তাপস চট্টোপাধ্যায়
আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অন্যতম প্রধান ইন্দ্রিয় হল ‘রসনা’। পঞ্চভূতে সৃষ্ট এই মানব শরীরে ষড়-রিপুর কার্যকারণের সিংহভাগ জুড়ে থাকে রসনার আধিপত্য। রসনা তৃপ্তির এই জাগতিক খেলা থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি। শিশু বয়সেই খাদ্যরসিক কবির কলমে বেজেছিল তার সুলোলিত মূর্ছনা। মাত্র দশ বছরের রবি বাঙালীর নিত্য নৈমিত্তিক অতিসাধারণ এক খাদ্য প্রকরণকে কয়েকটি লাইনে করে তুললেন অসাধারণ,
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—
হাপুস হুপুস শব্দ। চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’
খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্রের ঐতিহ্যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নামডাক কম ছিল না। অবিভক্ত বাঙলার হাতেগোনা কিছু অভিজাত পরিবারের মধ্যে ঠাকুর পরিবারের নিত্যদিনের খানাপিনায় ছিল এক অদ্ভুত স্বাতন্ত্রতার ছোঁয়া। বিশেষ করে ‘পুণ্যাহ’ বা নববর্ষের অনুষ্ঠানে ঠাকুরবাড়ির ভুরিভোজের আয়োজনে থাকতো একাধিক নজরকাড়া রেসিপি ।
দোতলার টানা বারান্দার পাথরের মেঝেতে বিছানো হতো কার্পেটের আসন, কলাপাতা ঘিরে মাটির খুরিতে পরিবেশন করা হতো কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি মাছের পোলাও, আম দিয়ে শোল মাছ সহ একাধিক সুস্বাদু পদ।
শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থেই নয়, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাস্তবিক অর্থে এক বিশ্বকবি। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষের প্রতিটি কার্যকারণের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সংযোগ । দেশ হোক বা বিদেশ, প্রাকৃতিক হোক বা নৈসর্গিক, একই রক্তমাংসে গড়া মানবজাতির জীবনচর্যায় নানান বৈচিত্র মুগ্ধ করতো তাঁকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষার সঙ্গে আর্থসামাজিক এবং বিশেষ করে জলবায়ুর সামঞ্জস্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস তাঁর সৃষ্টিশীল চেতনার প্রেক্ষিত হয়ে উঠেছিল ।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রবাদপ্রতিম গিটারিস্ট ল্যারি করিয়েলকে বলা হয় ফিউসনের জনক। সংগীতের প্রচলিত প্রথা ভেঙে, সুর-তাল-লয়ের চিরাচরিত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাঁর গিটারে ফিউশনের ঝংকার একসময়ে আন্তর্জাতিক সংগীত জগতকে আলোড়িত করেছিল। তেমনই রবীন্দ্রনাথও ঠাকুরবাড়ির হেঁসেলে রন্ধন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা ভেঙে নতুন নতুন ফিউসনের উপাদান যোগ করে রুচি এবং স্বাদে এক অভিনবত্ব আনতে চেয়েছিলেন। ইংল্যান্ড, স্পেন, তুরস্ক, কবি যখন যেখানে গেছেন সেখানেই সংগ্রহ করেছেন মেনু কার্ড। দেশে ফিরে ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘরে সম্পূর্ণ দেশীয় উপকরণে সৃষ্টি হয়েছে হল্যান্ডাইজ সসে স্যামন, ব্রিটিশ পাই, হিন্দুস্থানী তুর্কি কাবাব, ফিলিপিনো চিকেন, আইরিশ টু-এর মতো একাধিক পদ। প্রাচ্যের হেঁসেলে প্রাশ্চাত্যের সুবাস কবিমনে এনেছে এক নবআনন্দের ছোঁয়া। খাদ্যরসিক রবীন্দ্রনাথের পছন্দের তালিকায় প্রাথমিকতা পেতো মাছ এবং মিষ্টি। মাছের চচ্চড়ি থেকে শুরু করে দই-চিংড়ি, ভিনি গার মাছ থেকে টম্যাটো মাছ এমনই একাধিক পদ কবির রসনা তৃপ্তির উপাদান ছিল ।
