• facebook
  • twitter
Thursday, 15 May, 2025

বাঙালির ভাষা

মুগা—যা আসাম অঞ্চলে প্রস্তুত হয়— এসেছে সংস্কৃত * মৃদগক থেকে। মানে, মুগের ডালের মতো রঙ। ‘মটকা’ শব্দটি সম্ভবত মোটা শব্দের সঙ্গে সংপৃক্ত।

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তসর হল দেশী সাধারণ রেশমের কাপড়। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘তসর’ থেকে। মানে, তাঁতের মাকু, তাঁত বোনা। কেটে এসেছে বাংলা * কাটিয়া’ থেকে। গুটিপোকা গুটি কেটে বেরিয়ে গেলে সেই কাটা গুটির সুতো দিয়ে যে অত্যন্ত বাজে রকম রেশমি কাপড় হয় তাকে বলে ‘কেটে’। বৈষ্ণবেরা কেটে ছাড়া অন্য রেশমি বস্ত্র পরেন না। কারণ তাতে জীবহিংসা হয়, কেটেয় তা হয় না।

গরদ এসেছে ফারসী ‘গরদ্’, থেকে।
মুগা—যা আসাম অঞ্চলে প্রস্তুত হয়— এসেছে সংস্কৃত * মৃদগক থেকে। মানে, মুগের ডালের মতো রঙ। ‘মটকা’ শব্দটি সম্ভবত মোটা শব্দের সঙ্গে সংপৃক্ত।

মধ্য বাংলায় নেত শব্দ প্রচলিত ছিল ছালের সুতোর বস্ত্রে অর্থে। শব্দটি এসেছিল সংস্কৃত ‘নেত্র’ থেকে। মানে বোধদয় ছিল ছাকনি। (এই অর্থ অনুমান করছি জলবাহী সরু নল অর্থে, চরকসংহিতায় প্রয়োগ থেকে।) এখন ‘ন্যাতা’ (মানে, ময়লামোছা বস্ত্র খন্ড) হয়ে চলিত আছে।

‘ভুনি’ ছিল খাপি মড়মড়ে সুতি বস্ত্র। আমি অনুমান করি যে মধ্য বাংলায় ভুনিই আধুনিককালের মলমল এবং এ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে * মটমটিক, অর্থাৎ ‘মড়মড়ে’ থেকে। পোতা ছিল পুরু কাপড়, যা একদা ছবি আঁকবার চিঠি লেখবার, এমন কি বই রচনারও আধার ছিল। শব্দটি এসেছেও ‘পুস্ত+ক’ থেকে। ‘‘বাঁধিপোতা’’— লেপ-তোষকের এক বিশেষ বয়নের বস্ত্র।

ভুনি, পোতা, ও পট্ট— এই তন ধরণের বস্ত্রের উল্লেখ করে গেছেন কৃষ্ণ-কবিরাজ চৈতন্য চরিতামৃতে। নিমাইয়ের জন্ম হলে অদ্বৈত আচার্যের স্ত্রী সীতা দেবী যে ভেট পাঠিয়েছিলেন নবজাতকের ব্যবহারের জন্যে তাতে ওই তিন রকম বস্ত্রের তোষকের উল্লেখ আছে,
ভুনি পোতা পট্ট পাড়ি…।

একদা তিসি, পাট প্রভৃতি গাছর ছাল থেকে এবং কেয়া প্রভৃতি গাছের পাতা থেকে সুতো হত। সেই সুতোর কাপড়কে বলত ‘খুঞা’ (খুঞো)। সংস্কৃত ‘কৌম’। অত্যন্ত দরিদ্র লোক এবং অরণ্যবাসীরা খুঞার কাপড় পরত। খুঞার কাপড়কে বলত মধ্য বাংলায় ‘খোসলা’।

চাদর এসেছে ফারসী থেকে। সেকালে চাদরকে বলত ‘উড়নি’, সংস্কৃত অবঘোটনিক (=যা ঢাকা দেয়) থেকে। মধ্য বাংলায় আরও একটি শব্দ ছিল এই অ্র্থে, ‘পাষুড়ি’ (সংস্কৃত পশ্চ, পশ্চাৎ-অবঘটিত থেকে)।

সেকালে জামার চল ছিল না। তাই জামার প্রতিশব্দ মধ্য বাংলায় ঠিক মতো নেই। আগে অবশ্য কাঁচলি (সংস্কৃত ‘কুঞ্চুলিকা’ থেকে) শব্দটির মানে ছিল কুচাবরণ। অর্থাৎ বুকের স্তন ঢাকবার ফেটিকা। বস্ত্রখণ্ড বা বেলট (belt)। পুরুষের একরকম জামা অর্থে ‘পেটিঙ্গি’ কথাটি কৃষ্ণদাস কবিরাজ ব্যবহার করেছেন চৈতন্যচরিতামৃতে। শব্দটি হিন্দী হতেও পারে। বুৎপত্তি—পেট+আঙ্গি (সংস্কৃত* আঙ্গিক, মানে অঙ্গবস্ত্র)। গায়ের টাইট জামা হিসাবে আংরাখা শব্দটিও হিন্দী থেকে এসেছে। জামা এসেছে ফারসী থেকে।

‘মউড়’ সংস্কৃত ‘মুকুট’ থেকে) বাঙালীর ট্র্যাডিশনাল শিরস্ত্রাণ। বিয়ের সময়ে বর এ মুকুট পরে। ‘টুপি’, ‘টোপর’ এসেছে প্রাকৃত*টোঙ্গ থেকে। আসলে মানে ছিল বোধহয় চেঁচাড়ির বোনা পাত্র, এবং ‘টোকা, টুকরি’ ইত্যাদির সমার্থক। এইরকম পাত্র হিসেবে ‘টঙ্গর’ ‘টোঙ্গর’ শব্দ ছেলেভোলানো ছড়ায় মেলে।

(ক্রমশ)