বরুণ দাস
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই ভারতবর্ষ। আজ থেকে সেই সুদূর অতীতে উচ্চারণ করেছিলেন এক ভিনদেশি বণিক। যার আবেদন আজও সমানভাবে রয়েছে। ভিনদেশির দূরদৃষ্টি তো বটেই, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতাও আমাদেরকে তাজ্জব করে। তার পর্যবেক্ষণ-শক্তির তাৎপর্য আমাদেরকে বিস্মিত করে বৈকি। হ্যাঁ পাঠক, অতিরঞ্জিত কোনও কথা নয়, আবেগজনিত কোনও অভিব্যক্তিও নয়, বাস্তবের কঠিন পটভূমিতে পা রেখেই আমরা একথা উচ্চারণ করছি। আসলে উচ্চারণ করতে বাধ্য হচ্ছি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Advertisement
অনেকে হয়তো প্রশ্ন করবেন, বাস্তবের কঠিন পটভূমি বলা হচ্ছে কেন? হ্যাঁ, বাস্তবের কঠিন পটভূমিই বটে। স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরেও আমাদেরকে এমন ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে! প্রশ্ন জাগছে, এ কোন সকাল যা রাতের চেয়েও অন্ধকার! একোন সময়, যা অবক্ষয়ের শেষধাপে এসে দাঁড়িয়েছে? একোন অনাকাঙ্ক্ষিত আবহ যা ক্রমাগত বিষাদের স্বরলিপি নির্মাণ করে চলেছে? একোন মানুষ যারা মানুষ তথা নিরপরাধ সহ নাগরিকদেরই চরম সর্বনাশ ডেকে আনতে মোটেও পিছপা নয়?
Advertisement
এমন আরও অনেক অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এদেশের ব্যবসায়ী তকমাধারী একদল (অ) মানুষ যারা পুঁজি ও মুনাফার বাইরে অন্যকিছু ভাবতে বা বুঝতে একেবারেই নারাজ! ক্রেতাদের জীবন নয়-মৃত্যু ঘটিয়ে অতিরিক্ত মুনাফাই যাদের প্রথম ও শেষকথা! ব্যবসার নামে লাভ আর লোভই যাদের একমাত্র লক্ষ্য! বনের হিংস্র পশুদেরও নির্বিকল্প লজ্জা দেবে যাদের জীবননাশক কর্মকাণ্ড। যারা পুরাণে বর্ণিত সাক্ষাৎ যমদূতের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর! যাদেরকে মৃত্যুর কারবারি বললেও হয়তো কম বলা হয়।
প্রিয়পাঠক, দয়া করে ধৈর্য হারাবেন না। উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধের নান্দীমুখে এসব অপ্রিয় কথা উচ্চারণ করতে বাধ্য করাচ্ছে এদেশের ব্যবসায়ী নামের কতিপয় মানুষ যারা শারীরিক দিক দিয়ে মানুষের চেহারা পেলেও চরিত্র পায়নি। তাই মানুষের আকার পেলেও আসলে নির্ভেজাল অ-মানুষ। যে যাই বলুন না কেন, এদেরকে পৃথিবীর কোনও কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না। একমাত্র নরখাদক হিসেবেই হয়তো আখ্যা দেওয়া যায়। এই নৃশংস নরখাদকেরা শুধু মনুষ্য সমাজেরই নয়, গোটা বিশ্বেরই কলঙ্ক।
এবার আসা যাক নিবন্ধের মূল বিষয় প্রসঙ্গে। যদিও ওপরের কথাগুলো মূল বিষয়ের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। গত ৫ মার্চ সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে একটি ভয়ঙ্কর খবর নজরে এসেছে আমাদের অনেকেরই। যে পিলে চমকানো সর্বনাশা খবরটি ‘প্রথম শ্রেণির বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পাওয়ার কথা, খেলা আর রাজনীতির যৌথ চাপে তা স্থান পেয়েছে ওই সংবাদপত্রের ৮ পৃষ্ঠার মাঝামাঝি স্থানে ৬-৭ কলামে। কলকাতা বিভাগে। যদিও এ রাজ্যের অন্যান্য সংবাদপত্রে গুরুত্ব পেয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি।
সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘গুণমানের পরীক্ষায় পাশ করতে ব্যর্থ দেশের ১৪৪টি ওষুধ।’ খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বাজার থেকে সংগ্রহ করা ওষুধের নমুনা পরীক্ষার পরে অনুত্তীর্ণ হওয়া ওষুধের তালিকা প্রকাশ করেছে সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (বা সংক্ষেপে সিডিএসসিও)। অনুত্তীর্ণ হওয়া ওষুধের ওই তালিকা দেখে সবার চোখ একেবারে ছানাবড়া! কেন আমাদের চোখ ছানাবড়া? কারণ অনুত্তীর্ণ হওয়া ১৪৪টি ওষুধের ওই দীর্ঘ তালিকার মধ্যে আছে জীবনদায়ী সব ওষুধও !
