• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

এমন ঘনঘোর বরিষায়

সন্ধ্যা নামছে, আকাশ অন্ধকার। কার মেয়ে যেন ডেকে উঠছে: আয় আয় হাঁসগুলো তই তই তই...ফিরে এসো হে শৈশব আমার। 'এমন দিনেই তাঁরে বলা যায়। এমন ঘনঘোর বরিষায়'।

প্রতীকী চিত্র

হীরক কর

জলবতী মেঘের বাতাস নিয়ে বর্ষা এল বাংলার সঘন সজল প্রকৃতিতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষা ঋতুর বন্দনা করে লিখেছেন, ‘এসো শ্যামল সুন্দর,/ আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।/ বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।’
ষড়্ঋতুর এই দেশে গ্রীষ্মের পরই বর্ষা আসে থইথই জল-জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে। মাঠ-ঘাট, নদ-নদী, খাল-বিল—সবখানে জলেরই উল্লাস, জলেরই খেলা।

Advertisement

বাংলায় সবচেয়ে নন্দিত-বন্দিত ঋতু কোনটা? অবশ্যই বর্ষা। এটা বলার জন্য গালে হাত দিয়ে বসতে হয় না। বসন্ত নয়, কাব্যপ্রেমী বাঙালির প্রিয় ঋতু বর্ষা। কেন এ-রকম হলো ! কেন বর্ষা নিয়েই হাজার হাজার গান, কবিতা, ছবি, চলচ্চিত্রের দৃশ্য ! এবং এই চলতি ধারা বা ট্রেন্ড আজকের নয়, হাজার বছর আগে থেকেই বাঙালির জীবনে সবচেয়ে ট্রেন্ডিঙ ঋতু বর্ষা।

Advertisement

আমাদের ছোটবেলায় বর্ষায় আমরা বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল খেলতাম, মাঠে জমে থাকা জলে পুকুর থেকে উঠে আসা মাছ কিলবিল করত । সেখানে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে খালের জলে লগি ঠেলতাম। উঠানজুড়ে আমের খোসা, কাঁঠালের ভুতি, বাতাসে ফলের তীব্র গন্ধ আর নীল মাছির ভনভন। আরেকটা জিনিস ছিল। তিলা। সাদা শার্টে কালো কালো দাগ পড়ত, আমরা বলতাম, তিলা। এখনো কি পড়ে ? এখনো কি ‘রেইনি ডে’ হয় স্কুলে ? পাওয়া যায় ডাবল টিফিন ? পলিথিনের ব্যাগে বই ভরে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে ছাতা মাথায় চলেছি স্কুল; অন্যদিন যাই বা না যাই, বৃষ্টিদিনে যেতেই হবে। বৃষ্টি ছাতায় মানত না, ভিজে যেতামই।

এর একটা কারণ বোধ হয়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র জলমগ্ন হয়ে যেত। বর্ষাকালে ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমাদের পূর্বপুরুষদের। কাজেই তাঁরা গান রচনা করতেন, গাইতেন, শিল্পের চর্চা করতেন বর্ষাতেই। বর্ষা এমন একটা ঋতু, যা পঞ্চইন্দ্রিয়কে কেবল নাড়া দেয় না, জীবনকে নাড়িয়ে দেয়। বসন্তকাল আমাদের দেশে আলাদা তাৎপর্য আনে না; কারণ, শীতের দেশের মতো এখানে তুষারপাত হয় না, গাছের পাতা ঝরে পড়ে সব ন্যাড়া হয়ে যায় না । ওসব দেশে বসন্ত আনে মুক্তির বার্তা, গেয়ে ওঠে জীবনের ও যৌবনের গান। আমাদের শীত অত প্রকট নয়, তুষার ঝরে না এখানে, কাজেই বসন্ত আলাদা করে বোঝাই যায় না। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমাদের এই চোখ-পোড়ানো আলোর দেশে বর্ষার আকাশ আমাদের চোখে কী যে অপূর্ব স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তা বাঙালি মাত্রেই জানে। আজকের আকাশ দেখে মনে হয়, ছায়ার রঙের কোনো পাখির পালক দিয়ে বর্ষা তাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে দিয়েছে, তাই তার স্পর্শ আমাদের চোখের কাছে এত নরম, এত মোলায়েম।’

সবচেয়ে সুন্দর বর্ষাকালে। গাছের পাতা ঘন সবুজ। আউশের খেত জলে ভরভর। এক রত্তি ধূলো নেই গাছের পাতায় পাতায়। অন্য ঋতুগুলোয় গাছের পাতা সব ধূসর, ধূলোমলিন। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাধাকৃষ্ণের কিংবদন্তি। কৃষ্ণ যমুনা নদীর তীরে কদম্বতলে বাঁশি বাজাচ্ছেন, নীল শাড়ি পরে রাধা চলেছেন অভিসারে। বর্ষা এলে তাই বাঙালির হৃদয় চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমাদের সমন্বিত অবচেতনে কালিদাসের “মেঘদূত” ছায়া ফেলে। রবীন্দ্রনাথ কত যে বর্ষার গান লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামও মুখর বর্ষাবন্দনায়।

