• facebook
  • twitter
Saturday, 14 June, 2025

শৃঙ্খলা ও মোটিভেশনের সঠিক পথেই সন্তোষ ট্রফি জয়: সৌরেন দত্ত

সাফল্য পেলে এসব প্রসঙ্গ ওঠেনা। ব্যর্থতার ক্ষেত্রে এইসব প্রশ্ন সামনে আসে।

প্রতীকী চিত্র

প্রশ্ন: কোচ সঞ্জয় সেনের জন্মদিন সেলিব্রেশনে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে আপনি বক্তব্য রেখেছিলেন। আপনার মোটিভেশনাল স্পিচে তো ছেলেদের বেশ উজ্জীবিত দেখা গেল।

সৌরেন দত্ত: কোচ সঞ্জয় সেন আমার খুব ভালো বন্ধু‌। একসঙ্গে আমরা রেল দলের হয়ে খেলেছি। একসঙ্গে আমরা রেল দলকে কোচিং করিয়েছি। তার জন্মদিনে ছেলেদের কাছ থেকে কি উপহার আমরা চাইতে পারি? আমরা সন্তোষ ট্রফির মূল পর্বের খেলা শুরু করতে যাচ্ছি, সন্তোষ ট্রফি জয় আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সেই সন্তোষ ট্রফি জয় করে ট্রফিটা কোচের হাতে তুলে দিতে পারলে, সেটাই তো জন্মদিনে কোচকে সেরা উপহার দেওয়া হবে। সে অর্থেই আমি বক্তব্য রেখেছিলাম। এবং ছেলেরা সেটা করতে পেরেছে। আমি তো মনে করি, সঞ্জয়দা এবার জন্মদিনে যে উপহারটা পেলেন—এটা তার সারা জীবনের সেরা উপহার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন: দিব্যেন্দু বিশ্বাস, রাজ বাসফোর,অরিজিৎ বাগুই, জিতেন মুর্মু–কত বড় নাম নিয়েও গতবছর সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দল ব্যর্থ হলো। তুলনায় জুয়েল আহমেদ, অয়ন মন্ডল, রবিলাল মান্ডিদের মতো অনামী ফুটবলারদের নিয়ে আপনারা সাফল্য পেলেন। কিভাবে সম্ভব হল?

সৌরেন দত্ত: খেলায় হার-জিত আছে‌। যেকেউ যেকোনো সময় আটকে যেতে পারে। এসব খেলার অঙ্গ। কিন্তু সবাই চ্যাম্পিয়ন হতে চায়। এটা তো ঠিক, রবি হাঁসদা ও রবিলাল মান্ডিরা কোন প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আজকে পাদপ্রদীপের আলোয় পৌঁছে গেল‌। সন্তোষ ট্রফির প্রস্তুতির প্রথম দিন থেকেই সঞ্জয়দা আমাদের সামনে একটা টার্গেট ঠিক করে দিয়েছিলেন‌। সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন আমাদের হতেই হবে।আমরা সেই টার্গেটকে সামনে রেখে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং তাকে সার্থক করতে আমাদের প্রয়াসের কোনপ্রকার ঢিলেমি ছিলনা‌। টিম সিলেকশন,প্র্যাকটিস সেশন,ম্যাচ খেলার আগে বিপক্ষ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা ছাড়াও ইউটিউবে বা মাঠে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিপক্ষ টিমের ম্যাচ আমরা দেখেছি। বিপক্ষ টিমকে বিচার করে টিম গঠনের ক্ষেত্রে ছেলেদের বিভিন্ন দিক ভেবেছি। যেমন, হাইট বা অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বড় কৃতিত্ব ছেলেদের। তারা আমাদের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। ওদের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল দেখার মতো। আইএসএল ও আই লিগে কাজ করার অভিজ্ঞতা সঞ্জয়দার ছিল।সঞ্জয়দার সেই অভিজ্ঞতা আমাদের টিমের সাফল্য পেতে সাহায্য করেছে।

প্রশ্ন: বাংলা দলগঠনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের একটা অভিযোগ বরাবরই থাকে। এবার তা কতটা এড়ানো গেছে ?

