• facebook
  • twitter
Thursday, 1 May, 2025

রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সভ্যতার সংকট আর একবার লিখতেন

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের এতোগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখি তাঁর স্বপ্নের আন্তর্জাতিকতাবাদ আজও সফল হয়নি।

জীবন সায়াহ্নে সভ্যতার সংকট রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ফেলে আসা সময়ে দেখেছিলেন সভ্যতার পরীকীর্ণ ভগ্নস্তূপ। যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবীর আকাশে শুনেছিলেন মানবতার বিষণ্ণ হাহাকার। ক্রান্তদর্শী রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রান্তলগ্নে মানুষের প্রতি বিশ্বাস অটুট রেখেছিলেন। যুদ্ধের মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে আশা করেছিলেন ইতিহাসের নতুন দিগন্ত। মনে করেছিলেন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দু’দশক পরে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন নতুন করে বিশ্বসংঘাতের আয়োজন। ১৯৪১-এ তাঁর জীবনাবসানের সময় ইউরোপ এশিয়ার রণাঙ্গণ জুড়ে তখন চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপের ফ্যাসীবাদ এই যুদ্ধের যে প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ৫ আগস্ট ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বন্ধু চার্লস এন্ড্রুজকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে— ‘ফ্যাসীবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতিসমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেক-বিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে—আমি বরাবরই বলেছি, পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলি সযত্নে উগ্রজাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবকে লালন পালন করে সারা পৃথিবীর সামনে এক ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংবাদ পেয়ে কবি মর্মাহত হয়েছিলেন।

১৯৩৯-এর অক্টোবরের ‘মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— ‘জার্মানীর বর্তমান শাসকের দাম্ভিক ন্যায়হীনতায় বিশ্বের বিবেক আজ গভীরভাবে আহত। বর্তমান পরিস্থিতি, পূর্বের অনেকগুলি ক্ষেত্রে দুর্বলের অসহায় পীড়নের চূড়ান্ত পরিণতি।’ যে পশ্চিমা দেশগুলি ছিল রেনেশাঁর জন্মদাতা, বিজ্ঞানী গড়ে তোলার করিগর, মানবতাবাদী শিক্ষার সৃষ্টি ভূমি, রবীন্দ্রনাথ দেখছেন সেইসব দেশগুলি আজ যুদ্ধবাজ শক্তিতে পরিণত। তারা যুদ্ধের হারজিত নিয়ে অঙ্ক কষে চলেছে। তাদের লোভ কোথাও বাধা পেতে চায় না, তারা সজাগ থাকে, তাদের এতটুকু লোকসান যেন না হয়। এই সর্বভুক লালসা মনুষ্যত্বকেও গ্রাস করছে। রবীন্দ্রনাথ পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরীতে সাম্রাজ্যবাদী জগতের দিকে তাকিয়ে তাই লিখছেন— ‘আজ মুনাফার আড়ালে মানুষের জ্যোতির্ময় সত্য রাহুগ্রস্ত। এই জন্যই মানুষের প্রতি কঠিন ব্যবহার করা, তাকে বঞ্চনা করা এত সহজ হল। তাই পাশ্চাত্যে মানুষের ফুলে ওঠা পকেটের তলায় মানুষের চুপসে যাওয়া হৃদয় পড়েছে চাপা। সর্বভুক পেটুকতার এমন বিস্তৃত আয়োজন পৃথিবীর ইতিহাসে, আর কোনওদিন এমন কুৎসিত আকারে দেখা দেয়নি।’

রবীন্দ্রনাথের জীবনাবসানের পর মানুষের তৈরি পারমানবিক বোমার প্রয়োগ হয়েছিল মানুষেরই ওপর। মারণাস্ত্রের আঘাতে এতো বড়ো ধ্বংস, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ইতিহাসে মানুষ কম দেখেছে। যার মারণ বিষক্রিয়া বহু দশক ধরে মানুষ বহন করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু রক্তক্ষয়ী অর্থক্ষয়ী হয়ে ওঠেনি,। পৃথিবীর সব সীমান্তেই শোনা গিয়েছিল সভ্যতার পতনের শব্দ। এই পতন ছিল ফ্যাসীবাদের পদধ্বনি। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসীবাদ ক্রমশ ত্বরান্বিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মধ্যে দিয়ে ফ্যাসীবাদের পতনও যেমন হয়েছিল, পরবর্তীকালে পৃথিবীর রাজনীতি ও সমাজের মধ্যে তার প্রভারও রয়ে গেল গভীর ভাবে। দেখা গেল বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তি প্রবল হয়ে এই ব্যবস্থাকে স্থায়ী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে।

বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলেও তৈরি হয়েছিল সভ্যতার নতুন সঙ্কট। বৃহৎ শক্তিগুলির স্নায়ুযুদ্ধ ঘিরে ধরল পৃথিবীকে। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্যবাদী দুই শিবিরে ভাগ হওয়া শক্তির ছায়ায় তখন তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এ সব দেশে চলতে থাকা জাতীয় আন্দোলনগুলিকেও তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা শুরু করে। আসলে এশিয়া আফ্রিকার দস্যুবৃত্তিই ছিল তাদের ধনসঞ্চয়ের উপায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছিল শোষণ লুণ্ঠনের নতুন যুগ। রাশিয়া ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ মানবতার যে সাফল্য দেখেছিলেন পরবর্তীকালে তারই আভাস জেগেছিল চীন ও কিউবার গণবিপ্লবে। উড়েছিল শোষিত মানুষের বিজয় পতাকা। এরই মধ্যে তৈরি হচ্ছিল ভিয়েতনামের মাটিতে মার্কিন আধিপত্যবাদের নতুন ষড়যন্ত্র। সবুজ ফসলের দেশ ভিয়েতনামকে তারা পরিণত করেছিল শশ্মানভূমিতে। মারণাস্ত্রের পাশাপাশি ক্ষেতের ফসল পুড়িয়ে ক্ষুধাস্ত্র দিয়ে লাখো মানুষকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল তারা। রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষকে দেখেছিলেন অখণ্ড ভারত্মাতা রূপে। সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীর ভারতবর্ষ তার কাছে ছিল মহামানবের সাগরতীর। যে দেশের মানুষকে তিনি ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন সে দেশের স্বাধীনতা এসেছিল দেশভাগের মধ্যে দিয়ে। বিভাজনের এই সংকটকে রবীন্দ্রনাথ দেখেননি। সীমান্তরেখা ধরে বাঁধা হয়েছিল র্যা ডক্লিফ লাইনের বিষাক্ত কাঁটাতার। ধর্মকে ভিত্তি করে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ বয়ে গেল জাতির অন্তরে। তখন আপন দেশের মানুষের রক্ত ঝরেছে প্রতিনিয়ত। দেশের সেই বিপন্নতা আজও কুরে কুরে খাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তার জীবনের শেষ প্রতিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’ হয়তো আরও দীর্ঘায়ত করতেন।

সমাজ সভ্যতার শুরু থেকেই দ্বন্দ্ব। ক্ষমতার দ্বন্দ্বই এনেছে বৃহৎ সংকট। ইতিহাসের এক এক মোড় বদলে যেমন উত্তরণ এসেছে, পরবর্তীকালে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে সভ্যতার সংকট নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। সমাজ সংকটকে আজও বহন করে চলেছি নতুন শতাব্দীতেও। এই শতকের গোড়াতেই দেখেছি যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবীর নতুন চেহারা। ইরাকের মাটিতে ২০০২ সালে নতুন করে খসে পড়েছে যুদ্ধবাজদের মুখোশ। কেড়ে নিয়েছে লাখো নারী শিশুর জীবন। গৃহযুদ্ধের নখরাঘাত এখনও তাদের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে চলেছে। প্যালেস্টাইনের দুর্জয় মাটিতে যুদ্ধের আগুন। গাজার অর্ধেক ভূখণ্ড হয়ে উঠেছে কবরস্থান। শেষ হয়ে গেছে সেখানকার ছয় শতাংশ মানুষের জীবন। আফগানিস্তানের স্বাধীনতা এখন তালিবানী গারদে বাঁধা। পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ফুলের মতো সুন্দর ইউক্রেন। লেবানন, সিরিয়া, মায়ানমারে এখনো লাখো শরণার্থীর স্রোত। রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকাকে দেখেছিলেন ছায়াবৃতা কালো ঘোমটার নিচে। এক সময় সেখানকার সূর্যহারা অরণ্যের গভীরে এসেছিল ক্রীতদাস শিকারির দল। সমুদ্র পেরিয়ে এ ছিল এক অবাধ মানব লুণ্ঠন। ক্রীতদাসের যুগ আর নেই। আফ্রিকার বহুদেশে এখন গৃহযুদ্ধ আর গোষ্ঠীর লড়াই। দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে খোলা আকাশের নীচে। কাটাচ্ছে অনাহারের দুঃসহ জীবন।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের এতোগুলো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখি তাঁর স্বপ্নের আন্তর্জাতিকতাবাদ আজও সফল হয়নি। সফল হয়নি মানবতার মুক্তির স্বপ্ন। তাঁর দেখা ইতিহাসের অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমান আজও রয়ে গেছে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি যে মানবাত্মার বিজয়গাথার স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজকের সময়ে তা আরো বেশি করে প্রসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে আজও রয়েছে সংকট। চলেছে মারণাস্ত্র কেনাবেচা, আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা, শুধু ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য মানব নিধন। এসেছে মূল্যবোধের সংকট। এই সংকট কালও ছিল, আজও আছে। যা প্রতিদিন আমাদের মনুষ্যত্বে আঘাত হেনে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ অভিভাষণে শুনিয়েছিলেন সভ্যতার সংকট। তিনি বেঁচে থাকলে আজও শুনতেন মানবাত্মার ক্রন্দন। হয়তো আবার শোনাতেন নতুন অভিভাষণ। মানুষের প্রতি বিশ্বাস অটুট রেখে আবার নতুন করে লিখতেন সূর্যোদয়ের দিগন্তের কথা। সময়ের স্রোতে আজকের প্রজন্মের কাফেলা অব্যাহত থাকবে। সূর্য ওঠার আগে ভোরের আলোয় তারা কি তাকিয়ে দেখবে দীর্ঘদেহী কেউ চলেছেন তাদের সাথে, দূরে দূরে তাঁর ছায়া। সিংহাবোলকনে মাঝে মাঝে তাদের দেখে নিচ্ছেন সেই পথিক। হয়তো কোথাও আবার লিখতে বসবেন পরাজিত মানুষের জয়যাত্রার ইতিহাস।