• facebook
  • twitter
Sunday, 20 July, 2025

পরিবেশ গবেষণার অন্ধকার দিক: নীতিহীনতা এবং পক্ষপাত

গবেষণা সংস্থাগুলির সর্বদা তহবিলের উৎস এবং সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকাশ করা উচিৎ। স্বাধীন পি আর রিভিউ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত, বিশেষ করে উচ্চ-প্রভাবশালী প্রকাশনার জন্য।

প্রতীকী চিত্র

ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়

বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আবার বেশ কিছু নতুন নতুন গবেষণা ও তার ফলাফল আমাদের সামনে তুলে ধরে আমাদের এক ধরণের টেকসই যাপনে উৎসাহিত করা হবে। তারপর?

জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ে টেকসই গবেষণা প্রায়শই নিজেকে আশার আলো হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু আমাদেরকে সবুজ ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করার জন্য যে “সবুজ” গবেষণাটি হয় তা নিজেই যখন ত্রুটিপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট, এমনকি গবেষণার ফলাফলকেই যখন হেরফের করানো হয় তখন, এ “সবুজ” এর কি শ্যামলিমা থাকে?

যদিও বেশিরভাগ পরিবেশগত গবেষণার পিছনে উদ্দেশ্য মহৎ, এবং সমস্ত পরিবেশগত গবেষণা সমানভাবে তৈরি করা হয় না,তবু নীতিগত তদারকি, তহবিলের পক্ষপাত এবং ডেটা হেরফের প্রবণতা জলবায়ু এবং টেকসই গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর ছায়া ফেলছে।

সবুজ বিশ্বের লক্ষ্য কি পরিষ্কার তথ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে—নাকি লুকানো এজেন্ডা দ্বারা? এই লেখায়, আমরা সবুজ গবেষণার ঘোলাটে জলরাশি অন্বেষণ করে, নীতিশাস্ত্রের কোথায় কখন কোন ঘাটতি ধরা পড়ে তা পরীক্ষা করব এবং স্বচ্ছতা এবং সততা প্রচারের জন্য কার্যকর কৌশল কি ভাবে অবলম্বন করা যায় তা বুঝতে চেষ্টা করব।

প্রথমেই আমাদের জানতে হবে সবুজ গবেষণা কি বা এটি কী রকম হওয়া উচিত?
সবুজ গবেষণা হল, মূলত পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, সংরক্ষণ, টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু বিজ্ঞান এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলির নিয়ে গবেষণা মূলক আলোচনা। আদর্শভাবে, এই গবেষণা নীতিমালা তৈরি করে, ভোক্তাদের আচরণ গঠন করে এবং কর্পোরেশনগুলিকে ESG (পরিবেশগত, সামাজিক এবং শাসন) নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সাহায্য করে। আবার একই সাথে পরিবেশ সচেতনতার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতেও সাহায্য করে। বর্তমানে সারা পৃথিবী জুড়ে এই ক্ষেত্রে তহবিল, প্রতিপত্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ঢেউ এসেছে। তাই এত কিছু ঝুঁকির মুখে থাকা সত্ত্বেও, কৌশলগত বা আর্থিক লাভের জন্য গবেষণার ফলাফলগুলিকে প্রভাবিত করার প্রলোভনও ক্রমবর্ধমান।

টেকসই উন্নয়ন ও যাপন অধ্যয়নে নীতিশাস্ত্রের ব্যবধান, তহবিল প্রভাব এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব অনেক। পরিবেশগত গবেষণায় অনেক সময়ই কর্পোরেশন, সরকার বা স্বার্থান্বেষী লবির গ্রুপ দ্বারা অর্থায়ন করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলি পূর্ববর্তী দশকে ১০০ টিরও বেশি সমকক্ষ-পর্যালোচিত গবেষণায় অর্থায়ন করেছিল, প্রায়শই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলিকে ছোট করে দেখানোর জন্য। যখন তহবিলদাতারা নিজের জন্য অনুকূল ফলাফল আশা করেন, তখন গবেষকরা সচেতনভাবে প্রত্যাশার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতি বা ব্যাখ্যাগুলি তুলে ধরেন, যা গবেষণার বস্তুনিষ্ঠতাকে দুর্বল করে এবং জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করে।

তাই, গবেষণা সংস্থাগুলির সর্বদা তহবিলের উৎস এবং সম্ভাব্য স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রকাশ করা উচিৎ। স্বাধীন পি আর রিভিউ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত, বিশেষ করে উচ্চ-প্রভাবশালী প্রকাশনার জন্য।

চেরি-পিকিং ডেটা এবং নিশ্চিতকরণ পক্ষপাত এই গবেষণার বড়ো দুর্বলতা। অন্য যে কারোর মতো গবেষকরাও বিভিন্ন সময় পক্ষপাতের শিকার হন – ফলসরূপ তাঁদের, পূর্ব-বিদ্যমান বিশ্বাসকে সমর্থন করে এমন ডেটার উপর মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পরিবেশগত গবেষণায়, এটি পরস্পরবিরোধী—- যা ফলাফল বাদ দিতে পারে, সিদ্ধান্ত এবং সুপারিশগুলিকে বিকৃত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, টেকসই যাপন নির্ভর প্রতিবেদনগুলি কার্বন অফসেট অর্জনগুলিকে তুলে ধরতে পারে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান জল ব্যবহার বা সরবরাহ যে শৃঙ্খল নির্গমনকে ব্যাহত করতে পারে,তা দেখায় না। ফলে এই উপস্থাপনা অগ্রগতির একটি বিকৃত চিত্র তুলে ধরে।

বাস্তব উদাহরণ দিলে ধারণাটি আরও স্বচ্ছ হবে। বেশ কিছু ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের টেকসইতা অনুশীলনগুলিকে শুধুমাত্র প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত করার জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষ করে তৃতীয় পক্ষের করা অডিটগুলি তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত ক্ষতি তুলে ধরে। তাই, সম্ভব হলে সকল তথ্য জনসাধারণের কাছে উপলব্ধ হওয়া উচিত এবং পদ্ধতিগুলি প্রতিলিপিযোগ্য হওয়া উচিত। ত্রুটি বা পক্ষপাত সনাক্ত করণের মূল চাবিকাঠি হল প্রতিলিপি অধ্যয়নে সকলকে উৎসাহিত করা।

ডেটা ম্যানিপুলেশনও এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি যা ফলাফলকে শুধু ভালো বলে। তাছাড়াও আছে গবেষণার মাধ্যমে গ্রিনওয়াশিং যা কেবলমাত্র বিপণনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় – এক্ষেত্রে গবেষণা নিজেই নিজেকে পরিবেশ-বান্ধব বলে। দাবিগুলি যাচাই করার জন্য অস্ত্র হিসেবে গবেষণা ব্যবহার হয় না , তাই পণ্যটি যাচাই-বাছাইয়ের অধীনে টিকে থাকে না। এটি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য জীবন-চক্র বিশ্লেষণে (LCA), যেখানে কৌশলগত ডেটা বর্জন বা অবাস্তব অনুমান একটি পণ্যকে তার চেয়ে সবুজ দেখাতে পারে। উদাহরণ সরূপ: একটি কোম্পানি গবেষণার ফল প্রকাশ করে দেখাতে পারে যে তার প্যাকেজিং ১০০% পুনর্ব্যবহারযোগ্য, কিন্তু, সেটা যে স্থানীয় পুনর্ব্যবহারযোগ্য অবকাঠামো উপাদান প্রক্রিয়া করতে পারে না তা প্রকাশ না করে।
ভুতুড়ে কিছু লেখাপত্র এবং তৃতীয় পক্ষের গবেষণাপত্র কিছু ক্ষেত্রে, কোম্পানিগুলিকে তাদের স্থায়িত্বের দাবিতে সমর্থন করে। এমন “স্বাধীন” গবেষণাপত্র তৈরির জন্য পরামর্শদাতা সংস্থাগুলিকে নিয়োগ করে কিছু কোম্পানি। এই ভুতুড়ে গবেষণাপত্রগুলিতে প্রায়শই সম্মানিত শিক্ষাবিদদের নাম থাকে তবে এগুলি মূলত জনসংযোগের হাতিয়ার হিসাবে ডিজাইন করা হয়। এই অনুশীলনটি, যদিও সর্বদা অবৈধ নয়, তবুও এটা গবেষণার অখণ্ডতার সাথে মারাত্মকভাবে আপস করে এবং নীতিনির্ধারক এবং ভোক্তা উভয়কেই বিভ্রান্ত করে।

তাই লেখক অধিভুক্তি করন এবং পি আর রিভিউ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই জায়গায় স্বচ্ছতা আনা আবশ্যক।
আলোচনা যথাযোগ্য হতে হবে। স্বনামধন্য জার্নাল এবং সম্মেলনগুলির মান এই কারণেই কঠোর করা উচিত এবং অপ্রকাশিত তৃতীয় পক্ষের অবদান প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।

