স্নেহাশিস সুর
পরিবেশ দিবস প্রতি বছরই আসে, আবার চলেও যায়। আমরা কেউ কেউ কোনওভাবে দিনটা পালন করার মধ্যে কিছুটা হলেও ঢুকে পড়ি। কেউ অতটা না করলেও খবরের কাগজ আর পত্র-পত্রিকায় পরিবেশদূষণ নিয়ে লেখাপত্র পড়ি। বিষয়টা নিয়ে কিছু হয়ত ভাবিও বা। তারপর রাত হয়, দিন চলে যায়। আবার আমরা সব ভুলে যাই। কিন্তু বিষয়টা যে ভয়ংকরের দিকে হাতছানি দিচ্ছে, সেটা কি আমরা বুঝি? আমাদের হয়ত ভাবতে ভাল লাগে আরে এতো রাষ্ট্রের ভাবার কথা, সরকারের করার কথা, আমি কি করব? হ্যাঁ, সরকারকে শুধু ভাবলেই চলবে না। আর দেরি নয়। এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু শুধু সরকারি ব্যবস্থা, আইন, জরিমানা, এইসব দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। ভাবতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে এর গুরুত্ব এবং ভয়াবহতার কথা। অভ্যাস বদল করতে হবে আমাকে, আপনাকে, সকলকে। তবেই পৃথিবীকে আগামীদিনের শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হবে। না হলে সে আমাদের ক্ষমা করবে না। পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই। তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এটা বুঝতে হবে সকলকে।
আমরা কি জানি আমাদের প্রিয় শহর কলকাতা জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে থেকে কত ভয়ঙ্কর সংকটের দিকে এগোচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কলকাতা শুধু দক্ষিণপূর্ব এশিয়ারই নয়, সারা বিশ্বের মধ্যে পরিবেশগত দিক দিয়ে অন্যতম সমস্যাসংকুল শহর। রাষ্ট্রসঙ্ঘের অন্তর্গত ইন্টার গভর্মেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৮০ সাল নাগাদ কলকাতা শহরের গড় তাপমাত্র ১৯০০ সালের তুলনায় বাড়বে প্রায় সাড়ে চার ডিগ্রি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৪৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং এর থেকে উষ্ণায়ণের পরিমাণের একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। কি ভয়ঙ্করই না হবে পরিস্থিতি, আর জনজীবন। আরও একটি পরিসংখ্যান বলছে পশ্চিমবঙ্গ ২০৫০ সালের মধ্যে পরিবেশের দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে ৬০তম সমস্যাসংকুল শহর হবে। শুধু তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে জনজীবন অতীষ্ঠ হয়ে ওঠার ব্যাপার নয়, নেমে আসবে ঘূর্ণীঝড়সহ আরও কত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এর ফলে যে কতটা ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে এটা জেনে যে, কেবল ২০১৯ থেকে ২১ এই দুবছরের মধ্যে বুলবুল, আম্ফান এবং ইয়াস ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল আম্ফানে কলকাতা শহরাঞ্চলেই ক্ষতির পরিমান ছিল ১,৩৫০ কোটি টাকা।
এছাড়া, বিশ্বব্যাঙ্কের অপর এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে কলকাতা হচ্ছে পৃথিবীর উপকূলবর্তী শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপদসংকুল। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কলকাতায় গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমণের পরিমাণ এবং অন্যান্য দূষিত গ্যাসের নির্গমণ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেক করতে হবে এবং এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোনর জন্য এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা পুরসভা ইতিমধ্যেই বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস (ক্ষতিকারক) গ্যাস ঢোকা এবং তা বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে সমতা আনার বিষয়টিতে কলকাতা পুরসভা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। এটা পরিবেশ রক্ষার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র শহর, যে শহরে কয়লাসহ অন্যান্য জীবাস্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এবং পূনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য ২০২২ সালে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। পরের বছরেই অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে কলকাতা পুরসভা পরিবেশ রক্ষা তথা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার নাম ‘কলকাতা ক্লাইমেট একশন প্ল্যান’ বা সংক্ষেপে কে-ক্যাপ। আশার কথা দুবছরের মধ্যেই এর অন্তর্গত বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে অর্থাৎ ৫ জুন, ২০২৫ কলকাতার ঐতিহাসিক টাউন হলে এক অনুষ্ঠানে এই পরিকল্পনার খসড়া রূপরেখাটি প্রকাশ করেন কলকাতার মহানাগরিক এবং পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরাদ হাকিম। আরও একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, এই বিস্তারিত পরিকল্পনাটি কোনো একটি সংস্থাকে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে করানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন সংস্থা এতে সামিল হয়েছে এর অংশীদার হিসেবে এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের কৃতি মানুষরা তথা বিশেষজ্ঞরা এর মূল কমিটিতে আছেন যাঁরা এর রূপরেখা তৈরি করেছেন। যেসব সংস্থা এর অংশীদার তার মধ্যে রয়েছে এনভারন্মেন্ট গভর্ণড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশন বা সংক্ষেপে এনজিও, কানসা বা ক্লাইমেট একশন নেটওয়ার্ক, সাউথ এশিয়া, যারা পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করা বিভিন্ন অসরকারী সংস্থাগুলির একটি সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান। এছাড়া রয়েছে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স, অবসারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, ক্লাইমেট ট্রেন্ডস সংস্থা এবং জনগণ যাতে এ বিষয়ে সঠিকভাবে জানতে পারেন, তার জন্য প্রচারের কাজে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের এই বিষয়ে সামিল করার কাজে এর আরেক অংশীদার হচ্ছে প্রেস ক্লাব, কলকাতা।
এই উদ্যোগে যেমন কলকাতার মহানাগরিক ও রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরাদ হাকিমের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে তেমনি এর সঙ্গে যুক্ত কলকাতা পুরসভার দুই মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার ও স্বপন সমাদ্দার। এছাড়া মূলত যাঁর চেষ্টায় এই পরিকল্পনার সূচনা এবং এই খসড়া কর্ম পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি হয়েছে তিনি হলেন পরিবেশকর্মী ও বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ড. জয়ন্ত বসু। তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে একসঙ্গে করে নিখরচায় শুধু কলকাতা শহরের প্রতি দায়িত্ব এবং ভালোবাসার বন্ধনে যুক্ত হয়ে এই রূপরেখা তৈরির কাজ্য অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। এরপর সংশ্লিষ্ট সকল গোষ্ঠী তাদের নিজনিজ ক্ষেত্রে কীভাবে এই খসড়া রূপরেখায় বর্ণিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। তারপর সকলের সম্মিলিত বক্তব্যকে অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি হবে চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা। এরপর শুরু হবে সেই অনুযায়ী এর বাস্তবায়ন। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কিভাবে জোগাড় হবে তারও একটা উল্লেখ এই রূপরেখায় রয়েছে। সদিচ্ছা এবং অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে হবে এই কর্ম পরিকল্পনার রূপায়ণ, যাকে মহানাগরিক আখ্যা দিয়েছেন কলকাতার বাঁচার রূপরেখা। তিনি বলেছেন এটা কেবল কলকাতা ক্লাইমেট একশন প্ল্যান নয়, এটা আসলে কলকাতার সারভাইভাল প্ল্যান।
এই পরিকল্পনায় মোট তিরিশটি ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে। যার মধ্যে শুরুর দিকেই রয়েছে শিল্প সংস্থা থেকে দূষিত গ্যাসের নির্গমণ বন্ধ করা, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সংরক্ষণ, উষ্ণায়ণ রোধের কর্মপরিকল্পনা, বস্তির পরিকাঠামোগুলিকে জলবায়ু অনুসারী করা, কাঠ সহ অন্যান্য বায়োমাস জ্বালানো বন্ধ করা, আরও বেশি করে সৌরশক্তির ব্যবহার প্রভৃতি। এই তিরিশটি ক্ষেত্রে সক্রিয় এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে কলকাতার পরিবেশকে বাঁচিয়ে শহর কলকাতাকে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
অবশ্য ইতিমধ্যেই কলকাতা শহর বায়ুদূষণ রোধে একটি শিরোপা পেয়েছে। বাতাসে পিএম-১০ ধূলিকণার পরিমাণ কমিয়ে শহরের বায়ুমণ্ডলের গুণমান বাড়াতে সক্ষম হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ১৫ কোটি টাকার উৎসাহ ভাতা পেয়েছে। সুতরাং পরিবেশ রক্ষার বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতির তাৎক্ষণিকতা না থাকলেও, কলকাতা পুরসভা এই শহরকে বাঁচাবার এক দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিয়েছে। যার সুফল পাবেন ভবিষ্যতের নাগরিকরা।