ভাষা নিয়ে জুলুম নয়

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বললেন, ‘এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, আর সেই ভাষা হােক হিন্দি। যদি কোনও ভাষা ভারতকে একসূত্রে বাঁধতে পারে তা হিন্দি’।

Written by SNS Kolkata | September 19, 2019 3:33 pm

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। (File Photo: IANS)

জোর করে ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দিলে তার কী বিষময় ফল হয়, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থেকে অনেকেরই জানা। পরিণামে পাকিস্তান নামক দেশটিই দু’টুকরাে হয়ে গেল। মাতৃভাষাই একজনের প্রাণের ভাষা। সেই ভাষাতেই কথা বলে তার পরম তৃপ্তি, চরম আনন্দ। সুতরাং ভাষা নিয়ে কোনও জোরজুলুম সর্বদা পরিত্যাজ্য।

কিন্তু সম্প্রতি হিন্দি ভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বললেন, ‘এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, আর সেই ভাষা হােক হিন্দি। যদি কোনও ভাষা ভারতকে একসূত্রে বাঁধতে পারে তা হিন্দি’। যদিও তিনি বলেছেন, ভারতের বহু মানুষের বহু ভাষা- সব ভাষারই গুরুত্ব রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিন্দিকে এমন উচ্চাসনে বসানাের কারণে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে।

গত জুন মাসে জাতীয় শিক্ষানীতির ক্ষমতায় হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছিল। দু’মাস কাটতে না কাটতেই হিন্দি চাপানাে নিয়ে পুরনাে বিতর্ক ফের উস্কে দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ ২০১১ সালের জনগণনার রিপাের্ট বলছে, দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ছয় জনেরই মাতৃভাষা হিন্দি নয়। তাহলে সে ভাষা দেশকে একতার বন্ধনে বাঁধবে কী করে!

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অমিত শাহর এই হিন্দি প্রেমের বিরােধিতা করে বলেছেন, “আমাদের উচিত সব ভাষা, সংস্কৃতিকে সম্মান জানানাে। আমরা অনেক ভাষাই শিখতে পারি, কিন্তু মাতৃভাষাকে ভােলা উচিত নয়।” কবি শঙ্খ ঘােষ ব্যথিত হয়ে বলেছেন, “এ কথা যারা ভাবতে পারেন, তারা আমাদের দেশটাকে চেনেন না। আমাদের যেটা বৈশিষ্ট্য, আমাদের যেটা চরিত্র, সেটা না জানলে এই ধরনের মন্তব্য কেউ করতে পারেন!” তবে সবচেয়ে বেশি উত্তাল হয়েছে দক্ষিণ ভারত। তামিলনাড়ুর এক নেতা বলেছেন, “তামিলবাসীর রক্তে হিন্দি নেই।” উল্লেখ্য, এর আগে রেল ও পােস্ট অফিসের পদ পূরণের পরীক্ষায় হিন্দি বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে তামিলবাসী তীব্র আন্দোলন শুরু করে। তখন বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষকে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়।

ভারতে বিভিন্ন ধর্মের এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা রয়েছে, সেই ভাষাতেই তারা কথা বলেন, মনের ভাব ব্যক্ত করেন। হিন্দি যদি বাধ্যতামূলক করা হয় অথবা না চাইলেও তা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাদের তরফে প্রতিবাদ হতেই পারে। সুতরাং যার যার ভাষা, তার কাছে আপন। মাতৃভাষা ছাড়াও অপর যে কোনও ভাষা একজন একাধিক শিখতে পারে, তাতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু মাতৃভাষার অবমাননা চলবে না।

এদিকে অমিত শাহর হিন্দি ভাষার পক্ষে সওয়াল করার বিরুদ্ধে কংগ্রেস বলেছে, ত্রিভাষা তত্ত্বের সঙ্গে সংঘাতে আসা ঠিক নয়। এতে অসন্তোষ বাড়বে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটা বিচিত্র নয়। তামিলনাড়ুর ডিএমকি নেতা এম কে স্ট্যালিন বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন হিন্দিকে এক ভাষা বলে চিহ্নিত করলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। নইলে তাঁরা আবার ভাষা আন্দোলন শুরু করবেন।

২০১৬ জনগণনা অনুযায়ী ভারতে হিন্দি ভাষাভাষী লােকসংখ্যা ৪৩.৬৩ শতাংশ, তারপরই বাংলা ৮.৩ শতাংশ। তারপর মারাঠি ৬.৮৬, তেলেগু ৬.৭ এবং তামিল ৫.১৭ শতাংশ। সুতরাং বাংলা দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। ভাষা নিয়ে একতরফা কোনও সিদ্ধান্ত নিলে গােল বাঁধবেই, সুতরাং তা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন, ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান… বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’ বিবিধের মধ্যেই মিলন, তার মধ্যেই সম্প্রীতি, তার মধ্যেই ঐক্য! সুতরাং হিন্দি অন্যতম প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে যেভাবে চলছে, চলুক। সেই সঙ্গে আছে ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষা। ভারতীয় সংবিধান, সব ভাষাকেই মর্যাদা দিয়েছে, তা রক্ষা করতে হবে। কোনও ভাষাকেই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়। শিখতে বাধ্য করা নয়।

বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর, অতীতের অনেক কিছুরই পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হয়েছে। ইতিহাসকে মুছে ফেলারও একটা প্রবণতা চলছে। যা অনেককেই যন্ত্রণা দিচ্ছে, মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। নাম পরিবর্তরে হিড়িক চলছে- যেমন সম্প্রতি দিল্লির ফিরােজ শাহ কোটলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে সদ্য প্রয়াত অরুণ জেটলির নামে রাখা হয়েছে। ইতিহাসখ্যাত মােগলসরাই রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে দীনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন করা হয়েছে। এইসব পরিবর্তনে জনসাধারণের যে সমর্থন রয়েছে, তা কিন্তু নয়। কারণ এই মুছে ফেলা নামের সঙ্গে ইতিহাস জড়িত।