• facebook
  • twitter
Tuesday, 19 August, 2025

ধর্মের নামে রাজনীতি

অসহায় নিরক্ষর মানুষ, তাদের প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ জীবনে জর্জরিত। দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্তি পেতে চাইছে, কিন্তু মুক্তির পথ তাদের জানা নেই।

একটি রাজনৈতিক সমাবেশের ফাইল চিত্র।

আদিম যুগে যখন কোনও ঘটনার কার্যকারণ মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারত না, তখন তারা দেবতা বা ঈশ্বরের শরণাপন্ন হত। বিদ্যুৎ চমকানো, ঝড়-বৃষ্টি বা দাবানলের মতো সামান্য ঘটনার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে তারা মনে করত কোনও বৃহৎ শক্তি হয়তো তাদের উপর রুষ্ট হয়েছে। তখন তারা নানা উপাচার ও উপাসনার মধ্য দিয়ে ওই বৃহৎ শক্তিকে সবসময় তুষ্ট রাখতে চাইত। এর থেকেই দেবতা বা ঈশ্বরের জন্ম হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ, বিস্তার, এমনকি আগাম সতর্কতা পর্যন্ত নির্ণয় করতে শিখেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দেবতারাও ক্রমাগত পিছুপা হয়েছে।

মানুষের অজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা থেকে যে দেবতার পথ চলা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দেবতাদের আশ্রয় করে বেঁচে আছে বেশ কিছু ধর্মব্যবসায়ী। প্রতিটি ধর্মের ধর্মব্যবসায়ীদের কাজই হলো মানুষের উপর ছড়ি ঘোরানো। মধ্যযুগের বিজ্ঞানীরা যেমন কোপারনিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের চেতনাকে সোজাপথে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের উপর তখন নেমে এসেছিল ধর্মব্যবসায়ীদের খাঁড়া।

আধুনিক পৃথিবীতে বিজ্ঞান নির্ভর জীবনে আমরা বিভিন্ন ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে শিখেছি, কিন্তু এখনও বাকি আছে অনেক আবিষ্কার। আগামী দিনে বিজ্ঞান তার নানা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এখনও পৃথিবীতে থেকে যাওয়া নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আনবে। আমরা আশাবাদী যে, বিজ্ঞান তার সফল জয়যাত্রার মধ্য দিয়ে একদিন উন্নতির শিখরে পৌঁছবে। বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করেই আদিম গুহাবাসী শিকারী মানুষ আজকের আধুনিক মানুষে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রায় ধর্মও নিজেকে আধুনিক করেছে, যেমন ডিজিটাল কুম্ভ স্নান, ৫ডি স্ক্রিনে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের রুদ্রাভিষেক দর্শন, টেলিস্কোপের মাধ্যমে চাঁদ দেখে ঈদ পালন ইত্যাদি।

অসহায় নিরক্ষর মানুষ, তাদের প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ জীবনে জর্জরিত। দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্তি পেতে চাইছে, কিন্তু মুক্তির পথ তাদের জানা নেই। এই অজ্ঞ মানুষদের যুগে যুগে জন্মান্তর ও স্বর্গলাভের স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে ধর্মব্যবসায়ীরা। স্বপ্নে বিভোর হয়ে অসহায় মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে, ধর্মীয় উপাচারের মধ্যে দিয়ে নানা দৈনন্দিন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চায়। ক্রমাগত অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে ধার্মিক মানুষের আস্থাকে, ধর্মীয় বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক আখের গোছাতে নেমে পড়ে ময়দানে। রাজনীতিকরণের মাধ্যমে ধার্মিক মানুষের ধর্ম বিশ্বাস আর শুধু ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ধার্মিক মানুষকে পরিণত করা হচ্ছে রাজনৈতিক মানুষে। আমাদের দেশেও ধার্মিক হিন্দুকে পরিণত করা হচ্ছে রাজনৈতিক হিন্দুতে। মুসলমান বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে ধার্মিক নিষ্ঠাবান হিন্দুকে বিশেষ রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক হিন্দুতে পরিণত করে নিজেদের বিদ্বেষের রাজনীতি করে চলেছে। মানুষের ধনী, দরিদ্র, শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর এইসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে আসছে মানুষটির ধর্র্মীয় পরিচিতি। ধর্মীয় পরিচিত সত্তাকে রাষ্ট্র যদি প্রচার করে, তবে বিজ্ঞাননির্ভর উন্নত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে নেমে আসে ঘন কালো মেঘের ছায়া।

সমাজে প্রচলিত সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে একজোট হতে হবে। শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা বিজ্ঞানীর জীবনচর্চা নয়, বরং সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সমস্ত প্রচলিত কুসংস্কারকে ধ্বংস করতে হবে। এই সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অপবিজ্ঞানকে ধ্বংস করে একটি বিজ্ঞান-নির্ভর সমাজ গড়ে তোলাই বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তির কাজ। সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে বিজ্ঞানের উপর শুধুমাত্র আস্থাশীল নয়, বরং বিজ্ঞানের কাছে সৎ হওয়াটাও খুব জরুরি।