• facebook
  • twitter
Friday, 19 December, 2025

কুমারী পূজায় মুসলিম কন্যা ও স্বামীজি

বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত দুর্গাপূজা হয়। কার্ত্তিক ১৩০৮ (১৯ অক্টোবর ১৯০১) শুরু হয়। সেই বছর অষ্টমীর দিন স্বামীজির অভিপ্রায় অনুসারে গৌরী মায়ের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল কুমারী পূজা। সেই দিন নয়জন কুমারীকে পূজা করা হয়েছিল। একজন কুমারীকে স্বামীজির স্বয়ং পূজা করেছিলেন।

সুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

শারদীয়া দুর্গাপূজাকে ‘মহাপূজা’ বলা হয়। মহাস্নান, পূজা, হোম, বলিদান— এই চারটি পর্বেই মহাপূজা সিদ্ধ হয়। ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যক’-এ দেবী দুর্গা ‘কুমারী’ নামে অভিহিতা। দক্ষিণ ভারতে কন্যাকুমারীর মন্দিরে কুমারী প্রতিমার পূজা দেবী দুর্গারই ঐতিহ্যবাহী। তান্ত্রিক মতবাদের প্রতিফলন ‘কুমারী পূজা’ সব শক্তি পীঠেই হয়।

Advertisement

ঋক বেদের দেবীসূক্তের অসূন-কন্যা বাক ছিলেন ‘কুমারী’, তিনি আদ্যাশক্তির সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন ঈশ্বরী এবং সমগ্রজগতের পিতারও প্রসবিতা। কুমারী কন্যা বাক এর এই অসাধারণ উক্তি শক্তি সাধনার ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী। চণ্ডিতে আমরা দেবী কৌশিকীর কথা পাই, যিনি দোর্দণ্ডপ্রতাপ শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন। দেবী কৌশিকীও ছিলেন ‘কুমারী’।

Advertisement

মহাভারতে ভীস্ম পর্বে অর্জুন ‘দেবী কুমারী’ পূজা করেছিলেন। মহাকাল সংহিতা, মার্কেণ্ডয় পুরাণেও ‘কুমারীর’ উল্লেখ পাওয়া যায়।

মৎস্যপুরাণে ১০১তম অধ্যায়ে নন্দিকেশ্বর রুদ্র কথিত ৬০ রকম ব্রতের কথা বলতে গিয়ে ২৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, নবমীতে একাহারী থেকে শক্তি অনুসারে এক একটি কন্যাকে ভোজন করিয়ে আসেন, স্বর্ণখচিত বস্ত্রদান করার কথা, এটি করলে সমস্ত মহাপাপ নাশ হয়। তন্ত্রসারে বলা হয়েছে, ‘কুমারী ভোজিতা যেন ত্রেলক্যে তেন ভোজিতম।’ অর্থাৎ কুমারীকে ভোজন করালে, ত্রিলোককে ভোজন করানো হয়।

মহাভারতের বিরাট পর্বে যুধিষ্ঠিরকৃত দুর্গাস্তোত্রে বলা হয়েছে, তিনি কুমারী কৌমার্যব্রাতধারিণী এবং ব্রহ্মচারিণী। আদ্যাশষক্তির এই কুমারী রূপে প্রকাশই হিন্দু উপাসনার তন্ত্র এবং পুরাণে কুমারী পূজার উৎস। সেজন্য দুর্গার আর এক নাম ‘কুমারী’।

তন্ত্রসারে এক থেকে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত কুমারীকে পূজার কথা বলা হয়েছে। তবে এও বলা হয়েছে ১০ বছর পর্যন্ত কুমারীকেই পূজা করা উচিত। বয়স অনুসারে কুমারীদের নামকরণেরও উল্লেখ আছে। যেমন এক বছর থেকে ষোলো বছরের কুমারীদের নাম যথাক্রমে, সন্ধ্যা, সরস্বতী, ত্রিধামূর্তী, কালিকা ইত্যাদি। আবার দেবী ভগবতে কুমারীর নামকরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এক বছর বয়সের ‘কুমারী’ পূজার যোগ্য নয়। দুই থেকে দশ বছর কুমারী পূজার যোগ্য। সেখানে দু’বছর থেকে দশ বছর কুমারীর নাম যথাক্রমে ‘কুমারিকা’ (ত্রিমূর্তি) কল্যাণী ইত্যাদি। এবং বিভিন্ন বয়সের কুমারীর পূজায় বিভিন্ন ফল প্রাপ্তির কথাও বলা হয়েছে।

তবে কুমারী পূজার কথা বললেই বেলুড় মঠ, স্বামী বিবেকানন্দর কথা এসে পড়ে। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত দুর্গাপূজা হয়। কার্ত্তিক ১৩০৮ (১৯ অক্টোবর ১৯০১) শুরু হয়। সেই বছর অষ্টমীর দিন স্বামীজির অভিপ্রায় অনুসারে গৌরী মায়ের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল কুমারী পূজা। সেই দিন নয়জন কুমারীকে পূজা করা হয়েছিল। একজন কুমারীকে স্বামীজির স্বয়ং পূজা করেছিলেন। ইতিপূর্বে স্বামীজি ১৮৯০ খৃষ্টাব্দতে গাজীপুরের রায়বাহাদুর গগণচন্দ্র রায়ের দশ বছরের মেয়ে মণিকাকে কুমারী দেবীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। পরবর্তীকালে মণিকা মা যশোদা নামে প্রচার পান।

এই কুমারী পূজা প্রসঙ্গে স্বামীজির এক মুসলিম কন্যাকে কুমারী হিসাবে পূজা করার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এটা বোধ হয় স্বামীজির পক্ষেই সম্ভব। স্বামীজি ছিলেন গুণাতীত মার্গে, ডান সর্ববিধ বিধিনিষেধের উর্ধ্বে। ঘটনাটি ছিল এই রকম। সালটি ছিল ১৮৯৮ স্বামীজিবের হয়েছে প্রবজ্ঞায়। সেটা ছিল আগস্ট মাস। পৌঁছেছেন কাশ্মীরে। সেখান থেকে বারমুল্লায় পৌঁছে তিনি একটি শিকারা ভাড়া নিলেন। শিকারার মাঝি ছিল মুসলমান। মাথায় টুপি, লম্বা দাড়ি। মাঝির সঙ্গে থাকত তার চার বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। সেদিন নৌকায় বসে ভোরবেলা স্বামীজি প্রকৃতির রূপের শোভা দেখছেন। হঠাৎ তিনি ওই ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে তার মধ্যে কী যেন খুঁজে পেলেন।

আধ্যাত্মবাদী স্বামীজি নিজের অন্তরে যেন আগমণি বার্তা শুনতে পেলেন। এই ছোট্ট কুমারী মেয়েটির মধ্য দিয়েই মায়ের পায়ে পৌঁছে দেবেন অঞ্জলি। সেই মুসলমান কাশ্মীরী কুমারী মেয়েটিকে ১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসে ক্ষীর ভবানিতে একটি কুম্ভ রয়েছে সেই কুম্ভের জলেই দেবীর কাল্পনিক পুজো করা হয়েছিল। পুজোর অর্থ হিসাবে নিবেদিত হলো ক্ষীর ও পায়েস। আজ থেকে একশত বছরেরও আগে কুমারী পূজার মাধ্যমে স্বামীজি স্থাপন করেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এক সুন্দর সহাবস্থান।

Advertisement