নিশীথ সিংহ রায়
যে বাংলাভাষী অঞ্চল ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুরঘর, সেখানে এখন ধর্মীয় অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। যেখান থেকে আদর্শবান, বিবেকবান, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক বের হয়েছিল সেখান থেকে এখন বের হচ্ছে অসহিষ্ণু, বোধ-বিবেকহীন, উগ্র মৌলবাদী! যাদের একটাই কাজ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে ধর্ম বেচে আয় করা। এই যারা ধর্মকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করে সংসার চালায়, মুনাফা করে এরা প্রথমে নিজেদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তবেই এই পেশায় নামে। মানে একেবারে বহুজাতিক সংস্থার মতন। এরা যে শুধু নিজের ধর্ম সম্বন্ধে ভাল জানে তা নয় প্রায় সব ধর্ম সম্বন্ধেই অল্প-বিস্তর জানে। তার ফলে এরা নিজ ধর্মের ভাল দিকগুলি যেমন ব্যাখা করতে পারে, বোঝাতে পারে তেমনই অপর ধর্মের আপাতদৃষ্টিতে যেগুলি কুসংস্কার বলে মনে হয় বা ঠিক নয় বলে মনে হয়ে সে সম্বন্ধে ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখা করে নিজ ধর্মের সাথে তুলনা করে অন্য ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করে, কুড়ায় অগণিত শ্রোতার হাততালি।
এতে যেমন সাধারণ মানুষের নিজ ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস জন্মায় তেমনই অপর ধর্মের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ জন্মায়। জনগণ যখন এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে তখন সমাজে নেমে আসে এক অপ্রীতিকর অবস্থা। সাধারণ মানুষ সবকিছুই বিবেচনা করে ধর্মীয় ভিত্তিতে। এই সুযোগে প্রভাবশালী ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতার পিছনে থাকে হাজার হাজার নির্বোধ মানুষ। এসব প্রভাবশালী নেতারা কোনও সমস্যার সমাধান করে না বা করতে পারে না কিন্ত তারা তাদের সুন্দর বাচনভঙ্গীর মাধ্যমে এসমস্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করে আরও নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে।
সাধারণ মানুষ অতি তুচ্ছ, নগন্য বিষয় নিয়ে মেতে থাকে। কোনও গুরুত্বপূর্ণ বা সমাজ কল্যাণমূলক কাজ নিয়ে ভাবতে ভুলে যায়। সস্তা, চটুল, মনোগ্রাহী সমাজ চলতি কথাবার্তার আবরণে হারিয়ে ফেলে সুস্থ চিন্তাভাবনা। সবচেয়ে মারাত্মক এক একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতার অনুরাগীরা একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। কারণ এরা তাদের ধর্মীয় গুরুকে ভগবানের মত শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস করে। তাই স্বধর্মের মধ্যেই অনেক উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন সমাজে নেমে আসে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। আর সমাজে যেহেতু সাধারণ মানুষ ধর্ম নিয়ে অত চর্চা বা পড়াশোনা করে না তেমন তার গভীরেও তারা ঢুকতে চায় না। কারণ আর কিছুই নয় তারা দু’বেলা অন্ন সংস্থানের কথা ভাববে না ধর্ম চর্চা করবে? তারা শুধুমাত্র নিজ গৃহে প্রয়োজনে ধর্ম পালন করে বা কখনও কখনও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে যায় ধর্মীয় নিদানে। ধর্ম তাদের রুটি-রোজগারের পথ না হওয়ায় তারা এ সম্বন্ধে অতটা তলিয়েও দেখে না। আর হয়ত তাদের সে বৌদ্ধিক বা আর্থিক ক্ষমতাও নেই। আর এই শ্রেণীর মানুষ এই অঞ্চলটায় সংখ্যাধিক্য। তাই এসমস্ত ধর্মান্ধ ধর্মীয় গুরুরা তাদের নিজেদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য সমাজের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজে মুনাফা লুঠে। আর আজকাল মানুষ এমনিতেই বিভিন্ন সমস্যায় জড়িত। সেকারণে মানুষের সহনশীলতা এত কমে গেছে যে এই সমস্ত বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা শুনে অবিবেচকের মত কাজ করে বসে।