সৌরেন দত্ত: সাফল্য পেলে এসব প্রসঙ্গ ওঠেনা। ব্যর্থতার ক্ষেত্রে এইসব প্রশ্ন সামনে আসে। আমি ও অর্পণ প্রিমিয়ার ডিভিশন টিমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা বিভিন্ন দলের ফুটবলারদের দেখেছি। আমাদের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল। কারা কোন ক্লাবে কেমন খেলছে, তার ভিত্তিতে টিম লিষ্ট বানিয়েছি। সঞ্জয়দা এবার প্রিমিয়ার ডিভিশনের কোন ক্লাবে কোচিং করেননি। কিন্তু সঞ্জয়দা টিভিতে বিভিন্ন ম্যাচ দেখে প্রথমে ৩০টা ফুটবলারের নাম বেছে নিয়েছিলেন। এবং তার সেই টিম লিষ্টের সাথে আমাদের দেওয়া প্লেয়ারদের নামের তালিকায় অনেক মিল হয়ে গেছে।ফলে প্লেয়ার সিলেকশনের কাজ আমাদের অনেক সহজ হয়েছে। আমাদের টিমটা এতটাই ভালো হয়েছিল যে, রির্জাভ বেঞ্চ আমাদের খুব স্ট্রং ছিল। যখন যে সুযোগ পেয়েছে সে এমন খেলে দিয়েছে,পরের ম্যাচে তাকে বসাতে গিয়ে ভাবতে হয়েছে। সবার নিষ্ঠা, ভালো ফুটবল এবং অবশ্যই ভাগ্যের সহায়তা ছিল।সব মিলিয়ে সাফল্য এসেছে। একটা বড় উদাহরণ দেওয়া যায়। ফাইনালে খেলা প্রায় অতিরিক্ত সময়ের দিকে চলে যাচ্ছিল। যেহেতু নরহরি শ্রেষ্ঠা ভালো পেনাল্টি শুটার। তাই আমরা ওকে চেঞ্জিং করে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু খেলার একদম শেষ মুহূর্তে রবি হাঁসদা গোলটা পেয়ে গেল। এই মুহূর্তগুলো আমাদের কাজে দিয়েছে।

প্রশ্ন: বাংলা দল সাফল্য পেল অতঃপর কি ধরনের পরিকল্পনার প্রয়োজন?

সৌরেন দত্ত: বাংলা দল সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সরকার প্রত্যেক ফুটবলারকে চাকরি দিয়েছে‌। পরের জেনারেশনের কাছে বাংলা দলের হয়ে ভালো খেলার এটাই তো সবচেয়ে বড় প্রেরণার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেল। ছেলেদেরকে ফুটবল ক্যারিয়ারে আরো অনেক বেশি পেশাদারিত্ব আনতে হবে। টার্গেট পূরণ করতে গেলে নিজেদেরকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অল্পতে খুশি হয়ে গেলে চলবেনা‌। মণিপুর ও মিজোরামের ছেলেরা যে খেলাটা খেলতে পারে,আমরা সেই খেলাটা কি খেলতে পারিনা? আমাদের খেলায় কোথায় খামতি থাকছে? আইএসএল, আইলিগ কিংবা ইষ্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান খেলার জন্য নিজেদের তৈরি করতে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু কলকাতা লিগ কাঠামোয় ছেলেরা নিজেদের তেরি করার পর্যাপ্ত সুযোগ কি পায়?

সৌরেন দত্ত: এক মরশুমে একজন খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে ১২/১৩টা ম্যাচে যথেষ্ট ‘ম্যাচ টাইম’ পাওয়া যায়না। লিগে বিদেশি খেলোয়াড় খেলানো বন্ধ হয়েছে। বাংলার ছেলেদের খেলার সুযোগ বেড়েছে। ছেলেরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে সকলের মনে ছাপ ফেলেছে। এবার কর্মকর্তাদের ছেলেদের সুযোগ করে দিতে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন। আমাদের খেলার সময় পরের মরশুমের টার্গেট খেলোয়াড়দের নাম কাগজে এসে যেত‌। বড় দলের কর্মকর্তারা সেই নামের প্রতি নজর রাখত। বাংলার খেলোয়ারদের মান যথেষ্ট ভালো কিন্তু পরিচর্যার অভাবে যথেষ্ট পরিমাণের খেলোয়াড়রা আর কলকাতা মাঠে খেলেনা।

প্রশ্ন: কলকাতা লিগের জন্য খেলোয়াড়দের খামতি পড়ছে কেন?

