দেবাশিস দাস
কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও রাজ্যজুড়ে জেলায় জেলায় ‘বাংলার বাড়ি’ (গ্রামীণ) প্রকল্পে জোরকদমে কাজ চলছে। প্রথম কিস্তির টাকা যাঁরা পেয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সিংহভাগ বাড়ি নির্মাণ কাজে ইতিমধ্যে হাত দিয়েছেন। মাথার উপর পাকা ছাদের স্বপ্ন কে না দেখে? কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এমন মানুষজনের। মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালের বাসস্থানের উপর নির্ভর করে একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকার দিন শেষ হতে চলেছে। বর্ষার সময় জল চুঁইয়ে পড়ে ঘরের ভিতরে। বেশি বৃষ্টি হলে যে কোনও মুহূর্তে বাড়ি ভেঙে পড়তে পারে, এমনই আশঙ্কায় স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত রাত জাগতে হতো প্রান্তিক মানুষজনকে। বর্ষার সময় মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে মানুষের মৃত্যুর খবর কারও অজানা নয়। সে কারণে মাথার উপর পাকা ছাদ কিছুটা হলেও স্বস্তি আনবে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনের জীবনে।
দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারি মানুষজন নতুন করে ভালোভাবে বাঁচার সংজ্ঞা খুঁজে পাবে। ফলে প্রান্তজনের আলোয় ফেরার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে মন ছুঁয়ে গিয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। মমতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ একসময় মাওবাদী আতঙ্কে ত্রস্ত জঙ্গলমহলের অনাহারে থাকা মানুষজন ২ টাকা কেজি দরে চাল এবং রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বদলে গিয়েছে তাঁদের জীবনযাত্রার মান। আর্থ ও সামাজিক অবস্থার এই উত্তরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, চোখে দেখা যায় এমন উন্নয়ন হয়েছে মমতা সরকারের হাত ধরে। উল্লেখ্য, বিগত বাম সরকারের আমলে শেষের দিকে জঙ্গলমহলের মানুষজনের জীবন স্তব্ধ হতে বসেছিল। সেই জায়গা থেকে অতি বামপন্থীদের হঠিয়ে জঙ্গলমহলের শান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করাটা নেহাতই সোজা ছিল না। সেই কাজটা করে দেখিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই জঙ্গলমহলে এবার ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সবাই চাইছে এই প্রকল্পে বাড়ি নির্মাণ করতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন, রং দেখে নয়, প্রকৃত গরিব মানুষ যাতে মাথার উপর পাকা ছাদ পান, তা সুনিশ্চিত করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। কারণ, এর আগে এই প্রকল্পকে ঘিরে বিস্তর অভিযোগ উঠেছিল। এবার তার পুনরাবৃত্তি চায় না মমতা প্রশাসন। রীতিমতো মানবিক মুখ নিয়ে প্রকৃত গরিব মানুষজন যাতে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন, তার জন্য কঠোর নির্দেশ গিয়েছে নবান্নের তরফে। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলার গ্রামীণ এলাকায় এখন বাড়ি তৈরির জন্য স্থানীয় শহরগুলি থেকে ছোট ছোট গাড়ি করে নির্মাণ সামগ্রী, যেমন রড, সিমেন্ট, বালি, চিপস আনা হচ্ছে। গ্রামজুড়ে এখন পাকাবাড়ি নির্মাণকে ঘিরে উৎসবের চেহারা। যাদের এখনও প্রথম কিস্তির টাকা ঢোকেনি, তাঁরাও ব্লক প্রশাসন এবং অঞ্চল প্রশাসনের কর্মী এবং আধিকারিকদের কাছ থেকে খোঁজ নিচ্ছেন কবে তাঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এমন অনেক বুথ রয়েছে, যেসব বুথে ১০০ থেকে ১২০টি বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। একসঙ্গে এতগুলি পাকাবাড়ির কাজ শুরু হওয়ায় রীতিমতো সেই বাড়িগুলির কাজ দেখতে প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। উৎসবের এই আবহে সমস্যাও নেহাতই কম নয়।
কারণ সরকারি এই প্রকল্পে রাজ্যজুড়ে ১২ লক্ষ বাড়ি তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। সুযোগ বুঝে একাংশ অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কথা মাথায় রেখে রড, বালি, সিমেন্ট এবং স্টোনচিপের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হওয়ার আগে নির্মাণ সামগ্রীর যে দাম ছিল, তা আচমকাই কেন বেড়ে গেল, তা বুঝে উঠতে পারছেন না এই প্রকল্পে সুবিধা পাওয়া মানুষজন। এই নিয়ে গ্রামগঞ্জে রীতিমতো আলোচনা শুরু হয়েছে। নির্মাণ সামগ্রীর সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। স্থানীয় প্রশাসনও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল। স্থানীয় মানুষজন বলছেন, এ বিষয়ে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য নির্ধারণ করে না দিলে যে যা পারছে, দাম নিচ্ছে। মওক বুঝে এই ফায়দা তোলার চেষ্টা নিঃসন্দেহে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের নিজের কোষাগার থেকে গরিব মানুষদের জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার উপর অল্পবিস্তর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লে, এই প্রকল্পে যত বর্গফুটের বাড়ি হওয়া প্রয়োজন, তার চেয়ে কিছুটা হলেও ছোট হবে। তৃণমূলস্তর থেকেই এই তথ্য উঠে এসেছে। অবিলম্বে ব্লক প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে সক্রিয় হোক, চাইছে আমজনতা।
উল্লেখ্য, রাজ্য সরকার প্রত্যেক গরিব পরিবারকে বাসস্থান দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যকে মাথায় রেখে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ প্রকল্পে, যার ৪০ শতাংশ অর্থ রাজ্য সরকার দেয়, গরিব মানুষদের সাধ্যের মধ্যে বাসস্থান প্রদানের প্রকল্প ২০১৫-১৬ সাল থেকে শুরু হয়। ২০২১-২২ পর্যন্ত এই স্কিমে ৩৪,১৮,৯৫৯টি বাড়ি তৈরি হয়। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার অন্যায়ভাবে এই প্রকল্পের আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে। এই কারণে, রাজ্যের গরিব মানুষদের প্রতি দায়বদ্ধ রাজ্য সরকার তাদের দুর্দশা দূর করতে সম্পূর্ণ রাজ্যের খরচে ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘বাংলার বাড়ি (গ্রামীণ)’ প্রকল্প চালু করে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ১২ লক্ষ যোগ্য গরিব পরিবারকে পাকাবাড়ি প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য হয়। রাজ্য সরকার এজন্য ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে। এই পর্যায়ের আর্থিক সাহায্যের প্রথম কিস্তি পরিবারপিছু ৬০ হাজার টাকা হারে মোট ৭২০০ কোটি টাকা ইতিমধ্যে ছাড়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় ও সর্বশেষ কিস্তি ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে ছাড়া হবে।
এছাড়া আরও ১৬ লক্ষ অতিরিক্ত যোগ্য পরিবারকে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে এই প্রকল্পের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করতে চলেছে রাজ্য সরকার। এই পর্যায়ের প্রথম কিস্তির টাকা, পরিবারপিছু ৬০ হাজার টাকা হারে এই বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রদান করা হবে। এই উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখছে। এই পর্যায়ের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা বাড়ি নির্মাণের অগ্রগতির ভিত্তিতে প্রদান করা হবে। এছাড়া, আরও আবেদনকারী থাকলে এই প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে একই প্রক্রিয়ায় সেই আবেদনগুলি বিবেচনা করা হবে।