ফিল্মটি দর্শকদের যথেষ্ট মন কেড়েছিল। এতেও টেলিপোর্টেশনকে মিশেল করা হয়েছিল ইন্দ্রজালের অঙ্গ হিসেবে। তবে কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে এর প্রথম প্রয়োগ ঘটে ১৮৭৭ সালে। বইটির নাম ‘দি ম্যান উইদাউট এ বডি,’ যার লেখক ছিলেন এডওয়ার্ড পেজ মিচেল। সম্ভবতঃ এটিই টেলিপোর্টেশন সম্পর্কিত পৃথিবীর প্রথম প্রকাশিত বই।
অবশ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্র সহ টিভি সিরিয়ালগুলিতে টেলিপোর্টেশন চরিত্রের বরাতে যতই জনমানসে খ্যাতি তুঙ্গস্পর্শী হোক না কেন, বাস্তব জীবনে মানুষের চরিত্রের সঙ্গে টেলিপোর্টেশনের অবস্থান হলো জল আর তেলের মতো। কিছুতেই মিলমিশ হতে পারে না। অনন্ত এ’প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাপী সিংহভাগ বিজ্ঞানীদের এমনই সর্বশেষ নিদান। তাঁদের মতে, আক্ষরিক অর্থে কোনও বস্তু বা কোনও শক্তি চোখের নিমেষে এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করাকে টেলিপোর্টেশন বলে। ইতিমধ্যেই পদার্থের কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। তাঁদের মতে, এক বস্তুর পরমানু অন্য কনা কাঠামোয় স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে ইতিমধ্যে। ২০০৩ সালে পদার্থের কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের সফলতা মেলে যখন একটি বস্তু কনার মৌলিক কোয়ান্টাম উপাদান তড়িৎ গতিতে স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল অন্য বস্তুর পরমানুতে। তবে এক্ষেত্রে বস্তুর অবয়বের স্থানান্তর হয়নি।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় কোনও মানুষ বা প্রাণির গঠনতন্ত্র পুরোপুরি জটিল থেকে জটিলতর জৈবিক রসদে পরিপূর্ণ। বস্তুবাদ ও জৈববাদ আদতেই বিজ্ঞানের দু’টি পৃথক সনাতনী ধারা। এই দ্বিজ প্রান্তে রয়ে গেছে আন্তঃনাক্ষত্রিক দূরত্বের চরিত্রগত বৈরীতা। তাই এযাবৎ কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে পদার্থ কেন্দ্রিক সাফল্য করায়ত্ব হলেও এখনও পর্যন্ত তা মনুষ্য পর্যায়ে সফলতার মুখ দেখেনি।
কিন্তু প্রচলিত বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ অনেকের জানা। তা হলো, যেখানে বিজ্ঞান শেষ সেখানে দর্শন শুরু। আর দর্শনের বৃত্ত সার্থকতা তো পৃথিবীর নানা ধর্মের আঁতুরঘরেই চির লালিত। অতি সযত্নে। পরম বিশ্বাসে। তাই দর্শন ভিত্তিক বিভিন্ন ধর্ম ও তার বিবিধ সাধক সাধিকার অলৌকিক টেলিপোর্টেশন উপাখ্যান আজও উচ্চ মর্যাদায় বিশ্ব বন্দিত। একইসঙ্গে বিনম্র শ্রদ্ধায় আধ্যাত্মিক ভাবে আত্মস্থও।
