শৃঙ্খলা— এই শব্দটি ভুলেই গেল রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি। যে দলে শৃঙ্খলা কোনওভাবেই বিঘ্নিত হতে পারে না— সেই শাসক দলে তৃণমূল কংগ্রেসেও শৃঙ্খলার অভাব এখন প্রকট হয়ে দেখা যাচ্ছে, যদিও এই দলের মাথায় যিনি বসে আছেন, তিনি এই দলের সর্বাধিনায়িকা— যিনি দলে বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করার মানুষ নন। আর তার জন্যই দল বড় হয়ে তার শাখাপ্রশাখা চারদিকে বিস্তার লাভ করলেও, দলে শৃঙ্খলা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়নি। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি অতি শক্ত হাতে দলের হাল ধরে আছেন, তেমনই দলে শৃঙ্খলা রাখতে কড়া ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছেন। আবার শাসন কার্যেও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জনহিতকর, কল্যাণকর প্রকল্পগুলি সেই ২০১১ সাল থেকে বাস্তবীকরণ করে রাজ্যের মানুষের জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ এনে দিয়েছেন।
তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে দলে শৃঙ্খলার অভাব এবং গোষ্ঠী কলহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু সবাই জানেন, তিনি তা বাড়তে দেবেন না— কিন্তু যাঁরা এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, তাঁরা শুধু দলেরই ক্ষতি করছেন না, সাধারণ মানুষের কাছ তাঁরা অপ্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন। এই গোষ্ঠীকলহ এখন মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে, যা আশা করা যায় না। এক বছর পরেই— অর্থাৎ ২০২৬ সালে বিধানসভার নির্বাচন। দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী এখন থেকেই দলের নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, ছাব্বিশের নির্বাচনে তাঁর দল দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে চতুর্থবার রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসবে। সুতরাং তার জন্য এখন থেকেই প্রচারে নেমে পড়ার প্রয়োজন। কিন্তু এই নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতো ওই ফল পেতে হলে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা রক্ষা করে এগোতে হবে। দলে গোষ্ঠীকলহ থাকলে, তার সুযোগ নেবে বিরোধী দলগুলি। যদিও এই দলগুলির মধ্যেও শৃঙ্খলার অভাব।
ছাব্বিশের নির্বাচন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির জেরে ছাব্বিশ হাজারেরও বেশি শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। ২০১৬ শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশন যে তালিকা/প্যানেল তৈরি করেছিল তাতে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতির কারণে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সেই তালিকা বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছে। ফলে পুরো প্যানেল বাতিল হওয়ার কারণে যোগ্য ও অযোগ্য সবারই চাকরি চলে গেছে। প্রমাণপত্র এবং সঠিক তথ্য না থাকার কারণে এই তালিকায় যাঁরা পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেয়েছিলেন, সেই যোগ্য শিক্ষকদের আলাদা করা কঠিন হয়ে গেছে। সুতরাং যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি হারাবার ব্যাপারে এই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক কারচুপির প্রভাব জনমানসে যে পড়বে, তা নিয়ে শাসক দলের শীর্ষকর্তারা চিন্তিত। তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, যিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন এসএসসি প্যানেলতৈরিকরেছিল, তিনি এখন জেলে।
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)ও এই নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছে, যেমন দেখেছিল গত বিধানসভা নির্বাচনেও। সেই নির্বাচনে এই দলের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য ফলাফল সন্তোষজনক হওয়া তো দূরের কথা, মাত্র ৭৭টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এই দলের সর্বভারতীয় নেতারা রাজ্য বিজেপি নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন এখন থেকেই ছাব্বিশের নির্বাচনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু এই রাজ্য দলের নেতাদের মধ্যেও দলাদলি এবং শৃঙ্খলার অভাব। দলের শীর্ষনেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। দলে পূর্ণ সময়ের জন্য কোনও সভাপতি নেই। যিনি সভাপতি ছিলেন, তিনি এখন সাংসদ। সুতরাং দলের সাংগঠনিক কাজ সেভাবে দেখাশোনা সম্ভব নয়। দলের প্রাক্তন সভাপতির সঙ্গে অন্যান্য নেতাদের মিলের অভাব। একমাত্র বিরোধী দলনেতা দলের কাজে বিশেষভাবে সক্রিয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) জানিয়েছে, একা বিজেপির পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করা খুব কঠিন। সুতরাং আরএসএসে র কর্মীরা, যাঁরা শৃঙ্খলাপরায়ণ বলে দাবি করেন, নির্বাচনে দলের হয়ে কতটা কাজ করতে পারবেন, তা বোঝা শক্ত। দলের নেতাদের মধ্যে কোন্দল এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এই দলকে দুর্বল করে তুলেছে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের দলের দুই শীর্ষনেতা, তার মধ্যে একজন প্রাক্তন মন্ত্রী দলত্যাগ করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই যখন অবস্থা, তখন বিজেপির পক্ষে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের মতো শক্তিশালী দলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে নির্বাচনে জেতা এবং রাজ্যের শাসনভার হাতে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।
এই দুই দলের তুলনায় সিপিএম এখন দুর্বল হলেও, রাজ্য নেতাদের মধ্যে দলাদলি নেই। সিপিএম একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ দল বলে পরিচিত এবং দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় রাজ্যের শাসনকাজ চালিয়েছে। সিপিএম সম্ভবত এবার অন্য সহকারি দলগুলির সঙ্গে সমন্বয় ও সমঝোতা করে ছাব্বিশের নির্বাচনে লড়বে। এবার এই দল কংগ্রেসের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে লড়বে বলে মনে হয় না। বাকি রইল কংগ্রেস— যে দল এখন রাজ্যে দুর্বলতর। সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতারা রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের বলেছে, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে।