• facebook
  • twitter
Sunday, 27 July, 2025

মেরুকরণ আর কতদূর বিস্তৃত হবে

মেরুকরণে মনুষ্যত্বের সুচারু বন্ধনই ভেঙে যায়। এতে দেশ এগোয় না। রাষ্ট্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। এর বিরেুদ্ধে আমরা পরস্পরকে সতর্ক করছি।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

মহম্মদ শাহাবুদ্দিন

আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে মেরুকরণের প্রয়াস চলেছে গত তিন দশক ধরে। এই প্রয়াস সাম্প্রদায়িকতাকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। বিভেদের সৃজন তো বহু প্রাচীনকালে। ইতিহাসের তথ্য নিয়ে কাঁটা ছেঁড়ার এখন অবকাশ কম। রাজতন্ত্রের ছত্রদণ্ড, মুকুট, সিংহাসন সবই অস্তাচলে গেছে বহুদিন। তখন বিভেদ ছিল রাজায় প্রজায়। মানুষে বিভেদ এনে শাসন এখন তার নিজস্ব নিয়মেই বিরাজমান। ব্রিটিশ শাসনের সূচনা পর্বটি ছিল অন্য ধরনের। ১৮ শতক থেকেই তাদের শাসনের মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থকে সামনে রেখে। সিপাহী বিদ্রোহের সময়েই ইংরেজরা বুঝেছিল, সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের রুখে দাঁড়ানোর সাহস বার বার জেগে উঠতে পারে। এখানে নানা ধর্মের মানুষের বাস। এক সম্প্রদায়কে যদি অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঝগড়া বিবাদে লেলিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরা আমাদের বিরুদ্ধে লাগবে না। ১৯০৫ এ তাই একবার বঙ্গভঙ্গের নামে বিভেদের পাঁচিল তোলার চেষ্টা হয়েছিল। ১৯০৬ এ জাতীয় কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লিগ তৈরি হল। রবীন্দ্রনাথের ভারত ভাগ্যবিধাতার মন্ত্র রইল, তবুও আমাদের সমস্ত জাতীয় নেতারা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ মেনেই দেশভাগ মেনে নিল। স্বাধীন ভারতের শাসন শুরু হয়েছিল সংবিধানের সুচিন্তিত পরিকাঠামোর পথ ধরে। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা আদর্শগতভাবে থাকলেও শাসকের নিয়ম সেখানে বজায় ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য, মতি পরিবর্তিত হয়েছে। যত দিন এগিয়েছে রাজনীতির ক্ষমতায়নের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে।

শুরু হল একচ্ছত্র ক্ষমতার সূচনা। মাথা তুলল ভেদবুদ্ধি। বহুত্বের ধারণা নিয়ে গড়ে ওঠা দেশকে হঠাৎ করেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের পতাকারা তলায় আশ্রয় এনে ফেলার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। শুরু হয়েছিল একটা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে রূপ দেবার চেষ্টা। মেরুকরণকে স্পষ্টকরার জন্য গণতন্ত্রের বহুস্বরের মধ্যে প্রতিনিয়ত মেশানো হতে থাকল ঘৃণা ভাষণ। যা আজও অব্যাহত। আমরা গণতান্ত্রিক সংবিধান পেয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম ধর্মনিরপেক্ষতায়। সব দেশেই ধনীদরিদ্র থাকে, নানান শ্রেণি থাকে। আমাদের দেশেও তাই। কিন্তু ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাভাস, প্রার্থনাগৃহ নিয়ে এতো বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলে না অন্যত্র। শুধু ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য শুরু হয়েছিল ধর্মীয় মেরুকরণের নির্মম তাস খেলা। ১৯৬১ সালের জব্বলপুর দাঙ্গা, ১৯৬৪-র কলকাতা, ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর, কাশ্মীরের দাঙ্গা, ১৯৯২ বাবরী মসজিদ, ২০০২ এর গোধরা ও গুজরাত কাণ্ড, ২০১৩-র মুজফ্ফর নগর, ২০২৫ এর মুর্শিদাবাদ দাঙ্গা, এর ওপরে চলেছে গোরক্ষকদের আক্রমণ। সেই সঙ্গে ধর্মান্ধতার আক্রোশে যুক্তিবাদী কবি সাংবাদিকদের হত্যা। কেন এমন ঘটনা ঘটছে। কেন মেরুকরণ এত প্রসারিত হয়ে চলেছে। একি আমাদের ঐতিহ্য, ঐক্য, আমাদের সংবিধান, গণতান্ত্রিক অধিকার, প্রজাতন্ত্রের মৌলিক সিদ্ধান্তগুলিকে বদলে ফেলার চেষ্টা।

১৯৯২-এর বাবরি ধ্বংসের ঘটনা যেমন সারা দেশকে আহত করেছিল, তা থেকে মানুষের মনকে অন্যদিকে ঘোরাবার অপচেষ্টাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতের মানুষ চিরকাল ধর্মপ্রাণ। সংবিধানের নির্দেশ তারা মেনেছিল শ্রদ্ধার সঙ্গে। কুৎসা প্রচারে, ঘৃণা ভাষণে এই বোধ বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। ২০১৪-র পর থেকেই শিক্ষা সংস্কৃতিকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় মেরুকরণে বেঁধে ফেলবার চেষ্টা চলেছে। আমরা কবির ভাষায় যতই ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’ বলি না কেন, আমাদের মনের বাঁধন, সংযোগের বাঁধন গড়ে উঠছে না। ইতিহাসের প্রকৃত তথ্যে বিকৃতি ঘটিয়ে তাকে নতুন করে লেখা হচ্ছে। বিজ্ঞানে মেশানো হচ্ছে অপবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা। নিজেদের ক্ষমতায়ণের পক্ষে একটার পর একটা রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঘোষণা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির মনে রাখা দরকার মানুষই তাদের শক্তির উৎস। ধর্ম কোনওদিন শক্তির উৎস ছিল না। আঘাত পেতে পেতে সাধারণ মানুষ নিজের আসল অবস্থানটা বুঝতে পারে। ঘরে অন্ন না থাকলে সব ধর্মের শিশু একই কান্না কাঁদে। সেই কান্না শুনে সব মায়ের বুক একইভাবে তোলপাড় হয়। ধর্মান্ধতার মোড়কে গণতন্ত্রের ফাঁকাবুলি মানুষ ধীরে ধীরে ধরে ফেলেছে। মানুষ মেনে নিতে পারছে না ঘর উজাড় করা বুলডোজারের আঘাত।

