• facebook
  • twitter
Sunday, 8 December, 2024

দূষণ নিয়ে আর কত উদাসীনতা দেখাবে সরকার ও নাগরিক সমাজ?

ক্যালেন্ডারের নিরিখে বছর আসে বছর যায়। রাজ্যের দূষণ-চিত্র বদলায় না। দীপাবলির বাজিতে প্রতিবছর নভেম্বরের আকাশ-বাতাস ধোঁয়ায় ঢেকে যায়।...লিখেছেন বরুণ দাস

ক্যালেন্ডারের নিরিখে বছর আসে বছর যায়। রাজ্যের দূষণ-চিত্র বদলায় না। দীপাবলির বাজিতে প্রতিবছর নভেম্বরের আকাশ-বাতাস ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। এমনিতে সারা বছরই যানবাহনের ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস মুখরিত থাকে দূষণে, তার সঙ্গে বাড়তি যুক্ত হয় ন্ভেম্বরের বাজির তাণ্ডব। এই সময়ে যানবাহনের পাশাপাশি দীপাবলির বাজি-তাণ্ডবে রাজ্যবাসীর অবস্থা চূড়ান্ত শোচনীয় হয়ে ওঠে।

রাজ্যবাসীর জীবন শুধু শোচনীয় কিম্বা অতি-অতিষ্ঠই নয়, ভয়াবহ আকার ধারণ করে এসময়। কীভাবে? এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকেই। কিন্তু এ নিয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই কারও। না সরকার, না জনপ্রতিনিধি, না সাধারণ মানুষ। নাম-কা-ওয়াস্তে আইনি বিধিনিষেধ থাকে। থাকে মহামান্য উচ্চ আদালতের কড়া নির্দেশও এবং রাজ্যের পরিবেশ দপ্তর তথা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাসঙ্গিক ভূমিকাও

দীপাবলির আগে পরিবেশ দূষণ নিয়ে মহামান্য উচ্চ আদালত অনেক সতর্কবাণী জারি করেন. রাজ্য সরকারও বিধিনিষেধ মেনে চলার বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। পুলিশ-প্রশাসনও বাজি পোড়ানোর ব্যাপারে নানাবিধ কড়া পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি দিয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও দীপাবলির রাতে সর্বত্র অঢেল বাজি পোড়ানো থেকে রাজ্যবাসীকে বিরত করা সম্ভব হয় না। এ এক প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজ্যে নির্বাচিত সরকার আছে, আইন-আদালত আছে, সরকারি নিয়মবিধিকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রশাসন-যন্ত্রও আছে। এছাড়াও আছে শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা-নেত্রীরা। যাঁরা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে যে কোনও কাজ কিংবা অকাজ— সবকিছু করতেই বেশ সক্ষম। প্রশ্ন হলো, তা সত্ত্বেও প্রতি বছর কেন এমন জনস্বাস্থ্য-বিরোধী কাজে সাধারণ মানুষ সাহস পান? এ এক গোলকধাঁধাই বটে।

অনেকেই হয়তো অবগত আছেন যে, অতিমারি-জনিত দীর্ঘকালীন লকডাউনকালে বায়ু-দূষণ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কারণ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চলমান যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া আর নির্মাণ-কার্যের ধুঁয়ো-ধুলো মিলে পরিবেশ তথা আকাশ-বাতাস কালো হয়ে থাকার হাত থেকে মুক্ত ছিল সেসময়। কিন্তু লকডাউন উঠে গেলে যে-কে-সেই। অর্থাৎ আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে দূষণের মাত্রা।

ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, দূষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে আবারও কি লকডাউনের পথে পা বাড়াবেন সরকার? ইতিমধ্যে রাজধানী দিল্লিতে এমনই প্রশ্ন উঠেছে। মহামান্য উচ্চ াদালতের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতে স্কুল ছুটির কথা ঘোষণা করছেন রাজ্য সরকার। এমন কি, ঘরে বসেই আপাততঃ সরকারি কাজ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে সরকারি কর্মীদের। লকডাউনকালে যেমনটা করা হয়েছিল।

কিন্তু লাগাতর লকডাউনে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের যে চরম ভোগ-ভোগান্তি হয়, তার সমাধানে সরকার বাহাদুর কি কোনও চিন্তাভাবনা করছেন? না, তেমন কোনও সদর্থক আভাস পাওয়া যায়নি। যাঁরা দিন আনেন, দিন খান— তাঁদের কী হবে? ঘরে বসে কাজ করার কোনও সুযোগই তাঁদের নেই। একদিন কাজে বেরতে না পারলে তাঁদের পরিবারের পেটে খিল মেরে বসে থাকতে হবে।