যেমন উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদরোগের ওষুধ। যে কারণে বা রোগে আক্রান্ত মানুষ চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে-সেই রোগের প্রতিকারের জন্য ব্যবহৃত ওষুধে ভেজাল! অর্থাৎ সহজ করে বলা যায়-যে ওষুধ রুগিকে সুস্থ করে তোলার কথা, সেই ওষুধ রুগির মৃত্যু ডেকে আনতে পারে! মানুষ কোন ভরসায় ওষুধ ব্যবহার করবেন? অসুখ নিরাময়ের বদলে সংশ্লিষ্ট ওষুধ যদি অসুখকেই ত্বরান্বিত করে তোলে-তারচেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী আছে! আমাদের অনিবার্য আফসোস ঠিক এখানেই।
ছাড়াও অনুত্তীর্ণ হওয়া ১৪৪টি ওষুধের ওই দীর্ঘ তালিকার মধ্যে আছে জ্বর, মাথাব্যথা, গ্যাস-অম্বল, যকৃৎ, স্ত্রী-রোগ, স্নায়ুরোগ, রক্ত তরল রাখা, নিউমোনিয়া, থাইরয়েড, শিশুদের সর্দি-কাশি, গলা, ত্বক ও রেচনতন্ত্রের সংক্রমণ, রক্তপাত বন্ধের ওষুধ, মলম, সিরাপ, ইনজেকশন এবং অ্যান্টিবায়োটিক সহ বিভিন্ন রোগের দরকারি ওষুধ। যা প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা নার্সিংহোম বা প্রাইভেট চেম্বারে আসা রুগিদের লিখে বা প্রেসক্রাইব করে থাকেন চিকিৎসকেরা।
ওষুধের দোকান থেকে কিনে ব্যবহার করে থাকেন সংশ্লিষ্ট রুগিরা। চিকিৎসক (সাধারণ কিংবা বিশেষজ্ঞ) তো বটেই, সাধারণ-অসাধারণ রুগিদেরও জানা-বোঝার কথা নয় ডাক্তারের লিখে দেওয়া ওষুধের গুণগত মান। জানি না, খুচরো বিক্রির ওষুধের দোকানগুলো এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল কিনা। যদিও তাঁদের পক্ষে জানা হয়তো অসম্ভব নয়। কারণ বেশি ছাড় পেলে তারা অনায়াসেই একাজে লিপ্ত হতেও পারে। ক্রেতার ক্ষতির সঙ্গে বিক্রেতার লাভের দিকটি যে জড়িত। ফলে ঢালাও ব্যবহার হয়ে আসছে ওষুধগুলো।
বলা বাহুল্য, পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালের রিঙ্গার্স ল্যাকটেট স্যালাইনের নামও রয়েছে ওই তালিকায় যা নিয়ে কিছুদিন আগেই রাজ্য জুড়ে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে চোপড়ার সোনাপুরে তিনমাইলহাটে রিসার্স ল্যাকটেট স্যালাইনের গুণমান নিয়ে অভিযোগ ওঠে। এছাড়া মেদিনীপুর সরকারি হাসপাতালেও একইসঙ্গে অনেক প্রসূতির অসুস্থ হয়ে পড়া এবং মৃত্যুর ঘটনাতেও তোলপাড় হয় ওই স্যালাইনের ব্যবহার নিয়ে। যদিও সরকারি তরফে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় চিকিৎসকের গাফিলতি দেখিয়ে।
এখন অবশ্য বোঝা যাচ্ছে, গুণগত মানে পিছিয়ে পড়া ওই ভেজাল স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে ব্যবহারের পরই সংশ্লিষ্ট প্রসূতিরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এমন কি, অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল। রাজ্যের অধিকাংশ চিকিৎসক সংগঠনেরই অভিমতও ছিল তাই। বলাবাহুল্য, কোনও কোনও হাসপাতাল আগেই বাতিল করেছিল মৃত্যু ডেকে আনা ওই ভেজাল স্যালাইন। প্রিয়পাঠক, ভাবুন তো একবার, রাজ্যের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কী এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা? এর থেকে পরিত্রাণের পথ কোথায়?
খবরে প্রকাশ, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বাজার থেকে ওই সমস্ত ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (বা সংক্ষেপে সিডিএসসিও)-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকেরা। এরপর পর্যায়ক্রমে সেগুলো বিভিন্ন রাজ্যের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করানো হয়। প্রায় একমাস ধরে সেই প্রক্রিয়া চলার পর পরীক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত রিপোর্ট জমা পড়ে কেন্দ্রের ড্রাগ কন্ট্রোল কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপরই জানা যায় ওই ভয়ঙ্কর তথ্য-অর্থাৎ অনুত্তীর্ণ ১৪৪টি ওষুধের কথা।
গুণগত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া ওই ১৪৪টি ওষুধের কোম্পানি কোথাকার? একবার চোখ বুলিয়ে নিই আমরা। ‘এগিয়ে থাকা’ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তরবলয়ের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, দেরাদুন, হরিয়ানা, দক্ষিণের তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, হায়দ্রাবাদ সহ মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমের মহারাষ্ট্র, এমন কি, আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য খোদ গুজরাত! এছাড়া ‘সমাজতান্ত্রিক’ চিনের (যারা সস্তায় এদেশে ওষুদের সিংহভাগ কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকে) একাধিক সংস্থার তৈরি ওষুধও রয়েছে এই অনুত্তীর্ণ তালিকায়।
প্রিয়পাঠক, কোথায় যাবেন আপনি? উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম-বিশাল এই দেশের যেদিকে চোখ রাখবেন-সেদিকেই নির্ভেজাল ভেজালে ভরা। অনেকে হয়তো অবাক হচ্ছেন এই অনুত্তীর্ণ তালিকায় আমাদের পাশের রাজ্য বিহার, ঝাড়খন্ড বা ওড়িশার নাম না দেখে। আমরা জানি না, ওই রাজ্যগুলি থেকে ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল কিনা। কারণ সদ্য প্রকাশিত হওয়া সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (বা সংক্ষেপে সিডিএসসিও)-এর তালিকায় তার কোনও উল্লেখ নেই। ফলে মন্তব্য নিষ্প্রযোজন।
সূত্রে আরও প্রকাশ, মোট ১৪৪টি ওষুধের মধ্যে কর্ণাটকের বাজার থেকে সংগৃহীত পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালের ১৬টি ব্যাচের রিসার্স ল্যাকটেট রয়েছে। সেগুলোর পরীক্ষা হয়েছিল কর্ণাটকের পরীক্ষাগারে। অন্য দুটি ব্যাচের পরীক্ষা হয়েছিল গুয়াহাটি পরীক্ষাগারে। যদিও এখন পর্যন্ত আমাদের রাজ্য সরকার ‘গভীর ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ তোলেননি। রাজ্যকে ‘হেনস্থা করার চক্রান্তে’ কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাননি। তবে সেই ‘সম্ভাব্য লগ্ন’ যে একেবারে পেরিয়ে গেছে তা কিন্তু এখনও হলফ করে বলা যায়না।
অন্যদিকে মোট ১৪৪টি ওষুধের মধ্যে কলকাতার পরীক্ষাগারে ফেল করেছে ২৬টি ওষুধ। তাঁর মধ্যে আবার দুটি বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের দুটি ওষুধও রয়েছে। এমন কি, এ রাজ্যের সুপরিচিত সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালের তৈরি একটি অ্যান্টি ব্যাক্টিরিয়াল ইনজেকশনও রয়েছে। কী জটিল পরিস্থিতি। কলকাতার পরীক্ষাগারে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘনিষ্ঠ কোনও ফার্মাসিস্ট (পরীক্ষক) নেই তো! বলা তো যায় না; যেভাবে তারা গোটা দেশটাকে আগ্রাসীভাবে কব্জা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে!
সেন্ট্রাল ড্রাগ স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (বা সংক্ষেপে সিডিএসসিও)-সূত্রে জানা গেছে, ফেল করা ওষুধগুলোর কোনওটিরও গুণগত মান ঠিক নেই, কোনওটিতে মিলেছে ব্যাক্টিরিয়া, আবার কোনও ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে পরিশোধন প্রক্রিয়া ঠিকভাবে মানা হয়নি। এও জানা গেছে, একটি-দুটি রাজ্য নয়, প্রায় ১১টি রাজ্যের পরীক্ষাগারেই সংগৃহীত ওষুধের নমুনাগুলোর গুণমান পরীক্ষা করানো হয়। যাতে এ নিয়ে পরে কোনও রকম অনাকাঙ্ক্ষিত সন্দেহ-সংশয়, বিতর্ক বা সমালোচনার মধ্যে পড়তে না হয়।
এখন প্রশ্ন, হল, গুণগত মান থেকে অনুত্তীর্ণ বা বাতিল হওয়া এই ক্ষতিকর ওষুধগুলোই ঘুরপথে আবার ফিরে আসবে নাতো বাজারে। যেমন মেয়াদ উত্তীর্ণ অনেক ওষুধই মেয়াদ বাড়িয়ে ঘুরপথে বাজারে ফিরে আসে এবং ঢালাও বিক্রি হয়। ক্রেতা সাধারণ তা বুঝতে পারেন না। বোঝা সম্ভবও নয়। তারা ব্যবহার করেন এবং তাতে অনেক সময়েই কাজ হয় না অর্থাৎ রোগ তো সারেই না এবং অনেক সময়ে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওই ওষুধে রুগির বিরূপ ক্রিয়াও হয়ে থাকে। এঘটনাও আমাদের অনেকেরই কমবেশি জানা।
Advertisement



