শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
‘পাগ’ ও ‘পাগড়ি’ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘প্রগ্রহ’ থেকে। (মানে ঘোড়ার লাগাম। এই ব্যুৎপত্তি সুনীতিবাবুর দেওয়া।) মধ্য বাংলায় ‘বেঠন পাগ’ (অর্থাৎ মাথা-ঘেরা টুপি) বোঝাত ইংরেজী cap-এর অর্থ।
রেশমের পবিত্র বসন অর্থে ‘চেলি’ শব্দ সংস্কৃত থেকে নেওয়া।
জয়দেবের সময় থেকে ‘নিচোল’ শব্দ বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অর্থ, আঁটসাঁট জামা। হয়ত সেই সঙ্গে আঁটসাঁট ইজেরও। মুসলমান আমলের আগেও ইজেরের ব্যবহার আমাদের দেশে অজানা ছিল না। তান্ত্রিক বৌদ্ধ পূজা প্রকরণে কোন কোন দেবীকে ইজের পরা বলে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং ইজের পরা ছবিও আঁকা হয়েছে (দ্বাদশ শতাব্দী)। ইজেরকে বলা হয়েছে ‘চোলক’। ‘ইজের’ শব্দ ফারসী থেকে এসেছে। এই অর্থে একটি দেশী অর্থাৎ খাঁটি বাংলা শব্দও আ্ছে— জাঙ্গিয়া (সংস্কৃত জঙ্ঘা থেকে)। ‘আঙ্গিয়া’ ‘জাঙ্ঘিয়া’ যথাক্রমে টাইট জামা ও ইজের। মেয়েরাও চাদর ব্যবহার করত। প্রয়োজন মতো তা ঘোমটার কাজ করত। শব্দটি এসেছে প্রাকৃত ‘ঘোঙ্ঘ’ শব্দ থেকে, মানে শামুক-গুগলির খোল। ‘ঘোঙ্ঘ+বৃত্ত’, মানে শামুক-গুগলির খোলার মতো (আবৃত)। গুগলি শব্দও এসেছে এই ঘোঙ্ঘ থেকে। বাংলায় ‘ঘোম্টা’ শব্দ অপেক্ষাকৃত হালের আমদানি।
জুতো-খড়মের সাধারণ নাম ছিল পাউড়ি। এসেছে ‘পদ+*অবঘোটিক’ থেকে। মানে পায়ের আবরণ। জুতা শব্দটির মানে যা পায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে। মধ্য বাংলায় জুতোরই সমার্থক শব্দ হল ‘পানই’। এ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘উপান্হ’ থেকে (মানে যা পায়ে বেঁধে দেওয়া হয়। সেইজন্যে ‘‘বাধা পানই’’ থেকে জুতোর অর্থে বাধা শব্দও এসে গিয়েছিল।) বিচিত্র শব্দ বিকৃতির মধ্য দিয়ে খড়ম এসেছে সংস্কৃত ‘কাষ্ঠপাদুকা’ থেকে। কাঠের এই চটিটি বাঙালীর জাতীয় জুতা। চামড়ার সংস্পর্শ না থাকার জন্যে খড়ম পবিত্র বস্তুও বটে।
জুতো অর্থে মোজা শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর থেকে, মুসলমানের সম্পর্কে। শব্দটি ফারসী। এখন শব্দটি চলে ইংরেজী socks stocking-এর প্রতিশব্দ রূপে। শতাব্দীর মাঝের দিকে বিলিতি বুট বেশ চলতি হয়েছিল শিক্ষিত সমাজে। তখন বলা হত ‘ঘোড় তোলা জুতো।’ কথাটি বিকৃত হয় এসে ‘‘গোড় তোলা’’ থেকে অনেকখানি ঢাকা থাকে। চটি জুতোর নামের ব্যুৎপত্তি বলা মুশকিল। ‘‘চটি, চেটাই’’-এর সঙ্গে সংশ্রব থাকতে পারে। ‘‘চট্চট্’’ শব্দ হয়, তাই ধ্বন্যাত্মকও হতে পারে।
(ক্রমশ)