ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম দু’টি রক্ষাকবচ সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় এবং বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের অবশ্য অন্যরকম ধারণা। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট নয়, দেশে সর্বোচ্চ ক্ষমতা হল সংসদের। তাকে মানতে হবে। এটা যেন মনে রাখে সুপ্রিম কোর্ট।’ অবসর গ্রহণের আগে এক মামলায় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না অবশ্য স্পষ্ট ভাষায় এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংবিধান হলো সর্বোচ্চ। আমাদের সকলের ঊর্ধ্বে, তা আমাদের মানতে হবে। সংবিধান তিনটি ক্ষমতার অংশকে তার ক্ষমতা এবং সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।’ বিচারবিভাগের দায়িত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিচার বিভাগকে সংবিধান এই ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে কিনা তা পর্যালোচনার অধিকার দিয়েছে। সেই অধিকার বলে দায়িত্ব পালন করছে সুপ্রিম কোর্ট।’
দেশের শীর্ষ আদালতের ৫১তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে অবসর গ্রহণ করলেন বিচারপতি সঞ্জীব খান্না। ভারতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বিচারপতি বি আর গাভাই। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত, গত ছ’বছর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন একাধিক ঐতিহাসিক মামলার রায়ের অংশ ছলেন খান্না। যার মধ্যে রয়েছে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, নির্বাচনী বন্ড এবং ‘ইভিএম’ মামলা। খান্না তাঁর প্রয়াত কাকা এইচ আর খান্নার মতো সংবিধানের মর্মবস্তু রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কাকা জব্বলপুর এডিএম মামলায় তাঁর বিরোধী মত প্রকাশ করে নজির সৃষ্টি করেন। সেই একই পথে চলেছেন সঞ্জীব খান্না। বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা রক্ষার পক্ষে অবিচল থেকেছেন তিনি। বিচার শোনায় তাঁর ধৈর্য ছিল অপরিসীম। অনেক সময় বিপক্ষের আইনজীবীরা প্রস্তুত হয়ে আসতেন না। কিন্তু বিরক্তির চিহ্নমাত্র থাকত না খান্নার। তিনি ধৈর্য ধরে সেই মামলা শুনতেন। বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর মত হলো, ‘বিচারপতিরা প্রথমে মামলা পর্যালোচনা করেন। তাঁরা মামলার যুক্তি যোগ-বিয়োগ খতিয়ে দেখেন। এরপরই দেখা হয় কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল। রায় ঘোষণারক পর ভবিষ্যৎ বলতে পারে তা ঠিক ছিল, না ভুল ছিল।’
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সময় থেকে তাঁকে লড়তে হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। ১৯৭৬ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র শব্দ দু’টি যুক্ত করে সংবিধান সংশোধন হয়। সেই সংশোধন বাতিলের জন্য মামলা দায়ের হয়। সেই আবেদন খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি খান্না। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের অংশ এবং মর্মবস্তু, তা বাতিল করা যায় না বলে তিনি রায়ে জানিয়ে দেন। সেই শুরু। তাঁকে এরপর হিন্দুত্ব বাহিনীর নানা মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিবারই সংবিধানের মর্মবস্তু তুলে ধরেছেন খান্না। এসেছে উপাসনাস্থল নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের মামলা। তাতেও হিন্দুত্বের জিগির প্রতিরোধে ছাপ রেখেছেন খান্না তাঁর রায়ে। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার সমালোচনা করে মামলার রায়ে খান্না স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতি রাজ্য সরকারের বিল তিন মাসের বেশি আটকে রাখতেপারবেন না। তিন মাসের মধ্যেই বিল নিয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে বিজেপি।
প্রশাসনে লাগামহীন দুর্নীতি রোধে বিভিন্ন মামলায় নজিরবিহীন রায় দিয়েছে খান্নার বেঞ্চ। তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি রোধে ২৫ হাজার বেআইনি নিয়োগ বাতিল করে দেন। নিয়োগ বাতিল করে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সেখানে নতুন নিয়োগের নির্দেশ দেন। অবসরের আগে বিচারপতি খান্না সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের আয় এবং সম্পত্তির হিসাব প্রকাশ বাধ্যতামূলক করে যান। একই সঙ্গে বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম নিয়েগের প্রক্রিয়াও জনসমক্ষে নিয়মিত প্রকাশের নির্দেশ দেন।
বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা অর্জনে সংবিধান রক্ষায় অবিস্মরণীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বিচারপতি খান্না। বিচার বিভাগকে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হয়। তা আদেশ জারি করে অর্জন করা সম্ভব নয়। মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করতেন বিচারপতি খান্না। তাই অবসরের সময় জানিয়ে দিলেন, সরকারের আর কোনও পদে তিনি কাজ করবেন না। বাকি জীবন আইনি পরামর্শদাতা হিসাবে থাকতে চান।