টেকসই শিক্ষায় নীতিশাস্ত্র প্রশিক্ষণ (Value education) অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত, পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রোগ্রামগুলিতে গবেষণায় নীতিশাস্ত্র প্রনয়ন, পক্ষপাত মুক্ত পাঠক্রম এবং দায়িত্বশীল ডেটা সমৃদ্ধ মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও সমর্থন করতে হবে, কর্পোরেট প্রভাব কমাতে। অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠতাকে অগ্রাধিকার দেয় এমন এনজিও এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সমর্থন করা উচিৎ হবে। সরকার এবং জনহিতকর সংস্থাগুলিকেই স্বাধীনভাবে পরিবেশ গবেষণার জন্য অর্থের যোগান দিতে হবে, আর এতেই বেসরকারি অংশীদারদের উপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে।
অখণ্ডতার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারি ডেটাসেটের পরিবর্তনগুলি ট্র্যাক করার এবং অসঙ্গতিগুলি সনাক্ত করার উপায় হিসাবে ব্লকচেইন এবং এআই-ভিত্তিক যাচাইকরণ সরঞ্জামগুলি বর্তমানে আবির্ভূত হচ্ছে। এগুলি প্রকাশনা প্রক্রিয়ায় নজরদারিকারী হিসাবে কাজ করতে পারে।

এই সব শোনার পর মনে হতেই পারে, আমরা কি সত্যি সবুজ গবেষণার উপর আস্থা রাখতে পারি? টেকসইতার লক্ষ্য, অস্থির তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা নীতি নিয়ে হতে পারে না।

অথচ, এই ক্ষেত্রটি যত প্রসারিত হচ্ছে ততই স্বচ্ছতার অভাব প্রকটিত হচ্ছে। গবেষণা নীতিগত ভাবে স্বচ্ছ এবং বিশ্বাসযোগ্য থাকবে তা নিশ্চিত করা দরকার। যদি সবুজ গবেষণাকে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে প্রথমে এটিকে নিজের ঘর পরিষ্কার করতে হবে। আপনি যে গবেষণাটি পড়ছেন – বা পরিচালনা করছেন – তা নিশ্চিত করার জন্য আপনি কী পদক্ষেপ নেবেন যাতে তা সত্যিই সবুজ হয়, কেবল সবুজায়ন করা নয়!

প্রথমত অন্ধকার দিক প্রশমিত করা অর্থাৎ নীতিগত সবুজ গবেষণা করার জন্য পি আর রিভিউ এবং ওপেন ডেটা নীতিমালা শক্তিশালী করা দরকার। একাডেমিক জার্নাল এবং গবেষণা প্ল্যাটফর্মগুলিকে কঠোর পি আর রিভিউ প্রয়োগ করতে হবে এবং ওপেন-অ্যাক্সেস ডেটায় উৎসাহিত করতে হবে। ওপেন সায়েন্স ফ্রেমওয়ার্ক (OSF) এবং জেনোডোর মতো প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার করে স্বচ্ছতা এবং পুনরুৎপাদনযোগ্যতা প্রচার করতে হবে।

তবেই আপনার আমার মত সাধারণ মানুষ সবুজায়নের পথা আস্থা রাখবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে আমাদের মধ্যে ৮৯% মানুষ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে চায়, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে যে তারা সংখ্যালঘু।

তাদের জলবায়ু-বান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য একটি সামাজিক টিপিং পয়েন্ট উন্মোচন করতে পারে এবং জলবায়ু কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত নেতাদের খাতে ঠেলে দিতে পারে, যা বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

এই ৮৯% সারাদিন কথা বলতেই পারে, কিন্তু যদি অভিজাত মালিক শ্রেণী তা শুনতে পায় না, তখন অন্যান্য ব্যবস্থা ক্রমশ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রিস হেজেস বলেন, শান্তিপূর্ণ অহিংস উৎখাতকে “কাগজ অভ্যুত্থান” বলা হয়, একটি ভাঙা, অকার্যকর, দুর্নীতিগ্রস্ত, জঙ্গী পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে থামানোর জন্য (হেনরি গিরোক্সের ক্যাসিনো ক্যাপিটালিজম বইটি এই কথাই বলে)। সংক্ষেপে, আমাদের প্রথমে মুনাফার উদ্দেশ্য শেষ করতে হবে। যদি আমরা মুনাফার উদ্দেশ্য শেষ না করি, তবে এটি আমাদের শেষ করে দেবে। আমরা অভাব-পরবর্তী সময়ে পৌঁছাতে পারি, তবে সেখানে পৌঁছাতে এবং ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি থামাতে আমাদের বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান হতে হবে। আপনি কি বাসযোগ্য ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তন তৈরি করতে যাচ্ছেন? যদি তাই হয়, তাহলে এখনই পদক্ষেপ নিন।