পরিবেশ দূষণের বাড়াবাড়ির ফলে বড়দের পাশাপাশি ভুগছে পরিবারের ছোটরাও। ঘরে ঘরে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জির মতো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে তাদের। এমনিতেই রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবার অবস্থা তেমন আহামরি নয় যে, হাসপাতালে গেলেই সহজে চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যাবে। তাই সাধারণ মানুষের অবস্থা যে অত্যন্ত কাহিল, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যানবাহন চলাচলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ তো আনা যেতেই পারে। যদি রাজ্য সরকার সত্যিকারেই সমস্যার সমাধানের প্রতি আন্তরিক হন। কী সেই প্রাসঙ্গিক পদক্ষেপ? গণ-পরিবহণের ক্ষেত্রে ব্যাটারি, ইলেকট্রিক কিম্বা সিএনজি চালিত বাস-ট্যাক্সি-অটো-টোটোর বেশি বেশি ব্যবহারের দিকে অবিলম্বে নজর দিতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কিছুটা কড়াকড়ি ব্যবস্থা নিতে হবে।

আর মেট্রো রেলের পাশাপাশি শহর ও শহরতলিকে দ্রুত চক্ররেলের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। দূষণ-বিরোধী এই প্রাসঙ্গিক উদ্যোগগুলো ছাড়া বিকল্প কোনও পথ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। যে কোনও মেট্রো শহরের ভিড় এড়ানো সম্ভব নয়। রুজি-রোজগারের জন্য মানুষ পথে বেরবেনই। তাঁদের যাতায়াতের জন্য যানবাহনও চলবেই। সুতরাং এসব কিছু মাথায় রেখেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে ভাসমান সূক্ষ্ণ কণা ও অতিসূক্ষ্ণ কণা। যা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের কথায়, কলকাতা মহনগর পরিণত হয়েছে আস্ত একটা গ্যাস চেম্বারে। যানবাহানের পাশাপাশি প্রতিবছরই এই সময়ে দীপাবলি ও ছট পুজোয় ব্যাপক হারে বাজি পোড়ানোর কারণে বাতাসে দূষণের মাত্রা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভোটের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যেভাবে দফায় দফায় মিটিং-মিছিল, রোড-শো করে নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের নিজেদের দিকে টেনে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালান, ঠিক তেমনই রাজ্যবাসীর স্বাস্থ্য ও সুস্থতার কথা বিবেচনা করে দীপাবলির আগে বাজি পোড়ানোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার দিকেও চেষ্টা করাটা ফলদায়ক হতে পারে।

এ-ব্যাপারে রাজ্যের দলমত নির্বিশেষে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা (পুরসভা, বিধানসভা, লোকসভা কিম্বা রাজ্যসভার প্রতিনিধিরা) যদি দলীয় কর্মীদের নিয়ে রাস্তায় নামেন এবং প্রচার চালান তো অনেকটাই কাজের কাজ হয়। কিন্তু সে গুড়ে বালি। তেমন জনস্বার্থমূলক কাজে তাঁদের আগ্রহ উৎসাহ কোথায়? তাঁদের যা-কিছু ওই ভোটকে কেন্দ্র করেই। ভোটপর্ব মিটে গেলেই যেন সবকিছু শেষ।

যে সমস্ত ক্লাব-সংগঠন রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রতিবছর মোটা অনুদান পেয়ে থাকে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই এই নাগরিক-সচেতনতার কাজটা সহজেই করা যেতে পারে। যদি শাসকদল সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা আন্তরিক হন। আসলে পরিবেশ সচেতনতার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার দিকটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা না থাকলে এ কাজে এগিয়ে আসা সম্ভব নয়।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই মহতি উদ্যোগে নিজেরা শামিল হলে অনেকেই বাজি পোলানোর সুপ্ত ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে বাধ্য হবেন একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। কিন্তু তেমন মানবিকবোধ সম্পন্ন জনপ্রতিনিধি আাজ কোথায়, যাঁরা মানুষের ভালোর দিকে নজর দেবেন? ভোটের বাইরে অন্য কোনও চিন্তা নেই এঁদের কারও।

আজ বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার লোকের বড়ো অভাব. আমরা অনেকেই মুখে অনেক বড় বড় কথা বলে থাকি। পরিবেশ দূষণ নিয়ে একপ্রস্থ ভাষণ দিতে আগ্রহ দেখালেও কাজের বেলায় নেই। সবাই কেবল অন্যের দোষ-ত্রুটি ধরা নিয়েই ব্যস্ত, নিজেদের দোষ-ত্রুটি নিয়ে কেউ ভাবি না। ভাবার মতো মন-মানসিকতাও আমাদের নেই। সব সমস্যার মূল শেক্ই বোধহয় লুকিয়ে আাছে এখানেই।

আসলে মহামান্য আদালত আর নির্বাচিত সরকারের ঘাড়ে সব দায়দায়িত্ব চাপিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না। নিজেদেরও কিছুটা দায়দায়িত্ব থেকেই যায়। সেই অনিবার্য দায়দায়িত্ব থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখলে নিজেদেরকেই ভুগতে হয়। তার প্রমাণও বহুক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা অনেকেই নিজেদের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি। এটা ভালো নয়।

ভালো তো নয়; কিন্তু সেকথা শুনছেন কে‘ আমরা এখন নিজেদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার কথাও ভুলে যেতে বসেছি। পরিবেশ দূষণের কারণে পাশের বাড়ির কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে না-দেখার ভান করে থাকি। ভাবি, ওর হয়েছে তো আমার কী? আমি তো বেশ সুস্থ আছি। অতএব চুপ করে থাকাকেই সেরা পথ বলে বেছে নিই। আমারও যে ওই একই অবস্থা হতে পারে— তা নিয়ে কখনও ভাবি না।

শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে অনেক বিষয়ে অনেক খবরই রাখি আমরা। অবাক লাগে, যেসব খবরে আমাদের কোনও প্রয়োজন নেই, সেসব নিয়েও আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় মেতে উঠি। সময় নষ্ট করি। কিন্তু যা-কিছু আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতীব প্রয়োজন— তা নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই, বরং এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়।
কোনও না কোনও বাড়ির ছেলেমেয়েরাই তো বাজি পোড়ানোয় অংশ নেয়। সহ-নাগরিকের স্বার্থের দিকটা না-হয় বাদই দেওয়া গেল, আমরা যদি নিজেদের ন্যূনতম স্বার্থের কথা ভেবেও বাড়ির বাজি-প্রেমী ছেলেমেয়েদের ওই ক্ষতিকারক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য চেষ্টা চালাই তো কিছুটা কাজ হতে পারে। কিন্তু তেমন সামাজিক ভূমিকা কিম্বা মানবিক প্রচেষ্টা আদৌ দেখা যায় না।

আজকের অনেক ‘শিক্ষিত’ ও ‘সচেতন’ মা-বাবারা নিজেরাই প্রিয় সন্তানের হতে বাজির বাক্স তুলে দেন। নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে বাজি পোড়ানোর ক্ষতিকারক কাজে সহায়তা করেন। বড়দের কাছ থেকে বাজি-পোড়ানোর উৎসাহ পেয়ে তারা এর ক্ষতিকারক দিকটি থেকে দূরে সরে যায়। অবুঝ সন্তানকে আপাত-খুশি করতে গিয়ে মস্ত বড়ো সামাজিক ক্ষতি করে থাকেন। এটা কি কখনও কাম্য হতে পারে?

পাড়ার কিছু উঠতি বয়েসের যুবকরাও এই সময়ে বাজি পোড়ানোর ক্ষতিকারক খেলায় বেশ মত্ত হয়ে ওঠে। যেমন ৩১ ডিসেম্বরের রাতে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্ষতিকারক বাজি পুড়িয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। পরিবেশ দূষণের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে। নতুন বছরের ক্ষমতা কী সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ উপহার দেওয়ার? কিছু মানুষের অপকর্মে গোটা সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

আলোচ্য নিবন্ধের উপসংহারে এটাই বলার যে, সময় এসেছে আমাদেরকে নতুন করে ভেবে দেখার। ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই না বুঝি, তাহলে আমাদের রক্ষা করার কেউ থাকবে না। এই সহজ-সরল কথাটা বুঝতে হবে। আর নিজেদের স্বার্থেই পাড়ায় পাড়ায় বাজি পোড়ানোর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ ও অবরোধ গড়ে তুলতে হবে।