মানুষটির কাছে ধর্মাচরণ থেকে জীবনের চাহিদা অনেক বড়। শিক্ষা, জীবিকা, খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার নিয়ে মানুষকে বাঁচতে হয়। মানুষের কাছে বাঁচার অধিকারই বড় অধিকার। মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে মানুষের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে, মানুষকে অমর্যাদা করে বেশি দিন তাঁকে ভুলিয়ে রাখা যায় না। মেরুকরণের শাসনদণ্ড একদিন ঠিক খসে পড়বে। মানুষও একদিন রাজনীতি বুঝবে। একটা কথা সকলেরই ভাবা দরকার—যে রামচন্দ্রের কথা বলে রাজনীতি করা হয়, সেই রামচন্দ্র শুধু মহাকাব্যের নায়ক নন, আমাদের উপমহাদেশের সব ধর্মের মানুষের শ্রদ্ধেয়। এ দেশের প্রচীন সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়, লোক সাহিত্যে, গীতিকাব্যে, লোকনাট্যে তার মহান উপস্থিতি। মধ্যযুগে মুসলিম কবিরা তাঁকে নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। সুলতানি যুগে অনুদিত হয়েছে বহু পৌরাণিক কাব্য। এককালে জাতিধর্ম নির্বিশেষে গ্রাম-বাংলার মানুষ রামায়ণ যাত্রা দেখতে দেখতে বিনিদ্র রাত কাটিয়ে দিত। যাত্রার করুণ দৃশ্যে তাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠত। তুলসী দাস, কৃত্তিবাসী রামায়ণ তো গ্রাম ভারতের ঘরের কথা। রাম চরিত্র আমাদের দেশ-মাটির গন্ধ নিয়ে গড়ে উঠেছিল। এস. ওয়াজেদ আলির ভারতবর্ষ লেখাটি স্মরণে আসে। তাঁর কলমে ফুটে ওঠা রামায়ণ পাঠের ট্র্যাডিশন আজও অম্লান। তাই রামচন্দ্রকে নিয়ে কথায়, আলোচনায়, স্মরণে, অনুভবে তাঁর উপস্থাপনা চলে, কিন্তু তাঁকে নিয়ে ধর্মান্ধতার মোহজাল তৈরি করা চলে না, রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা চলে না, ধর্মীয় মেরুকরণের হীন প্রয়াসও চলে না।

ধর্মান্ধতা থেকে উদ্ভাবিত ভাষ্য যে মেরুকরণ তৈরি করেছে তার পাঁচিল কি একদিন ভাঙবে না। আমাদের ইতিহাসে ঐতিহ্যে, শিক্ষা সংস্কৃতিতে এমনকি নির্বাচনের ভোটযন্ত্রে তার নিকৃষ্ট ব্যবহার চলবে। কালান্তর প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী বার বার মনে পড়ে যায়— ‘সমাজে ধর্মে ভাষায় আচারে আমাদের বিভাগের অন্ত নেই। এই বিদীর্ণতা আমাদের রাষ্ট্রিক সম্পূর্ণতার বিরোধী। কিন্তু তার চেয়ে অশুভের কারণ এই, যে এই বিচ্ছেদ আমাদের মনুষ্যত্ব-সাধনার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। মানুষে-মানুষে কাছাকাছি বাস করে তবু কিছুতে মনের মিল হয় না, কাজের যোগ থাকে না, প্রত্যেক পদে মারামারি কাটাকাটি বেধে যায়, এটা বর্বরতার লক্ষণ। … যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনও বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে-দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটেকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে-দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে-দেশকে বাঁচাতে পারে।’ মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা—এতে মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব বাড়ে। কাছাকাছি থাকাটাই তো সমাজ। এইভাবেই ইতিহাস এগিয়েছে।

মেরুকরণে মনুষ্যত্বের সুচারু বন্ধনই ভেঙে যায়। এতে দেশ এগোয় না। রাষ্ট্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। এর বিরেুদ্ধে আমরা পরস্পরকে সতর্ক করছি। দুঃখের কথা, আবার নিজেরাই বিভিন্ন মেরুতে বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়ছি। একাত্মতা একটা বোধ। এই বোধ অর্জন করতে হয়, লালন করতে হয়। কবির ভাষায় আবার বলতে হয়— ‘জীবনে জীবন যোগ করাই আসল একাত্মতা।’ আমাদের সমাজে চিরকাল বৃত্তিগত জাতি বিভাজন ছিল। সমাজ বিন্যাসেই তা মিশেছিল। ধর্ম, বৃত্তি নিয়ে এক ধরনের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিহীন অবস্থানের আয়োজনে আমরা এখন লিপ্ত। মেরুকরণের বিরুদ্ধে আমরা যতই সোচ্চার হই না কেন জীবনে জীবন যোগ করার সুহৃদয় সম্বন্ধ সূচিত না হলে বিভেদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।