প্রসঙ্গক্রমে হিন্দু ধর্মের অন্তরাত্মায় টেলিপোর্টেশনের উজ্জ্বল উপস্থিতি কিন্তু বৈদিক যুগেও পাওয়া যায়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পুরাণ মতে দুই ঋষি কন্যা ঊষা ও চিত্রলেখা ছিলেন পরস্পরের অন্তরঙ্গ সখী। একদিন স্বপ্নে ঊষা দর্শন পেলেন শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র অনিরুদ্ধর। সখীর প্রেমমগ্ন সেই স্বপ্নপূরণের মনোবাসনা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ চিত্রলেখা সন্মুখ সাক্ষাৎ করেন অতিদূর স্থিত অনিরুদ্ধর সঙ্গে। আবার নারদ তো সর্বদা ‘নারায়ণ নারায়ণ’ মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে বিশ্ব চরাচরের সর্বত্র মুহুর্মুহু বিচরণ করতেন সত্যযুগে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এ’সবই তো টেলিপোর্টেশনকেই মান্যতা দেয়। এমনকি হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে ইন্দ্রজিতের ভূমিকাতেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। যখন তিনি মেঘের মধ্যে আকস্মাৎ আত্মগোপন করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, সেটাও তো আলোচিত বিষয়কে সঙ্গত দেয়।
তর্কের খাতিরে এটা বলা যেতেই পারে, এ’ধরনের উপমাগুলি তো আদতে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস ভিত্তিক। কিন্তু এর বাস্তব প্রতিফলন কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তরও রয়েছে বহুক্ষেত্রে। উদাহরণ স্বরূপ, হিন্দু ধর্মে সাক্ষাৎ মানুষের অবিশ্বাস্য টেলিপোর্টেশন বিভিন্ন সাধকের জীবনচক্রে গভীর ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ হিসেবে কিংবদন্তি যোগীসাধক স্বামী ত্রৈলঙ্গস্বামী মহারাজের জীবনীতেও এমন টেলিপোর্টেশন রহস্য আজও ভক্তদের বিস্মিত করে বৈকি। বারানসীর গঙ্গা প্রবাহিত দশাশ্বমেধ ঘাটে একদিন সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় পরিভ্রমণ করছিলেন এই সিদ্ধসাধক। পুরম পুরুষের এমন অবস্থা স্বচোখে দেখে ফেলেন তদানীন্তন স্থানীয় ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট। রীতিমত রুষ্ট হয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে এক নির্দেশে ত্রৈলঙ্গস্বামীকে নিক্ষেপ করে দেন গারদে। কিন্তু সকলকে অবাক করে পরদিন সকালে সাধক পুরুষ ফের একই স্থানে পূর্বাবস্থায় হাঁটাচলা করতে থাকেন। একদম মুক্ত অবস্থায়। এই ঘটনার কথা জানতে পেরে ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয় ফের ওই যোগী পুরুষকে কারাগারে নিজের হাতে এবার বন্দি করলেন। কারাগারের গেটের চাবি রেখে দেন নিজস্ব হেফাজতে। কিন্তু হিন্দু মতে যিনি যোগ সাধনায় বলীয়ান হয়ে স্থূল দেহ বর্জন করে সূক্ষ্ম দেহে যত্রতত্র ইচ্ছেমতো স্থানান্তর বিদ্যা আয়ত্ব করেছেন, তাঁকে জেলে আটকায় কার সাধ্য। সুতরাং ফলস্বরূপ ম্যাজিস্ট্রেট কিছু পরেই পরখ করলেন, ত্রৈলঙ্গস্বামী আদালতের এক প্রান্তে ঘুরছেন একেবারে নিজস্ব মেজাজে। এমন ঘটনাকে কি বলা যেতে পারে? তবে কি এটা যথার্থ মনুষ্য টেলিপোর্টেশন?
