• facebook
  • twitter
Wednesday, 23 April, 2025

কংগ্রেস আছে কংগ্রেসেই, অস্তিত্বের সঙ্কটে ‘ইন্ডিয়া’ জোট

২০১৯-এর তুলনায় ৪৭টি বেশি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস

ফাইল চিত্র

পুলক মিত্র

১৫ জানুয়ারি, ২০২৫। দিল্লিতে কংগ্রেসের নতুন সদর কার্যালয় ‘ইন্দিরা ভবনে’র উদ্বোধন হল। ঝকঝকে নতুন কার্যালয়ে টাঙানো হয়েছে ১৮৮৫ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের দলের উল্লেখযোগ্য নেতাদের ছবি। বিভিন্ন সময়ে যাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন, কিংবা, নতুন দল গড়েছেন, রয়েছে তাঁদের ছবিও। তবে রাজনৈতিক মহলে যে প্রশ্নটি নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে, তা হল, এর নাম ইন্দিরা ভবন রাখা হল কেন? মহাত্মা গান্ধী, দাদাভাই নওরোজি, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, বাল গঙ্গাধর তিলক থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরুর মতো আরও অনেক নেতা ছিলেন, যাঁদের নামে এই ভবনের নাম রাখা যেত। কিন্তু তাঁদের সরিয়ে ইন্দিরার নামে কেন? বিশেষত জরুরি অবস্থার মতো গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধকারী অধ্যায়ের সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে, সেই ইন্দিরার নামে দলের প্রধান কার্যালয়ের নাম কেন?

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করলেও, কংগ্রেস আছে কংগ্রেসেই। ১৪০ বছরের পুরনো এই দলটি এখনও রাজনীতির জটিল অঙ্কের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারেনি। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনেই তা স্পষ্ট। দিল্লি দেশের রাজধানী। তাই দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির ক্ষমতাসীন দল আম আদমি পার্টি (আপ) ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গী ছিল। অথচ দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে দুই দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই সবার নজর কেড়েছে, যার ফায়দা তুলেছে বিজেপি।

গত লোকসভার ভোটে ২০১৯-এর তুলনায় ৪৭টি বেশি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। তেলেঙ্গনা, ঝাড়খণ্ড এবং জম্মু-কাশ্মীরে দলের সাফল্য নজর কাড়লেও, অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, ওড়িশা এবং সিকিমে শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। হরিয়ানায় জয়ের দোরগোড়ায় গিয়েও ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়া এবং এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি মহারাষ্ট্রে খারাপ ফল নেতৃত্বের দুর্বলতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই মুহূর্তে বিজেপি-র মোকাবিলা করতে হলে, নেতৃত্বকে ঢেলে সাজানো ও সংগঠনকে মজবুত করা একান্ত প্রয়োজন। আর সেই লক্ষ্যে জাতীয় ও রাজ্য-স্তরে ধারাবাহিক কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে।

কংগ্রেসের নেতৃত্ব ও সংগঠনে, বিশেষ করে আদর্শগত দিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন উঠে আসছে। বিজেপি প্রধান প্রতিপক্ষ। তাই বিজেপিকে নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, যে কোনও নির্বাচনে, তা জাতীয়, রাজ্য, বা স্থানীয়, যে কোনও পর্যায়ের নির্বাচন হোক না কেন, আপ, তৃণমূল, কিংবা ইন্ডিয়া জোটের শরিক অন্য আঞ্চলিক দলগুলি সম্পর্কে দলের অবস্থান কী হবে, সেই কৌশল চূড়ান্ত করা। লোকসভা ভোটে বিজেপি-র বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়লেও, এখন ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ভোটের পর সেই অর্থে জোটের শরিকদলগুলির নিয়মিত কোনও বৈঠকই হয়নি, যার জন্য দায়ী করা যায় কংগ্রেসকে। কংগ্রেসের দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ বা তৎপরতা চোখে পড়েনি।

তাই দিল্লিতে এই মুহূর্তে যেমন আপের সঙ্গে কোনও বনিবনা নেই, তেমনই উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে কংগ্রেসের কয়েক যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন কংগ্রেসকে বারবার কাঠগড়ায় তুলছে তৃণমূল। কংগ্রেসকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করতেও ছাড়ছেন না তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব।