আমরা সাধারণ মানুষ ভুলে যাই যে আমি জন্ম থেকে যেটা দেখে এসেছি, শিখে এসেছি করে এসেছি সেটাই আমার ধর্ম। আমার সমাজ, আমার পরিবেশ আমাকে শেখায় কোনটা করতে হবে, কোনটা করতে হবে না এবং যুগ যুগ ধরে এই ট্রাডিশন চলে আসছে। কোনো পরিবার তার শিশুকে শেখায় না মিথ্যা কথা বলা বা করতে বলে না কোনো অন্যায় বা গর্হিত কাজ। তাকে শেখানো হয় নীতিকথা। আর এটাই হচ্ছে আমাদের ধর্ম। সেখানে আরও বলা হয় তুমি অপর ধর্মের সমালোচনা করতে পার না। তাদের প্রতি সর্বদা সহনশীলতা দেখাবে। মানে যে বাচ্চাটি ফুটবলের ভক্ত সে কি ক্রিকেট খেলাকে ঘৃণা করবে? না তা নয়। যে যার বিশ্বাস, ভালবাসা নিয়ে থাকবে এটাই তো সামাজিক রীতিনীতি। এইটা ধারণ করেই আমরা আমাদের জীবনের পথ চলি। আর এইটে না হওয়ার জন্যই আজ পৃথিবীতে নাস্তিক ও কোনো ধর্ম না মানা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
এব্যাপারে জাপান, সুইডেন, চীন বা উত্তর কোরিয়ার দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারব। আর বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের কিয়দাংশে ধর্ম পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে যেভাবে গ্রাস করে সমাজকে কলুষিত করে দিচ্ছে সেখানে আর এই নীতি প্রযোজ্য নয়। আমাদের এখানে এখন লাইব্রেরী থেকে উপাসনালয় বেশি। আবার এই উপাসনালয়গুলি সৎ চিন্তা ভাবনার আখরা নয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্র নয়। সেকারণে আমাদের শিক্ষার হার বাড়লেও সুশিক্ষার হার আদৌ বাড়েনি। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতার বৃদ্ধি ঘটলেও নীতিবান মানুষের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাসমান। এর দ্রুত বৃদ্ধি ঘটার আর একটা প্রধান কারণ বর্তমানের ‘সোশ্যাল মিডিয়া’। সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়াবার জন্য এই মিডিয়া এখন এদের প্রধান হাতিয়ার। সেখানে এসে বিষোদ্গার করে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ আর ভারতের বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের সোশ্যাল মিডিয়াগুলি দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে আমরা কি সুস্থ-স্বাভাবিক থাকতে পারি না আমার প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুন লাগলে আমি নিশ্চিত ঘুমাতে পারি? এটাই আমরা দুই দেশ ভুলে গেছি। আমরা কালীদাসী প্রথায় নিজেদের ক্ষতি করে যাচ্ছি। যখন আমরা এটা বুঝতে পারব তখন হয়ত আমাদের এর থেকে বেড়িয়ে আসার আর পথ থাকবে না। আমরা আধুনিক সমাজ থেকে অনেক অনেক পিছিয়ে যাব। আমরা সাধারণ মানুষ অপেক্ষায় থাকলাম সমাজ সচেতন, সুশিক্ষায় শিক্ষিত, বিবেকবান, চিন্তাশীল, দেশপ্রেমি সেই বাঙালির অপেক্ষায় যা ১৯৪৭ সালের আগে এই বাংলায় জন্মে ছিল। আর না হলে আক্ষেপ, যে দ্রুত গতিতে আমরা অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছি তাতে বাঙালিদের সমূলে ধ্বংস হওয়ার অপেক্ষা মাত্র।