এমনতর নিদর্শন আরও রয়েছে। যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর জীবনী ঘিরে। কর্মসূত্রে তিনি তখন গাজিপুরে বসবাস করতেন। সেখানে একদা তাঁর উর্ধ্বতন সাহেব বসে ছিলেন। হতাশাগ্রস্থ হয়ে। যোগীসাধক জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন ব্রিটেনের বাড়িতে ওনার স্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন। এমনটা বুঝতে পেরে যোগীরাজ ফিরে যান নিজের ঘরে। আধঘন্টা পর ফিরে এসে সাহেবকে আশ্বস্থ করলেন, ওনার স্ত্রী এই মূহুর্তে সুস্থ আছেন এবং এখন ম্যাডাম আপনাকে একটা চিঠি লিখেছেন। এমনকি চিঠিতে কি লিখেছেন তাও তিনি বলে দিলেন। সাহেব আদৌ এসব বিশ্বাস করেননি প্রাথমিকভাবে। কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন ডাকযোগে স্ত্রীর চিঠি সপ্তাহ খানেক বাদে সাহেব হাতে পেলেন। দেখলেন চিঠির ভাষা ও শ্যামাচরণ লাহিড়ীর বক্তব্য হুবহু এক। চমক আরও অপেক্ষা করছিল যখন কয়েক মাস পরে ওনার স্ত্রী গাজিপুরে এলেন। সেখানে যোগীরাজকে দেখে চমকে গিয়ে ম্যাডাম বলে উঠলেন সাহেবকে, ‘ইনিই তো আমার ব্রিটেনে অবস্থিত গৃহে গিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। জানতে চান আমি কেমন আছি।’ মাত্র ত্রিশ মিনিটের তফাতে শ্যামাচরণ লাহিড়ী কর্মস্থল থেকে স্বগৃহে গেলেন। অফিসে ফিরলেন। তারমধ্যে আবার গাজিপুর থেকে ব্রিটেন গেলেন এবং সেখান চলেও এলেন। কিভাবে তিনি সম্পন্ন করলেন এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাবলী। বাস্তবিক অর্থে, এমনতর মনুষ্য টেলিপোর্টেশনের অদ্ভুতুড়ে ঘটনার প্রকৃতই বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।
শুধুই কি হিন্দু ধর্মের পরিধিতে টেলিপোর্টেশনের ব্যবহার প্রবলভাবে আলোচিত হয়েছে তা কিন্তু মোটেই নয়। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মেও এর শিকড় রোপণ করা আছে অনেক গভীরে। ইসলাম মতে ‘মিরাজ’ হলো এক অতি পবিত্র আধ্যাত্মিক অধ্যায়। কোরান বর্ণিত অনুসারে পরম নবী মুহাম্মদ (সা) মহান আল্লাহ’র নির্দেশ মেনে এক রাতের মধ্যে মক্কা থেকে জেরুজালেম পরিভ্রমণ করেছিলেন। এরপর তিনি আকাশে উঠে যান মহান আল্লাহ’র সঙ্গে সন্মুখ সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। আবার খ্রীষ্ট ধর্ম পুস্তক অনুযায়ী, প্রভু যীশু মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা একটি বদ্ধ ঘরে মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে আচমকা প্রভু যীশু উপস্থিত হয়ে সবাইকে চমকে দেন (মথি ১৪: ২২-৩৩)। বাইবেলের (প্রেরিত ১: ৯-১১) বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রভু যীশু শিষ্যদের সামনে থেকে আকস্মাৎ আকাশে অদৃশ্য হয়ে যান। উনার এই অদৃশ্য হওয়ার ঘটনাকে খ্রিস্টানরা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করেন। পাশাপাশি জৈন ধর্মের মধ্যেও কিছু অলৌকিক বিষয় পরিলক্ষিত হয়। যেমন ভগবান মহাবীর অলৌকিক শক্তির অধিকারী হিসেবে পুজিত হন জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে। তিনি ছিলেন জৈন ধর্মের ২৪ তম তীর্থঙ্কর। কঠোর ধ্যান সাধনের মাধ্যমে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি অতি প্রাকৃতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে হামেশা শরীর চক্র উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হতেন। এমনকি নিজের পছন্দসই স্থান ইচ্ছে মতো যখন খুশি বিদ্যুৎ গতিতে পাল্টাতে পারতেন বলে জৈনরা আধ্যাত্মিক পর্যায়ে বিশ্বাসও করে থাকেন। একইরকমের মত পোষণ করেন বৌদ্ধরাও। ধর্মগুরু গৌতম বুদ্ধের জীবনীতেও অতিলৌকিক উৎকর্ষের নানাবিধ সূক্ষ্ম অতিক্রমণের নজির স্থান পেয়েছে।
অবশেষে এটুকু বলাই যায়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় যেখানে টেলিপোর্টেশন আপাতত স্রেফ কোয়ান্টাম অক্ষেই সীমায়িত ঘূর্ণায়মান, সেখানে ধর্মীয় দর্শনের অতিন্দ্রীয় বিচরণে সে যে যুগ যুগান্তরকারী মহানিষ্ক্রমণের সূক্ষ্মজৈব পরিব্রাজক বৈকি।