এই সভ্যতার উন্মেষ-বিকাশ ও বিস্তারে মানুষের একাধিপত্য অনস্বীকার্য। তার অপরাজেয় প্রাণশক্তি ও দুর্জয় প্রকৃতি আবিশ্ব জয় করার আগ্রাসী ক্ষুধা তাকে যেমন অবিরত সক্রিয় করে রেখেছে, তেমনই সভ্যতাগর্বী আধুনিকতার মোড়কে সবুজ পৃথিবী ক্রমশ হলুদ হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অপ্রাকৃতিক বিস্ময় কোনও কিছুই তাকে বিরত করতে পারেনি। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তার শক্তিকে প্রতিহত করে আধুনিক সভ্যতার বুনিয়াদ গড়ে তোলা মানুষই ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। তার আগ্রাসী ক্ষুধায় প্রকৃতির অসহায় পরিণতি দেখে মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা বেড়েই চলেছে। আর সেখানেই দূষণ দৈত্যের প্রবল প্রতাপে দিশেহারা জনজীবন, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের করুণ পরিণতিতে মানুষের স্বরচিত পরিবেশই আত্মঘাতী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। কৃত্রিমতার আড়ম্বরে ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট থেকে ইট-কাঠ-পাথরের রাজপ্রাসাদ, রঙিন আলোর হাতছানিতে ভোগসর্বস্ব আধুনিকতা যে কত ঠুনকো, কত পলকা,কত অস্থিতিশীল, তা বছর দুয়েকের করোনা মহামারির গৃহবন্দি জীবনেই প্রতীয়মান। হাতের মুঠোয় পৃথিবীকে ধরতে গিয়ে হাতটাই কখন বেহাত হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি আমরা। রিয়্যাল ওয়ার্ল্ড থেকে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড যত বড় হয়েছে,তত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে মিলিয়ে গিয়েছে,ততই সবুজ পৃথিবীর হাতছানি মহার্ঘ হয়ে উঠেছে।
মানুষের স্বরচিত পরিবেশের কৃত্রিম আয়োজন যতই মনোরম আর মনোমুগ্ধকর হোক না কেন,তাতে প্রকৃতির সবুজ সজীবতা মেলে না। প্লাস্টিকের ফুলের বাহারি আয়োজনে চোখ ধাঁধায়, অথচ তাতে মন ভরে না। নকল ফুলে তো আর প্রজাপতির হাতছানি মেলে না। আধুনিক সভ্যতার রংবাহারি আয়োজনে প্রকৃতি সঙ্গে যত দূরত্ব বেড়েছে,তত মানুষ ও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ভেঙে পড়েছে,ততই নেমে এসেছে সব পেয়েও না থাকার হাহাকার, সব থেকেও না পাওয়ার আর্তি। নকলের দেখনদারিতে আসলের অভাববোধ আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। অভিজাত হোটেলে গিয়ে মায়ের হাতের রান্না মনে পড়ে, বিলাসবহুল অট্টালিকায় গিয়েও নিজের ঘরের অগোছালো বিছানার কথা জেগে ওঠে। সেখানে মানুষের স্বরচিত কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে প্রকৃতির নির্মল হাতছানির অভাববোধ আরও তীব্র থেকে তীব্রতর মনে হয়।
আধুনিক জীবনের মানোন্নয়নে আরও স্বাচ্ছন্দ্য, আরও স্বাস্থ্যকর, আরও আরামদায়ক, আরও মনোরম চাহিদা যত গগনচুম্বী হয়ে উঠেছে,ততই আকাঁড়া বন্য প্রকৃতিকে প্রতিযোগী মনে হয়েছে। সেখানে প্রকৃতিকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তার উপরে নেমে এসেছে স্বেচ্ছাচারী দৈত্যের তাণ্ডব।
কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে নিজের ইচ্ছে মতো প্রকৃতিকে ধ্বংস করে অত্যাধুনিক কৃত্রিম পরিবেশ রচনার তৎপরতায় নাগরিক জীবনের বিকৃত ক্ষুধা আমাদের পেয়ে বসেছে। তাতে অচিরেই সুলভ প্রাকৃতিক সম্পদ হাতের নাগালের বাইরে দুর্লভ হয়ে উঠেছে, প্রকৃতির রূপসুধাই বিষাক্ত পরিবেশে মহার্ঘে পরিণত হয়েছে। জলের দরের মতো বলে কোনোকিছুর মূল্য হ্রাস করার অবকাশ আর নেই। সুলভ পানীয় জলই এখন কোল্ডড্রিঙ্কের মতো বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, পানীয় জলের অভাব এখন মরুভূমির আতঙ্ক জাগিয়ে তোলে। নির্বাচনেও সেই পানীয় জলের চাহিদা মেটানোর দাবি সোচ্চার হয়ে উঠেছে। আবার সুপেয় জলেই রয়েছে বিষাক্ত আর্সেনিকের আতঙ্ক। খাদ্যই সময় পেরিয়ে গেলে অখাদ্য হয়ে ওঠে,অপব্যবহারেও খাদ্য বিষে পরিণত হয়। প্রকৃতির জলই আজ ‘অবাক জল পান’ হয়ে উঠেছে। তৃষ্ণার্ত চাতকের প্রতীক্ষার মতো পানীয় জলের চাহিদায় আজ জল সংকটের ভয়াবহ ছবি উঠে আসছে। সুজলা সুফলা বাংলাতেই আজ সমুদ্রের নোনা জলে পানীয় জলের অভাবকে প্রকট করে তুলেছে।