বর্ষা তাই আমাদের উদ্‌যাপনের বিষয় হয়ে উঠেছে। আকাশে মেঘ, আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে, ও গো, একটু খিচুড়ি চড়িয়ে দাও না। এই বায়না ঘরে ঘরে। কেন বৃষ্টিদিনেই খিচুড়ি খেতে হবে? বোধ হয় খিচুড়ি খেলে পিপাসা বেশি পায়, শুকনো দিনে না খেয়ে আর্দ্র দিবসে খেলে কম তেষ্টা পাবে, সেটা একটা কারণ। নাকি গ্রামে গ্রামে চুলা ছিল উঠানে, বৃষ্টি দিনে উনুনও যেত ভিজে, তখন সবচেয়ে সহজ রান্নাটা করাই ছিল বুদ্ধিমত্তার কাজ, ডাল আর চাল হাঁড়িতে বসিয়ে দিলেই হয়ে গেল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার, খিচুড়ি। সঙ্গে ডিম ভাজা হলে তো কথাই নেই। আর আজকাল যুক্ত হয়েছে ইলিশ ভাজা। উমম। স্বাদ অতুলনীয়।

বৃষ্টির সঙ্গে জলের রুপালি শস্য ইলিশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ইদানীং ইলিশ নিয়ে সেই আবেগ কিছুটা ফিকে হতে চলেছে কি? মহার্ঘ বস্তুটির উচ্চ মূল্যও একটি কারণ। কলকাতার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেজি আকারের একটি রুপালি ইলিশ ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা বাঙালি মধ্যবিত্তের ইলিশ-রোমাঞ্চ অনেকটা শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য বোধ করি ওই একটি কারণই যথেষ্ট। এর চেয়ে খিচুড়ির সঙ্গে দুটি বেগুন ভাজা আর একটি ডিম ভাজা হলেই তো দিব্যি চলে যায় অনেকের।

বর্ষা ঋতুর কথা আলোচনায় এলে বাঙালি জীবনে রবীন্দ্রনাথের নাম ঘুরেফিরে আসবেই। এ দেশের গ্রামবাংলায় বর্ষা-বর্ষণের সঙ্গে নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে। যখন তিনি শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসর অঞ্চলে এলেন, ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে। সেই অবকাশে, সাময়িক বসবাসের সুবাদে নদীমাতৃক, বর্ষা-বর্ষণপ্রধান গ্রামবাংলাকে স্বরূপে চিনে নিলেন কবি। বাংলার ওই প্রকৃতি তাঁর চেতনায় স্থায়ী আবাস গড়েছিল। তাঁর বিভিন্ন লেখায় সে প্রমাণ ধরা আছে। জুলাই ১৮৯৩ সালে কবি যেমন আঁকলেন বর্ষায় পদ্মায় ভ্রমণের একটি ছবি, ‘বাতাস বেগে বইতে লাগল, পদ্মা নৃত্য করতে লাগল, পলে ফুলে উঠল, দিনের আলো মিলিয়ে এল, আকাশের ধারের মেঘগুলো ক্রমে আকাশের মাঝখানে ঘনঘটা করে জমে গেল, চারদিকে পদ্মার উদ্দাম জল করতালি দিচ্ছে, আমি যেন প্রকৃতির রাজার মতো বসে আছি।’

আষাঢ় ও শ্রাবণ নিয়ে রাশি রাশি গান-কবিতা রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘গীতবিতান’-এর অন্তর্ভুক্ত প্রকৃতিবিষয়ক গানের মধ্যে বর্ষা ঋতুর গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সম্ভবত সে সংখ্যা ১৩৪ বা ১৩৫ । কালি ও কলম, বর্ষা-বর্ষণের রূপ চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ও বহু চর্চিত কবিতা ‘সোনার তরী’। এ কবিতায় বর্ষারই অপরূপ ছবি এঁকেছেন কবি, ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।/ কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।/ রাশি রাশি ভারা ভারা ধান–কাটা হল সারা,/ ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা—/ কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা ।’

বর্ষা মঙ্গল, যার অর্থ “বর্ষা উদযাপন”, বর্ষার আগমনকে স্বাগত জানানো এবং উদযাপনের জন্য নিবেদিত একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রকৃতি এবং ঋতুর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর সংযোগ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, এই উৎসব বর্ষার প্রতি একটি কাব্যিক এবং শৈল্পিক শ্রদ্ধাঞ্জলি, যা ভূমি এবং এর মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।

এটি এমন একটি সময় যখন শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৃষ্টি থেকে সবুজ এবং সবুজ, সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এই উৎসবটি সাধারণত বর্ষা মৌসুমের শীর্ষে, সাধারণত জুলাই বা আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হয় । প্রতি বছর তারিখ পরিবর্তিত হতে পারে। এটি শান্তিনিকেতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমী উৎসব, বসন্ত উৎসব (বসন্ত), শারদোৎসব (শরৎ) এবং অন্যান্য উৎসবের পাশাপাশি।

সন্ধ্যা নামছে, আকাশ অন্ধকার। কার মেয়ে যেন ডেকে উঠছে: আয় আয় হাঁসগুলো তই তই তই…ফিরে এসো হে শৈশব আমার। ‘এমন দিনেই তাঁরে বলা যায়। এমন ঘনঘোর বরিষায়’।

Advertisement