শোভনলাল চক্রবর্তী
বাংলা ছায়াছবির সাদা কালো পর্দা জুড়ে ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি বাঙালির ‘ম্যাটিনি আইডল’, মহানায়ক উত্তম কুমার। বাঙালি মননে, চেতনায় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো আজও তিনি বিরাজমান। রামধনুর রঙ ছড়িয়ে আমাদের মনের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে আছেন। উত্তম কুমার শুধুই শিল্পী নন, তিনি নিজেই ছিলেন শিল্প। যিনি নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে। সামাজিক দায়বদ্ধতায় পথিকৃৎ হয়ে মানুষের আর্তনাদে, তিনি ফিনিক্স পাখির মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন।সেই পথ ধরেই মহানায়কের ৪৫ তম প্রয়াণ দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবে বাঙালি। প্রতি বছরের মতোই উঠে আসবে মহানায়কের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা স্মৃতিকথা। কথায়-গল্পে-গানে আগামী প্রজন্মের কাছে আবারও পৌঁছে যাবে তাঁর সৃষ্টি।
Advertisement
বাঙালি যত দিন থাকবে, তাঁর সৃজনশীলতার আলোয় উদ্ভাসিত হবে বাঙালি জীবন।মহানায়ক নিজেই ছিলেন এক জন সুরস্রষ্টা এবং গায়ক। তা ছাড়া, তাঁর ছায়াছবিতে যে গান সৃষ্টি হয়েছে, তা কোহিনূরের মতো বাংলা গানকে এখনও সমৃদ্ধ করে রেখেছে। বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসে সেই সব গান যেন আজও অমর সৃষ্টি হয়ে থেকে গিয়েছে। উত্তম আজও এক মিথ। আসলে মিথ মানে শুধু অযোধ্যা বা বারাণসী নয়। বিখ্যাত ফরাসি চিহ্নতাত্ত্বিক লিখেছিলেন, অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর মুখ আসলে ‘আইডিয়া’ বা ধারণা, সব কিছুই ধারণ করতে পারে সে; আর অড্রে হেপবার্নের মুখ ‘ইভেন্ট’ বা ঘটনা। উত্তমকুমার একই সঙ্গে এই ধারণা ও ঘটনার মিশ্রণে তৈরি জটিল শরীরী অভিনয়-বিমূর্ততা। সেই বিমূর্ত হাসির পর্দা-স্মৃতিই হার মানায় শরীরী মৃত্যুকে।
Advertisement
ভারতবর্ষ দূর অস্ত্, খ্যাতির তুঙ্গে থাকা মাইকেল জ্যাকসনের আচমকা মৃত্যুর ঘটনাতেও এমনটা ঘটেনি। প্রতি বছর ২৪ জুলাই দিনটি মনে করিয়ে দেয় বাঙালির নিজস্ব স্মৃতির আয়ুধে সাড়ে চার দশক আগের এক মৃত্যুজয়ের তাৎপর্য। বুঝিয়ে দেয় বাঙালি সংস্কৃতির বিশিষ্টতা।২৪ জুলাই, উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন এলেই হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে। সেপ্টেম্বরে তাঁর জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিনটিকেই মনে রাখেন অধিকাংশ বাঙালি। মৃত্যুই আচম্বিতে টেনে দিয়েছিল দর্শককুলের সঙ্গে তাঁর ছেদ। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও তিনি মহানায়ক, কৃত্রিম মেধার যুগেও তাঁর ছবির ক্লিপিং নিয়ে তৈরি হয় অতি উত্তম। তাঁর সমসাময়িক অন্য কারও এই রেকর্ড নেই। তামিল ছবিতে লাল স্যুট পরিহিত এমজিআর রাজনীতির কারণে স্মরণীয়, অন্ধ্রের এন টি রামা রাও শুধু দেবমহিমান্বিত চরিত্রে, রাজ কাপূর অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনা-পরিচালনা সব মিলিয়েই অনন্য শো-ম্যান। কিন্তু তাঁদের কারও মৃত্যুদিনেই পত্রপত্রিকা, টিভি ও ব্লগ এত বিপুল তরঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। উত্তরপ্রজন্ম কখনও মুগ্ধতার আবেশে সাদা-কালো ছবিকে রঙিন করে প্রযুক্তির ‘নয়া দৌড়’ প্রদর্শন করে। কিন্তু মৃত্যুর সাড়ে চার দশক পরেও পুরনো ক্লিপিং এবং অন্যের কণ্ঠে ভর করে পর্দা-উপস্থিতি থাকে না। এখানেই মৃত্যুর পরাজয়, বাঙালি সংস্কৃতির জয়।