সৌরেন দত্ত: আমাদের সময় হাওড়া থেকে বাসে উঠতে পারতাম না। সবার কাঁধে ব্যাগ থাকতো। আবার বাসে উঠে আমরা প্রত্যেক ছেলেদেরকে চিনতাম। এখন এক ক্লাবের ফুটবলার অন্য ক্লাবের ফুটবলারদের চেনেনা। জেলায় নিয়মিত খেলা হয়না। গড়ের মাঠে তারপরও যে সমস্ত ফুটবলাররা খেলতে আসে, তাদের সঙ্গে ক্লাবের পেমেন্ট নিয়ে সঠিক বনিবনা হয়না। কলকাতা মাঠে খেলতে গেলে প্রচুর খরচ হয়। সপ্তাহে চার দিন প্র্যাকটিসে আসলে তার যাতায়াত, খাওয়া দাওয়াতে প্রতিদিন কত খরচ হয়ে যায়। কলকাতা ক্লাবে খেলতে আসলে থাকার বন্দোবস্তও ভালো নেই। মাসের শেষে তার হিসেব করলে, ক্লাব থেকে যে টাকা পাওয়া যায়, তার থেকে বেশি খরচ হয়। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কেউ কলকাতায় খেলতে আসবে?
একটা বুট কিনতে ভালো খরচ হয়। যেহেতু ক্লাব ও খেলোয়াড়দের মধ্যেকার প্রতিটি চুক্তিপত্র আইএফএতে থাকে, তাই আইএফএর এদিকে নজর দেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: কিন্তু কলকাতার ক্লাবেরা তো ভিন্ন রাজ্যের ফুটবলারদের আনছে। তাদের ভালো পেমেন্ট দিতে হয়। তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। ক্লাবগুলো বাংলার ছেলেদের ভালো পেমেন্ট দিলেও তারা ক্ষেপের মাঠে চলে যাচ্ছে। একের সাথে অপরকে মেলানো কি যাচ্ছে?

সৌরেন দত্ত: পারস্পরিক দোষারোপের বিষয় এটা নয়। এখন কলকাতা লিগের খেলা কল্যাণী বা উলুবেড়িয়ার মত দূর-দূরান্তের মাঠে খেলতে হচ্ছে। ক্লাবগুলোর খরচ অনেক বেড়েছে। ভালো স্পন্সর ক্লাবগুলো পাচ্ছে না। কটা ক্লাবের ভালো বাজেট থাকে? আর ভিন্ন রাজ্যের ফুটবলারদের মুষ্টিমেয় কয়েকটা ক্লাব নিয়ে আসছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্লাবের তো সমস্যা ভিন্ন। আমাদের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন করতে হবে। একটা সাফল্য অনেক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। যারা আজকে ক্ষেপের মাঠে অল্প পয়সার জন্য ছুটে যাচ্ছে, তারাই একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারবে। কলকাতা ক্লাবের হয়ে ভালো খেলা ও বাংলার হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে সাফল্য এনে দিতে পারলে, তাদের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন হবে। এটা খেলোয়াড়দের বুঝতে হয়।

প্রশ্ন: যারা সাফল্য পেল এবং যারা আগামীদিনের সাফল্য পেতে চায়, প্রত্যেক ফুটবলারদের ক্ষেত্রে আপনার কি বার্তা থাকবে?

সৌরেন দত্ত: প্রথমত আমি খেলোয়াড়রা যে ক্যাম্পের থেকে উঠে আসছে, সেই ক্যাম্পের কর্মকর্তাদের বলবো, মানের বিচার করে আপনারা ফুটবলারকে নির্দিষ্ট বিভাগে খেলতে দিন। দ্বিতীয়ত, এখন এজেন্টদের যুগ চলছে। তারা ঠিক করে দিচ্ছে কোন ফুটবলার কোথায় কোন ক্লাবে খেলবে। এতে করে অনেক ফুটবলার তাদের নির্দিষ্ট ক্লাবে যথেষ্ট ‘ম্যাচ টাইম’ পাচ্ছেনা। তাদের ফুটবল জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই সঠিক পরামর্শগুলো দেওয়ার মানুষজনদের খুব প্রয়োজন। সঠিক পরামর্শ না পেয়ে খেলোয়াড়রা ভুল পথে চলে যাচ্ছে। খেলোয়ারদের টার্গেটের কথা আগে বলেছি। সবসময় মনে রাখতে হবে, শৃঙ্খলা এবং নিজেকে যদি নিজের মোটিভেশন করার ক্ষমতা না থাকে, বড় জায়গায় যাওয়া যাবেনা। বাংলা দলের সাফল্যে এখন সময় এসেছে, সব পক্ষকে একত্রিত হয়ে বসে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই বাংলার ফুটবলের কিভাবে উন্নতি করা যায়, তা ভাবতে হবে।