স্নেহাশিস সুর
কেন্দ্রীয় বাজেট সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে তার প্রেক্ষিতটা সবেচেয়ে আগে দেখা দরকার। আর এই প্রেক্ষিতটা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সমীক্ষা যেটা সংসদে বাজেটের একদিন আগে পেশ করা হয়েছে। আগে আর্থিক সমীক্ষা বাজেটের বেশ কিছুদিন আগে পেশ করা হত। ফলে তাতে কিছুদিন আগের তথ্য থাকত। তারপর এর গুরুত্ব কমে। তবে এখন আবার আলাদা করে এটা পেশ করা হচ্ছে এবং সেটা করা হয়েছে বাজেটের একদিন আগে। ফলে এতে সর্বশেষ তথ্য রয়েছে। আর এবার আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি বদলের ফলে সারা বিশ্বে তার আর্থিক প্রভাব পড়বে। রাষ্ট্রপতি ট্রাম এর নতুন নীতর প্রভাবের বিষয়ও এই আর্থিক সমীক্ষায় নজর নিশ্চয় এড়ায়নি।
আর্থিক সমীক্ষার, যে বিষয় সবার চোখ পড়ে তা হচ্ছে উন্নয়নের হার বা বৃদ্ধির হার। এবারের আর্থিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে চলতি অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার হবে ৬.৪ শতাংশ। পরের বছরের পূর্বাভাষ রয়েছে ৬.৩% থেকে ৬.৮%! একটা বিষয় তো দেখা যাচ্ছে যে এই হার ৭% হতে পারছে না। যে ৭ শতাংশের কথা প্রায়ই শোনা যেত।
এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটের যেটা সবচেয়ে নজরকাড়া বিষয় সেটা হচ্ছে ব্যক্তিগত আয়করে বেশ কিছুটা ছাড়ের ঘোষণা। লোকসভায় এই ঘোষণা করার সময় সরকার পক্ষের সদস্যরা যতটা টেবিল চাপড়েছেন আর অর্থমন্ত্রীও যেরকম বিরাট করে ঘোষণা করেছেন তত বেশি ছাড় কিন্তু আদপে নেই। বেশ কিছুটাই অর্থমন্ত্রীর বলার কৌশল। নতুন কর প্রস্তাবে যাদের আয় ক্যাপিটাল গেইন থেকে আয় বাদ দিয়ে বছরে ১২ লক্ষ টাকা তাদের কোন আয়কর লাগবে না কারণ তাতে যে কর হচ্ছে আর ছাড় দেওয়া হচ্ছে তাতে কাটাকাটি হয়ে যাবে। কিন্তু কারের যদি ১২ লাখের বেশি হয় তাহলে চার লক্ষ পর্যন্ত কর নেই (আগে যেটা ছিল তিন লাখ পর্যন্ত)। আর চার লক্ষের ওপরে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন হারে কিন্তু আয়কর দিতে হবে। তখন আর সেই কর ছাড়ের সুযোগ পাওয়া যাবে না। তবে বিভিন্ন হারের আয়করের বিভিন্ন পর্যায় বা স্ল্যাব করে তাতে করের ভিন্ন ভিন্ন করের হারের সংস্থান করে সামগ্রিকভাবে আয়করের কিছুটা ছাড় অবশ্যই পাওয়া যাবে। এবারের বাজেটের আগে মধ্যবিত্তের জন্য আয়কর কমানোর প্রস্তাব আসবে বলে একটা হাওয়া ছিল। তাই কিছুটা হলেও প্রত্যক্ষ কর তথা আয়করে একটু হলেও সুরাহার চিহ্ন দেখা গেছে। তবে যেভাবে হইচই হল ততটা আয়কর কমবে না। তবে বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে উৎসমুখে কর কেটে নেবার পর্যায়ের যে উর্দ্ধসীমা ছিল সেটা বাড়িয়ে ৬ লাখ করা হয়েছে। অতএব, বছরে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া হলে উৎসমুখে আর আয়কর কেটে রাখতে হবে না। যদিও উৎসমুখে কেটে নেওয়া করের টাকাটা পরে আয়করে মিলে যায় কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে টাকাটা সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যাবে এবং খরচ করা যাবে। আর্থিক বছরের শেষে আয়কর জমাদেবার পর যে হিসেব নিকেশ হত এখন আর তারজন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