রবীন্দ্রনাথের রন্ধনপ্রণালীর নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী । তাঁর রন্ধন শৈলীর বিশেষত্ব ছিল সাধারণ উপকরণে অসাধারণ স্বাদের খাবার। কাঁঠাল দই, মাছের তরকারি (যা আসলে মাছ দিয়ে নয়), পটল-চিংড়ির রায়তা, সর্ষে বাটার মাটন,দইয়ের মালপো, পাকা আম দিয়ে চিঁড়ের পুলি, এমনকি একবার তো কবির অনুরোধে তিনি মানকচুর জিলিপিও তৈরি করেছিলেন । স্ত্রীর হাতের নববর্ষের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি ‘এলোঝেলো’ ছিল কবিগুরুর সবচেয়ে পছন্দের, তবে মিষ্টির নামটা পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ‘পরিবন্ধ’। ঠাকুর পরিবারের মহিলাদের মধ্যে মৃণালিনী দেবীর হাতের রান্না ছিল সকলের চেয়ে আলাদা। তাঁর ট্রেডমার্ক রেসিপি ছিল ‘তিন ইঞ্চি ব্যাসার্ধের লুচি’ আর ‘পান্থার বাংলা’ (বাঙালি মাটন)। ১৯৪১ সালে অসুস্থ অবস্থায় কালিম্পং থেকে জোড়াসাঁকো আনা হয়েছিল তখন মৃণালিনী দেবী প্রয়াত হয়েছেন কিন্তু তবু শয্যাশায়ী কবির ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য এই খাবারই তাঁকে খাওয়ানো হতো।
কবিগুরুর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রচলিত একাধিক গল্প থাকলেও তাঁর গুণগ্রাহীদের মুখে যে গল্পটা সবচেয়ে মুখরোচক ছিল, তা হল, ‘সহস্র বৎসরের ডিমের গল্প’ (The century egg)।
‘আমার দেখা নয়া চিন’ গন্থে কবি এই গল্পের সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। সেবার চিন সফরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন এবং চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু। কবির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে সেখানে আয়োজিত হয়েছিল এক মহাভোজের অনুষ্ঠান । কবিগুরুর আগমনে উল্লসিত চিনারা তাদের খাবারের মেনুতে রেখেছিলেন একাধিক ট্র্যাডিশনাল রেসিপি, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘হাজার বছরের পুরোনো ডিমের’ রান্না। অনুষ্ঠানের কর্মকর্তারা অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে কবিকে ডিমের ওই পদ বানানোর যাবতীয় প্রণালীর বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিলেন; প্রথমে মাটির মধ্যে নুন মিশিয়ে তারপর কয়েকটা ডিমে সেই প্রলেপ মাখিয়ে দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করে রাখা হতো মাটির নিচে। যতক্ষণ না পর্যন্ত ডিমের সাদা অংশ কালচে হতো ততক্ষণ পর্যন্ত সেগুলো খাওয়ার উপযোগী হবে না।’ খাদ্য প্রস্তুতির সেই অখাদ্য বিবরণী কবির সঙ্গীদের যতটা উৎকন্ঠা উদ্রেক করছিল কবিকে ততটাই শান্ত নিরুত্তাপ মনে হচ্ছিল। এরপর এসেছিল সেইসব খাদ্যের গলাধঃকরণের মহেন্দ্রক্ষণ। প্রত্যেকের পাতে পরিবেশিত হলো বেশ কয়েকখানা করে সহস্র বছরের ডিমের পদ। একদিকে আতিথেয়তা রক্ষা অন্যদিকে খাদ্যের উপকরণ, এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে কবির সফরসঙ্গীরা যখন বেসামাল তখন দেখা গেল গুরুদেব অম্লান বদনে একের পর এক ডিম খেয়ে যাচ্ছেন। অতঃপর এক যাত্রায় পৃথক ফল সম্ভব নয় ভেবে অনিচ্ছা স্বত্তেও তাঁরাও খাবারে মনোযোগ দেন। এরপর যা হয়, তা একেবারেই কাম্য ছিল না। রাত থেকেই নন্দলাল বসু এবং ক্ষিতিমোহন সেন দুজনেই বমি আর পেটের যন্ত্রণায় কাহিল হয়ে পড়েন। এহেন অবস্থায় গুরুদেবকে সুস্থ সবল দেখে তাঁরা নিশ্চিন্ত হওয়ার চেয়েও অবাক হয়ে কারণটা জানতে চান। গুরুদেব নির্বিকার চিত্তে জানান যে, তিনি তো একটা ডিমও খাননি, ওই সব অখাদ্যগুলো কৌশলে নিজের লম্বা শ্মশ্রুর (দাড়ি) ভিতর দিয়ে জোব্বার মধ্যে সংরক্ষণ করে দিয়েছিলেন ।
শৈশবে মাতৃহারা কবি ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। কেউ ভালোবেসে যখন যেমন পরামর্শ দিতেন, রবীন্দ্রনাথ অক্ষরে অক্ষরে তা মেনে চলার চেষ্টা করতেন । গুণগ্রাহীদের প্রতি এই ভালোবাসা কখনও কখনও তাঁর খাদ্যাভ্যাসকেও প্রভাবিত করতো। তাঁর অনুগত শিষ্যা রানি চন্দ লিখেছিলেন, গুরুদেবের জন্য দিনের বরাদ্দ ছিল দেশি প্রদ্ধতিতে মাছ, মাংস, শাক সবজি রান্না কিন্তু রাতের ডিনার টেবিলে স্থান পেতো বিলাতি খাবার। একবার এক পন্ডিত অতিথি শাস্ত্র পুরাণের অনুষঙ্গ টেনে পরামর্শ দিলেন হবিষান্নই একমাত্র শরীরের পক্ষে উপযোগী আহার। ব্যাস, অমনি লোক ছুটলো হাটে, কুমোরের ঘর থেকে এলো সদ্য পোড়া লাল মাটির মালসা। এবেলা ওবেলা নতুন মালসায় হবিষান্ন খেয়ে গুরুদেব খুব খুশি হয়ে বললেন, এই এতদিনে ঠিকটি হল। কিছুদিন পরেই তাঁর এক বিদেশি বন্ধু জানালেন, ডিমে আছে সব রকমের খাদ্যগুণ। পরদিন থেকেই চাল কাঁচকলা সরে গেল, গুরুদেব কাঁচা কাঁচা ডিম পেয়ালায় ঢালেন, নুন গোলমরিচ মিশিয়ে চুমুক দেন তাতে। আবার কবে এলেন এক আয়ূর্বেদ বিশেষজ্ঞ, আর তাঁর সঙ্গেই শুরু হল গ্লাস গ্লাস তেঁতো নিমপাতার রস খাওয়া।
