হীরেন্দ্রনাথ দত্ত
পূর্ব প্রকাশিতর পর
Advertisement
চিন্তা শক্তি এবং ভাষার শক্তি বর-কনের মতো আঁচলে গাঁট বাঁধা। চিন্তার সঙ্গে তাল রাখবার জন্যে ভাষাকে সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। কথার ভার কমিয়ে ধার বাড়াতে হয়। অল্প কথায় অনেক কথা বলার শক্তি অর্জন করা চাই। চিন্তা অতি দ্রুতগামী, নিমেষে যোজন পথ অতিক্রম করে। ভাষা যদি গড়িমসি করে চলে, তাহলে সে চিন্তার সঙ্গে সমান তালে চলবে কি করে?
Advertisement
আমাদের কথাসাহিত্যে তার মান মর্যাদা মোটামুটি রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু প্রবন্ধ সাহিত্য সম্বন্ধে সেটা খুব জোর গলায় বলা চলে না। বঙ্কিম যুগে, রবীন্দ্র যুগে প্রবন্ধ যে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল, আজ কি তার সে প্রতিষ্ঠা আছে? চিন্তাশক্তির প্রয়োজন সাহিত্যসৃষ্টির সকল ক্ষেত্রেই; তাহলেও বলব, প্রবন্ধ সাহিত্যে ঐটিই প্রধান সহায়, প্রধান সম্বল। চিন্তাশক্তি ক্ষীয়মান হলে প্রবন্ধের প্রাণশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে; আর প্রবন্ধের বাহন যে গদ্যভাষা, সেও নির্জীব হয়ে পড়ে। মনে হয় একটু ভাবনার কারণ ঘটেছে। চিত্রকলা, সংগীতকলার সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যকে বলেছিলেন মুখরা। বলেছেন, মুখরার মন রাখা বড় সহজ নয়। দুর্ভাবনার কারণটা ওখানেই। মুখরার মন রক্ষার কথা ভাবতে হবে আজকের লেখকদের, সাহিত্যিকদের। প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে না এমন নয়, লেখক প্রচুর, লেখাও প্রচুর। কিন্তু প্রশ্নটা প্রাচুর্যের নয়, উৎকর্ষের। বেশির ভাগ প্রবন্ধই বস্তুভারে পীড়িত, প্রসাদগুণে বঞ্চিত— ঠিক সাহিত্য পদ-বাচ্য নয়। প্রবন্ধ জিনিসটা প্রধানত মননশীলমনের চিন্তার ফসল। সেই চিন্তার উদ্দীপনার সঙ্গে যখন ভাষার মুন্সিয়ানা যুক্ত হবে, তখনই প্রবন্ধ খাঁটি সাহিত্য বলে স্বীকৃত হবে। নানা কারণে বাঙালির চিন্তাশক্তি আজ রাহুগ্রস্ত, ফলে বাংলা ভাষাও কিয়ৎ পরিমাণে অবসাদগ্রস্ত। মনে হয় বাংলা গদ্য হঠাৎ গতিপথ হারিয়ে এক জায়গায় থম্কে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে সকলেই জানেন, রাহুগ্রাস দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাঙালির চিন্তা অচিরে মুক্তি লাভ করবে এবং বাংলা গদ্য তার গতিবেগ আবার ফিরে পাবে।
পরিশেষে একটি কথা সবিনয়ে বলছি। আনন্দ দানই সাহিত্যের—গদ্যপদ্য উভয়ত—প্রধান কর্তব্য। আনন্দ দানের সঙ্গে সাহিত্য পরোক্ষভাবে আরো একটি মস্ত বড় কাজ করে। অরবিন্দ তার আভাস দিয়েছিলেন। বঙ্কিম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেচিলেন— বঙ্কিম যেখানে উপন্যাস রচনা করেছেন সেখানে he is a poet কিন্তু যেখানে তিনি প্রবন্ধ রচনা করেছেন সেখানে he is a nation-builder। লেখক মাত্রেই, বিশেষ করে যাঁরা প্রবন্ধ রচয়িতা তাঁরা, এ কথাটি স্মরণ রাখলে দেশ গঠনের জাতি গঠনের কাজে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হবেন বলে মনে করি।
(সমাপ্ত)
Advertisement