প্রত্যক্ষ করের সুবিধার ক্ষেত্রে এবারের বাজেটে প্রস্তাবে আরেকটা যে উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখা গেছে সেটা হল এতদিন কারের দুটো বাড়ি বা ফ্ল্যাট থাকলে এবং একটায় কোনও ভাড়া না থাকলেও দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে একটা ন্যাশানাল রেন্ট ধরে নিয়ে তার ওপরে আয়কর ধার্য হত। এখন আর তা হবে না। তাছাড়া সুদের ক্ষেত্রে বর্ষীয়ান নাগরিকদের এতদিন উৎসমুখে কর কোটে নেওয়া হবে সুদ থেকে আয় ৫০ হাজার টাকা হলেই। এবার সেই পরিমাণ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে একলাখ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ করে কিছু ছাড়ের সংস্থান করা হয়েছে।
ফলে যে কথা বলা হচ্ছিল যে মধ্যবিত্তের জন্য এবারে বাজেটে কিছু সুরাহা হবে—তার কিছুটা হলেও এসেছে। সেই সঙ্গে সামাজিক ক্ষেত্রের দিকেও এবারের বাজেটে নজর দেওয়া হয়েছে কৃষিসহ অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রের জন্যেও কয়েকটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা হয়েছে এই বাজেটে। অথমন্ত্রী এবারের বাজেটে উন্নয়নের মোট চারটি ইঞ্জিনের কথা বলেছেন। প্রথমত: কৃষি, দ্বিতীয়ত: এমএসএমই (ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প); তৃতীয়ত: বিনিয়োগ; চতুর্থত: রপ্তানি। এই চারটি ক্ষেত্রেই একাধিক প্রকল্পের কথা এবারের বাজেটে ঘোষণা করা হয়্ছে। যার মধ্যে রয়েছে দেশের ১০০টি জেলার ১.৭ কোটি কৃষেকের জন্য প্রধানমন্ত্রী ধনধান্য কৃষি যোজনা, খাদ্য তেলের জাতীয় মিশন এবং বিহারে মাখানা বোর্ড গঠন। কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণের উর্দ্ধসীমা তিন থেকে পাঁচ লাখে বাড়ানো; স্টার্ট আপ ঋণ দশ কোটি থেকে বাড়িয়ে কুড়ি কোটি করা, এমএসএমই ও রপ্তানিতে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। খেলনা নির্মাণে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা; সমস্ত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ব্রড ব্যান্ড এর ব্যবস্থা, বিভিন্ন স্থানে ক্যনসার চিকিৎসা কেন্দ্র গড়া প্রভৃতি পরিকল্পনা রয়েছে। রয়েছে বিমা কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষার কথাও।
এবারের বাজেটের মূল ভরকেন্দ্র বলা যায় কৃষি, মধ্যবিত্তের সুরাহা এবং বেশকিছু সামাজিক প্রকল্প। সব সময়েই বাজেটকে জনগণের আশা আকাঙ্খা মেটানোর পদক্ষেপ বা প্রয়াস হিসেবে আলোচনা করা হয়। আর সেই সঙ্গে বিচার করা হয় বাজেট কতটা জনমুখী হল। আর জনমুখী কিনা সেটা দেখা হয় সামনে কোনও নির্বাচন আছে কিনা। আর তাতে বাজেটের কি প্রভাব পড়তে পারে সেটা দিয়ে। এবারের বাজেট নিয়ে কথা হচ্ছে যে এবারের বাজেটে মধ্যবিত্তের যে এত খেয়াল রাখা হয়েছে তার কারণ সামনে রয়েছে দিল্লির ভোট। আর সেখানে বাস করেন বহু মধ্যবিত্ত যারা অনেকেই চাররিজীবী। তাদের কথা ভেবেই এবারের বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্যে রয়েছে এত ভাবনা। আর কোভিড পরবর্তীতে একটা শিক্ষা হয়েছে যে চরম সংকটেও কৃষি ক্ষেত্র হাল ধরেছে। তাই কৃষিতেও রয়েছে বেশ কিছু ব্যবস্থা। রাজনৈতিক কারণে বিহারের ঝুলিও একটু ভারি।
তবে সব ক্ষেত্রে এত প্রকল্পের কথা এলেও শিল্পক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য ঘোষণা এবং সরকারের আয়ের দিকটা একটু অনুল্লেখিতই থেকে গেল। অর্থাৎ টাকাটা আসবে কোথা থেকে তার সুষ্পষ্ট দিক নির্দেশের একটু অভাব রয়েছে বলেই তো প্রাথমিক বিশ্লেষণে মনে হতে পারে।