বনফুল তাঁর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে কবিগুরুর খাওয়া আর খাওয়ানোর গল্প লিখেছিলেন, একবার খুব ভোরে শান্তিনিকেতন পৌঁছেছেন বনফুল। অন্ধকার কাটেনি তখনও, ঠান্ডাও খুব। অথচ অনতিবিলম্বে স্নান সেরে ব্রেকফাস্টের টেবিলে হাজির রবীন্দ্রনাথ । সেদিন আটাত্তর বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের প্রাতরাশের পুংখানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে গিয়ে বিহ্বল বনফুল লিখেছিলেন, ‘নীলমণি খাবার নিয়ে প্রবেশ করল। দেখলাম প্রকান্ড একটি কাঁসার থালার মাঝখানে রুপোর বাটি দিয়ে কি যেন একটা ঢাকা রয়েছে। আর তার চারপাশে তরকারির মতো কি যেন সাজানো রয়েছে সব। কোনওটাই পরিমাণে বেশি নয়, কিন্তু মনে হল সংখ্যায় অনেকগুলো। বারো-চোদ্দ রকম।’ বাটিটা তুলতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকখানি ক্রীম। অন্য জিনিসগুলো নানারকম ডাল আর ফল ভেজানো।
বনফুল লিখেছেন, ‘লক্ষ্য করে দেখলাম মুগের ডাল, ছোলা, বাদাম, পেস্তা, কিসমিস, আখরোট তো আছেই, আরো নানা রকম কি আছে, একটা তো উচ্ছের বিচির মতো দেখাচ্ছিল। নীলমণি দুটো কাঁচা ডিম ভেঙে একটা ডিশে করে দিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাতে গোলমরিচের গুঁড়ো আর নুন দিয়ে নিলেন। নীলমণি দু-টুকরো মাখন মাখানো রুটিও আনল। রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই ডিশে চুমুক দিয়ে ডিমটা খেয়ে নিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুটো শিশি বের করলেন। একটা দেখলাম, মার্কের গ্লুকোজ আর একটা স্যানটোজেন। দুটো থেকেই দু’চামচ বার করে মেশালেন ক্রীমের সঙ্গে।তারপর কিসমিস পেস্তা সহযোগে খেতে লাগলেন সেটা। পরক্ষণেই কফি এলো। কাপে নয়, কেতলিতে। কফি ‘ব্রু’ করার যে বিশেষ ধরনের কেতলি থাকে তাতে।’ এরপর রুটি দুখানায় পড়ল মধু, বনফুল দেখলেন সেটা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি ৷ মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে বলে এলো মুড়ি আর কুসুম বীজ ভাজা। তারপর টাটকা খেজুর রস।
এত কিছু অদ্ভুত অভাবনীয় খাদ্যশৃঙ্খলার মধ্যেও অতিথি আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি ছিল না। বনফুলের জন্য প্রাতঃরাশের মেনুটায় ছিল খাঁটি বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। একই টেবিলে এসেছিল ফুলকো লুচি, আলুর ছেঁচকি, গরম সিঙাড়া, কচুরি, সন্দেশ, সামান্য বিদেশি আঙ্গিকে কেক, বিস্কুট, আপেল, কলা, সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম।
করিগুরুর খাদ্যতালিকার বৈচিত্র্যের মধ্যেও এক সুগন্ধি শৈল্পিক রস ফুটে উঠেছিল, রানি চন্দের স্মৃতিকথায়, চিনে চা’ই পছন্দ করতেন তিনি। সে চা’ও শুকনো বেল জুঁইয়ের। গরম জলে পড়লেই শুকনো পাপড়িগুলো খুলে ফুলের আকার নিত, আমরা দেখে চিনতাম এটা যুঁই, এটা বেলি। কখনো থাকতো শুধুই চন্দ্রমল্লিকা খুদে খুদে আকারের। শুকনো ফুল, গুরুদেব বোধহয় এই ফুলকেই বলতেন ‘সেঁজুতি’।
তিনি এসেছিলেন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুকে একই সুরে বাঁধতে; নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ এর মতোই ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস আর তার স্বাদ গন্ধকে একই ছন্দে গাঁথতে। তাই তো তাঁর সৃষ্টি তাঁকে বিশ্বময় করেছে। তাই তো তিনি শতবর্ষ পরেও সবকিছুতে আজও সমান প্রাসঙ্গিক।