দিল্লিতে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির ভোট কাটাকাটির সুফল যে বিজেপি পেয়েছে তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং রাহুল গান্ধীরা যদি আসন সমঝোতা করতেন, মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ হিসেবে ভোটের ময়দানে নামতেন, তাহলে বিজেপি হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত না। এর পাশাপাশি পদ্ম শিবিরের জয়ের নেপথ্যে ‘হায়দরাবাদ ফ্যাক্টর’-এর কথাও উঠে আসছে। দিল্লি নির্বাচনে দু’টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল আসাদউদ্দিন ওয়েসির দল এআইএমআইএম বা ‘মিম’। কোনও আসনে জয় না পেলেও প্রচুর ভোট কেটেছেন দলের দুই প্রার্থী। মিমের ভোট কাটার ফলেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনেও জয় পেয়েছে বিজেপি।
প্রায় তিন দশক পর দিল্লির মসনদ দখল করেছে বিজেপি। শেষবার ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত রাজধানী শাসন করেছিল গেরুয়া শিবির। সেবার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করলেও ‘রাজত্ব’ খুব একটা সুখকর হয়নি। দুর্নীতি থেকে শুরু করে মূল্যবৃদ্ধি—একের পর এক অভিযোগে বেজায় চাপে পড়ে যায় পদ্মপার্র্টি। মুখরক্ষায় তিন তিনবার মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে হয়েছিল। শেষবার মাত্র ৫২ দিনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী করা হয় সুষমা স্বরাজকে। যদিও ১৯৯৮-এর নির্বাচনে গদিরক্ষা করতে পারেনি বিজেপি। ভোটে জিতে শীলা দীক্ষিতের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে কংগ্রেস।
বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যখন সারা দেশে ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তখনও দিল্লির তখত অধরা ছিল গেরুয়া বাহিনীর। আর এবার লোকসভা নির্বাচনে যখন মোদী সরকার কিছুটা হলেও ধাক্কা খেল, তখন দিল্লি জয় করল বিজেপি। অনেকেরই মত, যে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১০ বছর দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল আপ সরকার, তাতে অনেকটাই মরচে পড়তে শুরু করেছিল। সরকারের কাজকর্মে অসন্তোষ বাড়ছিল মানুষের। আবার প্রশাসনিক এবং নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রেও জনমানসে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ক্ষোভ। প্রচারে ধুয়ো তুলে সেই ফায়দা লুটেছে বিজেপি।
লোকনীতি—সিএসডিসি সমীক্ষা জানাচ্ছে, বেকারত্ব প্রভাবিত করেছে এক-পঞ্চমাংশ ভোটারকে। এরই পাশাপাশি নিকাশি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ১৫ শতাংশ, অনুন্নয়ন ১১ শতাংশ এবং মূল্যবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ভোটারকে আপ সম্পর্কে বিমুখ করে তুলেছিল ভোটারকে। বিজেপির প্রচারের মূল অস্ত্র ছিল দুর্নীতি। সেই দুর্নীতি প্রভাবিত করেছে ৭ শতাংশ ভোটারকে বলে জানাচ্ছে সমীক্ষা। বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা নিরসনে আপ সরকারের ভূমিকা দিল্লিবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ৭ শতাংশ দিল্লিবাসী এই প্রশ্ন তুলে এর সমাধান আশা করেছিলেন। একই সঙ্গে ৪ শতাংশ ভোটার সরকার পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। আপ সরকারের শিক্ষা সংক্রান্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং কল্যাণমুখী প্রকল্প মাত্র ৩ শতাংশ ভোটারকে প্রভাবিত করেছিল বলে সমীক্ষায় প্রকাশ। শুধু তাই নয়, মহিলাদের সুরক্ষা এবং দূষণও বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবারের ভোটে।
জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিলেন আপ নেতৃবৃন্দ। এ কারণেই ২০ জনেরও বেশি বিধায়ককে এবার নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়নি। কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হয়নি। দেখা গেল, বিধায়ক নয়, দল এবং সরকারের কাজকর্মে অসন্তুষ্ট ছিলেন মানুষ।
কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জানিয়েছেন, আরএসএসের ছায়াতেই আপের প্রতিষ্ঠা এবং দল সেইভাবেই চলে বলে সম্প্রতি বেশকিছু বিষয় উল্লেখ করে আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল চিঠি লিখেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতকে। আপের শ্রীবৃদ্ধিতেও আরএসএসের মদত ছিল। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার সময় কেজরিওয়ালের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়। সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন কেজরিওয়াল। এবারের ভোটে সংখ্যালঘু অঞ্চলে আপ জিতলেও ফল ততটা ভালো হয়নি। আবার অনেকেই বলছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে কংগ্রেসকে দূরে ঠেলে রাখতে আপ নেতা বিজেপি-আরএসএসের ‘জুতোতেই পা গলিয়ে’ দেন। বিরোধী শক্তির ভাঙনেই বিজেপির লাভ। আত্ম অহঙ্কারে নিমগ্ন কেজরি সেই ভুলটাই করে বিজেপিকে দিল্লির মসনদটা উপহার দিল।