মাটির উর্বরতা শক্তিও মানুষের অতিরিক্ত চাহিদায় নিঃস্বপ্রায়। সূর্যালোকেও অতি বেগুনি রশ্মির তীব্র আক্রমণ। বাতাসও হয়ে উঠেছে শ্বাসপ্রশ্বাসের অন্তরায়। বিনে পয়সার অক্সিজেন কত মহার্ঘ হতে পারে,তা করোনাকালেই সুবোধ্য মনে হয়েছে। আর ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে পূর্ণ শহরের গগনচুম্বী বিস্তারে আকাশটাও আর পুরো দেখা যায় না। এখন আকাশ দেখার জন্যই বাড়ির ছাঁদের উপরে উঠতে হয়। পুকুর চুরির মতো আকাশটা যেন চুরি হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতি উজাড় করা মাটি, জল, আলো, বাতাস, আকাশ সবকিছুই আজ হাতের নাগালের বাইরে। অথচ সেসবই আজ পণ্যায়িত বিশ্বে মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক স্বাচ্ছন্দ্য পেতেই আজ সবচেয়ে বেশি মূল্য চোকাতে হয়। মানুষের স্বরচিত পৃথিবীতেই মানুষের সুলভ নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের তীব্র আকাল। সেক্ষেত্রে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের অভাবের চেয়েও আধুনিক পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশের ভয়ঙ্কর আকাল মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতিতে ধ্বংস করে বা দূষিত করে তার সংকট যত ঘনিয়ে উঠেছে, তত তার চাহিদা বেড়ে মূল্য গিয়েছে বেড়ে, ততই জনমানসে তার অতৃপ্তিবোধ অস্বস্তি বয়ে এনেছে নিরন্তর।
উন্নয়নের গতিতে যে মানুষের দুর্গতি আরও বেড়েই চলেছে, তা তার প্রাকৃতিক স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবেই প্রতীয়মান। টবের গাছের সৌন্দর্যে চোখ জুড়ায়, মন ভরে না। তাতে গাছটির শ্রীবৃদ্ধির অভাব মাটিসংলগ্ন মানুষকে স্বস্তি দিতে পারে না। কেননা মাটির সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। কৃত্রিম উপায়ে এই সংযোগের অভাব অত্যন্ত প্রকট। অথচ জন্মভূমির রূপ থেকে স্বদেশের স্বরূপ সবেতেই সেই প্রাকৃতিক পরিবেশের রূপসুধা জেগে ওঠে। আমার দেশ মানেই প্রকৃতির অপরূপ দেশ। সেখানে সকল দেশের সেরার গৌরবের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা থেকে জীবনানন্দের রূপসী বাংলা জেগে ওঠে। আধুনিক ভোগবাদী সভ্যতার গ্রাসে প্রকৃতির রূপসুধাই হারিয়ে যায়নি, তার অভাবই বিপণনের রসদ হয়ে উঠেছে।
একদিকে তার নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চলেছে,অন্যদিকে কৃত্রিম উপায়ে তাকে গড়ে তোলার আয়োজনও সমান সক্রিয়। জলাশয়ে ভরাট করে বা খোলামেলা বসতবাড়ি ভেঙে বহুতল গড়ে তুলে ক্রেতাদের আকর্ষণে ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনের প্রাকৃতিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মনোরম করে তোলা হয়। শুধু তাই নয়, হারিয়ে যাওয়া পল্লিবাংলাকেই শাহরিক প্রদর্শনীতে সাজানো চিত্রনাট্যে তুলে ধরার আয়োজনেই আমাদের সংকট আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আমাদের সব-পেয়েছির স্বপ্ন ভেঙে যায়। পণ্যায়িত বিশ্ব আমাদের ক্ষুধা যত বাড়িয়েছে, তত তার বিপণন শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছে, ততই সবুজ প্রকৃতির ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’র আন্তরিক হাতছানি বহুদূরে সরে যাচ্ছে। সেখানে যেন মননে সকলে উদ্বাস্তু জীবনে ছিন্নমূল শরণার্থী। পণ্যায়িত বিশ্ব মায়ের চাহিদা পূরণে সদা ব্যস্ত, আরও আরও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও উপভোগের আয়োজনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনের আবিষ্কারের নিবিড় প্রতিযোগিতা। অথচ সব পেয়েও না পাওয়ার অতৃপ্তি জেগে থাকে অবিরত। মায়ের বদলে সারোগেট মা পাওয়া গেলেও তাতে সম্পর্ক জোড়ে না। মানুষের গড়ে তোলা কৃত্রিম পরিবেশ সেই সারোগেট মাদার। তাতে মা মেলে,মাতৃত্ব তার অধরা মাধুরী।