তাঁর জীবদ্দশাতেই তো বসন্ত বিলাপ ছবিতে চিন্ময় রায় প্রেমিকাকে বলেছিলেন, “শুধু একবার বলো, আমি উত্তমকুমার।” এখনও ছবির পর্দায় ব্যোমকেশ চরিত্রকে প্রেমাস্পদা বলেন উত্তমকুমারের মতো হতে। প্রেম এবং উত্তম কয়েক দশক ধরে বাঙালি জীবনে প্রায় সমার্থক, সে তাঁর বিপরীতে সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী বা মাধবী যে নায়িকাই থাকুন না কেন! পুরুষের এই ভুবনভোলানো হাসি বাঙালি আগে বা পরে কখনওই দর্শন করেনি।অথচ, শারীরবৃত্তীয় নজরে দেখলে তাঁর ত্রুটিও ছিল। জিভেও ছিল জড়তা। বসন্ত চৌধুরীর মতো চেহারার আভিজাত্য বা জলদমন্দ্র স্বর তাঁর ছিল না, প্রেমের সংলাপ বলার সময় গলাটা নিচু তারে নামিয়ে নিতেন। সেখানেই প্রকাশ পেত স্বপ্নালু ঘনিষ্ঠতা। এই যে নিজের দুর্বলতা নিয়ে সচেতন, এবং বরাবর তাকে অতিক্রম করে যাওয়া, এই অভ্যাস বাঙালি চরিত্রে বিরল।
‘শুধু একটি বছর’ ছবিতে সুপ্রিয়াকে বিরক্ত করা আর ‘মৌচাক ‘ ছবিতে সাবিত্রীকে উত্ত্যক্ত করার হাসি এক নয়, দুটোই দাম্পত্যের গল্প হওয়া সত্ত্বেও! শুধু মুখের পেশির সঞ্চালন বা নির্দিষ্ট বাচনভঙ্গি নয়, প্রায় সারা শরীর দিয়ে চরিত্রে মিশে যেতেন তিনি। অমিতাভ বচ্চন তাঁর কেরিয়ারের শুরুতে “আদালত” ছবিতে পক্বকেশ বাবা ও কালো চুলের রাগী ছেলের দ্বৈত চরিত্রে ছিলেন। উত্তম কিন্তু শুরুর দিকেই “খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন” ছবিতে বৃদ্ধ রাইচরণ! “স্ত্রী” এবং “সন্ন্যাসী রাজা” দু’টিই স্ত্রীর প্রতি অবহেলার জমিদার-কাহিনি। কিন্তু প্রথম ছবিতে লাম্পট্যের হাসি ও দ্বিতীয়টিতে অসহায়তার হাসি কতখানি আলাদা ও ব্যঞ্জনাময়, দর্শকমাত্রেই জানেন। শুধু ঠোঁট বা মুখ নয়, সারা শরীর দিয়ে হাসা যায় বলেই “অমানুষ” ছবির শেষ দৃশ্যে অনিল চট্টোপাধ্যায়কে বিদায় জানাতে গিয়ে হাসতে হাসতে উত্তম কাঁদেন। “বিকেলে ভোরের ফুল” ছবির শেষ দৃশ্যে ঠোঁটের কোণে প্রৌঢ়ত্বের বিষণ্ণমধুর হাসি, কিশোরী প্রেমিকাকে বলেন, “তুমি বড় হও, তার পর বুঝবে।”
উত্তমকে শুধু মহানায়ক অভিধায় বন্দি রাখলে হবে না: ছাপোষা বাড়ির ছেলে, একের পর এক ফ্লপ ছবির নায়ক কী ভাবে মিথ হয়ে উঠলেন, তারও বিশ্লেষণ জরুরি। সেই জরুরি কাজ বরং এ বার শুরু হোক। কোনও কোনও মহলের বক্তব্য, বাঙালি এখন শুধুই রাজনীতিতাড়িত, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, শিল্প, বাণিজ্য সর্বত্র প্রথম ও দ্বিতীয় সারি থেকে বিতাড়িত, স্মৃতিকাতর পশ্চাৎপদ এক জনগোষ্ঠী মাত্র। বিনোদনী মানচিত্রেও তথৈবচ। বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর সকাতর অনুনয়েও ফল হয়নি, হিন্দি থেকে তামিল, তেলুগু, কন্নড় সকলেই জনপ্রিয়তায় তাকে টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও একটি বিষয়ে বাঙালি গর্ববোধ করতেই পারে। আমাদের একজন উত্তমকুমার ছিলেন,আছেন এবং থাকবেন।
Advertisement