স্বয়ং তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন। মমতার মতে, কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণেই ‘ইন্ডিয়া জোটের’‌ পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল হয়নি। এবারের কলকাতা বইমেলায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘বাংলার নির্বাচন ও আমরা’ বইটিতে মমতা লিখেছেন, “তৃণমূল কংগ্রেসের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও ইন্ডিয়া জোট সাফল্য পেল না। কারণ কংগ্রেসের ব্যর্থতা। আমরা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলাম বিজেপির বিরুদ্ধে জাতীয় রাজনীতিতে একটা শক্তিশালী জোট হোক। যেখানে সব বিরোধী দল থাকবে। তারা বিজেপিকে হারাতে পারবে। আমি প্রথম থেকে বলেছিলাম, আমাদের বিকল্প মুখ, ইস্তাহার এবং কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম থাকা উচিত। জোটের নাম ‘ইন্ডিয়া’ হোক এটা আমার প্রস্তাব ছিল। কংগ্রেসের মনে যাতে কোনও দ্বিধাবোধ না থাকে তার জন্য জোটের সভাপতির পদ তাদের দেওয়া হয়েছিল। তারপরও না হল কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম, না হল যৌথ ইস্তাহার। যে যার বিরুদ্ধে লড়াই করল। সেই ব্যর্থতার জেরেই বিজেপি গরিষ্ঠতা না পেয়েও ক্ষমতায় ফিরল।”

কংগ্রেস সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুল্যায়ন, “নিজেদের শক্তি নেই। যে সংখ্যক আসন তারা পেয়েছে, সবই শরিক দলের উপর ভর করে। আর বাংলায় তারা ছিল বিজেপি–সিপিএমের সঙ্গে রাম–বাম–শ্যাম জোটে। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্যের পিছনে মানুষের সমর্থন ও তার উন্নয়নমূলক কাজ। কংগ্রেসের ব্যর্থতার জন্যই বিজেপি পুনরায় কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করল।”

দিল্লির নির্বাচনে আম আদমি পার্টিকে নিঃশর্ত সমর্থন করেছে তৃণমূল কংগ্রেস, শিবসেনা (‌ইউবিটি)‌, সমাজবাদী পার্টি। দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়া জোটের প্রধান শরিকরা এখন আর কংগ্রেসের সঙ্গে নেই। লোকসভা ভোটের এক বছরও কাটেনি। এর মধ্যেই জোটের দফারফা। এমনকী তৃণমূল কংগ্রেস এবার রাজধানীর মাটিতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হয়ে প্রচারেও নেমেছিল। সেক্ষেত্রে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও মুখ খুলতে হয় তৃণমূলকে।

বিজেপি হিন্দুত্বের রাজনীতি চালিয়ে গেলেও, কংগ্রেসের পাল্টা কৌশল কী হবে, তা স্পষ্ট করা দরকার। দিল্লির ভোটে কেজরিওয়াল নিখরচায় বিদ্যুৎ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পে টাকা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেও, কংগ্রেস বিকল্প কিছু তুলে ধরতে পারেনি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও নারী কল্যাণ এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিল শীলা দীক্ষিত সরকার। সেই সাফল্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান কংগ্রেস নেতৃত্ব।

১৯৭৫-এ সংবিধানের ৩৫৬ ধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। তাই গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে কংগ্রেসকে বারবার বিঁধে এসেছে বিজেপি। যে কোনও রাজনৈতিক দলের সাফল্যের মূল ভিত্তি হল, নেতৃত্ব, সংগঠন এবং অবশ্যই জনমানসে জনপ্রিয়তা। গত লোকসভা নির্বাচনে সাফল্যের পথ ধরে নিজের নেতৃত্বকে অনেকটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন রাহুল গান্ধী। কিন্তু দলের সর্বস্তরে নেতৃত্ব তুলে আনার ক্ষেত্রে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না কংগ্রেস। তাই দিল্লিতে একটি আসনেও জিততে পারেনি কংগ্রেস।