যে পুলিশ একজন শিক্ষকের পেটে লাথি মেরেছিল কসবায় ডিআই অফিসের সামনে চাকরিহারাদের বিক্ষোভের সময় তাঁর বিবেক এখন তাঁকে দংশন করছে কিনা আমরা তা জানি না। তবে তাঁর এই অপকীর্তির জন্য শিক্ষক এবং শিক্ষাব্রতী মহলে মহলেতিনি ধিকৃত ও নিন্দিত হচ্ছেন। চাকরিহারারা প্রায় সাত বছর চকরি করার পর তাঁদের চাকরি চলে গেল।
সুতরাং তাদের সংসার অচল হয়ে পড়ল। সন্তান-সন্ততির পড়াশুনা, সংসার চালানোর খরচ, পরিবরের অসুস্থ কেউ থাকলে তার চিকিৎসার খরচ কীভাবে চলবে তা জেনে তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাই তাঁরা ডিআই অফিসের সামনে বিস্থোভ দেখাতে গিয়েছিলেন— জানতে তাঁদের ভবিষ্যৎ কী? প্রথমে বিক্ষোভরত শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের কথা কাটাকাটি, পরে ধস্তাধস্তি— তারপর তা সংঘর্ষের রূপ নেয়। পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠ শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠি চালায়। একজন পুলিশ অতি সক্রিয় হয়ে একজন শিক্ষকের পেটে লাথি মারে— অপর এক পুলিশ তাঁকে লাঠিপেটা করে। এই চাকরি হারারা যতই পুলিশের সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পড়ুন না কেন, তাঁদের এভাবে লাঠিপেটা করা পুলিশের অত্যন্ত গর্হিত কাজ। পুলিশের এই আচরণের নিন্দা করার আমাদের ভাষা নেই। কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তারা নিশ্চয়ই পেটে লাথি মারাকে সমর্থন করেন না।
একজন শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় এবং পূজনীয়। তিনি ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করেন। সমাজে শিক্ষকের স্থান সবার উপরে। কোনও শিক্ষকের একজন ছাত্র পরে আরও বিদ্যাজন করে কোনও বড় পদে বসলে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকতা শুনে খুশি হন, তার আরও সাফল্য কামনা করেন। যে পুলিশ শিক্ষকের পেটে লাথি মারল, সেও হয়তো শিক্ষকদের কাছে পড়েছে। শিক্ষকেরা যে পূজনীয়, মা-বাবার পরেই তাঁদের স্থান, তা ওই পুলিশের জানা না থাকার ফলে সংশ্লিষ্ট এই শিক্ষককে এমনভাবে প্রহার (লাথি) করতে পারল। শিক্ষকেরা যে সমাজে সম্মানের পাত্র তা সে ভুলে গেল।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এভাবে একজন শিক্ষকের পেটে লাথি মারার নিন্দা করলেও, তিনি বলেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা ডিআই অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গেলেন কেন? তাঁরা গিয়েছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাতে! তাদের প্রশ্ন ছিল, তাদের ভবিষ্যৎ কী— তাঁরা বেতন পাবেন কিনা, এসব জানাতে। পুলিশের সঙ্গে এভাবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বেন এবং পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে লাঠি চালালো তার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে যুক্তিতর্কে যোগ দিয়ে একজন ঘোষক দাবিকরেছেন, পুলিশ সেদিন সংযত আচরণ করেছে। পুলিশ কিন্তু মোটেই সংযত আচরণ করেনি। শিক্ষকেরা যতই বেপরোয়া হন না কেন, তাঁদের এভাবে লাঠিপেটা করা সংযত আচরণের পরিচয় নয়। তাঁদের ভাবা উচিত ছিল যাঁদের ওপর তাঁরা লাঠি চালাচ্ছেন, তাঁরা শিক্ষক— স্কুলে পড়ান। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য ক্লাস নেন। পুলিশের শিক্ষকদের এই অত্যাচার কেউ সমর্থন করবে না, বরং তাঁরা ধিক্কার জানাবে। শিক্ষক মহল পুলিশের এই আচরণকে নিন্দা করে বলেছে, তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তা বলেছেন, পুলিশের ভুল হতেই পারে। তাঁর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে দেখছে। যে পুলিশ একজন শিক্ষকের পেটে লাথি মারল, তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, আমরা জানি নে। তবে তাঁর এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সমাজের কেউ তাঁর এই সক্রিয়তাকে পছন্দ করবে না। আমরা অবশ্য চাইব এই পুলিশকে বোঝানো উচিত কীভাবে চলতে হবে।
আসলে পুলিশের কীভাবে চলতে হবে, কীভাবে বিক্ষোভ দমন করতে হবে, কীভাবে শরীরের কোথায় লাঠির আঘাত করতে হবে, কীভাবে গ্যাস ছাড়তে হবে, বিক্ষোভকারীর শরীরের কোন দিক লক্ষ্য করে গুলি চালাতে হবে, কীভাবে জলকামান ব্যবহার করতে হবে, তার শিক্ষা দেওয়া হয় না। বারাকপুর, লাটবাগানে পুলিশ ট্রেনিং কলে ছয়মাস প্রশিক্ষণের পর তাঁদের চাকরিতে বহাল করা হয়। তারপর পুলিশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনও প্রশিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয় না। সুতরাং পুলিশ যখন বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে যায়, তারা লাঠিটাকেই বেশি ব্যবহারকরে। কিন্তু লাঠি চালানোর যে নিয়ম আছে তা তারা জানে না। এককালে কলকাতা পুলিশের যথেষ্ট সুনাম ছিল। শিক্ষিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা পুলিশে যোগ দিত! কিন্তু কলকাতা পুলিশ সেই সুনাম হারিয়ে ফেলেছে। তাই তাদের কাজে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। পুলিশ কোনও ক্ষেত্রে খুব সক্রিয়, আবার কোনও ক্ষেত্রে বেশি নিষ্ক্রিয়। সুতরাং সমাজবিরোধীরা জানে কীভাবে পুলিশকে উপেক্ষা করে অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়া যায়।