শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
শব্দটি খোলা শব্দের খর্বরূপ। ‘হোলা’ মালসারই মতো, তবে আকারে বড়ো। মধ্য বাংলায় শব্দটি ‘হোলনা’ রূপেও মিলছে। কোন বিশেষ রান্নার জন্যেও বিশেষ বাসন তৈরি হয়। যেমন আসকে পিঠের জন্যে। মাটির ‘গেলাস’ এখনকার জিনিস। ও এসেছে ইংরেজি glass থেকে। আামাদের সেকালে জলপানের পাত্র ছিল ‘ঘটী’— ধাতুনির্মিত অথবা ভাঁড়—মাটির গড়া।
পাথরের বাসনের রেওয়াজও কিছু ছিল এবং এখনও আছে। কানা-উঁচু পাথরের থালাকে এখন বলে খোরা। শব্দটি এসেছে ফারসী তেকে ‘খুরা’ মানে খাদ্য অথবা খাওয়া। (এরই খর্বরূপ ‘খুরি’)। আগে বলত ‘পাথরা’ (সংস্কৃত ‘প্রস্তর’ থেকে)।
কবিকঙ্কণ লিখেছেন, ‘মাটিয়া পাথরা’ (কালকেতুর ভাত খাবার পাত্র)। এর দু-রকম মানে হতে পারে। এক মাটির থালা, দুই মেটে পাথরের থালা। শেষের অর্থই সঙ্গততর মনে হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে মাঝারি সাইজের বেশি কানা-উঁচু পাথরের পাত্রকে বলে ‘আাধ-খোরা’ (অর্থাৎ খোরার অর্ধেক মাপের)। খোরা-খুরির তলা চেপটা এবং খাড়া ও উঁচু কানা। অন্যরকম হলে বলে এখন ‘পাথরের থালা’, ‘পাথরের-বাটি’। কাঁসা-পিতলের থালায় ভাত খাওয়ার রেওয়াজ পুরোনো নয়। তখন লোকে ভাত খেত থোরা কিংবা কলাপাতায় অথবা শালপাতায় বা পদ্ম পাতে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি পন্ডিতি রসিকতার শ্লোক।
অয়ঃপাত্রে পয়ঃপানং শালপত্রে চ ভোজনম্।
তালপত্রে চ শয়নম্ মল্লভূমি নিবাসিনাম্।।
‘লোহার পাত্রে জলপান, শালপাতায় ভোজন, তালপাতায় (অর্থাৎ চেটাইয়ে) শয়ন—(এ ছিল) মল্লভূমির অধিবাসীদের রীতি।’
(লোহার বাসন, উনুনে চড়াবার বাইরে, অপবিত্র বলে গণ্য হয়ে এসেছে সেদিন পর্যন্ত। ছেলেবেলায় দেখেছি বিধবারা কলাই করা পাত্রেও খেতেন না।)
‘কড়া’, ‘কড়াই’ (সংস্কৃত ‘কটাহ’) লোহার হয়, পিতলের হয়, মাটিরও হয়। ‘হাতা’ (সংস্কৃত ‘হস্তক’ থেকে, মানে হাতের মতো) ও ‘খনতি’ (খুনতি) (সংস্কৃত খনত্রিক থেকে, মানে চাঁচবার ফলক) লোহারও হয়, পিতল কাঁসারও। ‘বেড়ি’ (সংস্কৃত * বেষ্টিক থেকে, হাঁড়ির গলা বেড়ে নামাবার হাতিয়ার) লোহারই দেখেছি। পলা (সংস্কৃত * ‘পলক’ থেকে) লোহার পিতল কাঁসারও হয়। পলায় তেল-ঘি তোলা হয়।
‘থালা’ ‘ঘড়া’ ‘ঘটি’—কাঁসা ও পিতল দুয়েরই হয়। ‘থালা’ থালি এসেছে সংস্কৃত স্থালী, স্থালিক থেকে। গোড়ায় মানে ছিল মাটির পাত্র (তুলনীয় স্থল)। ‘ঘড়া’ এসেছে সংস্কৃত ‘ঘট+ক’ থেকে। ঘটি মানে ছোট ঘট) তৎসম ‘ঘট’ থেকে। এই অর্থে প্রাচীন বাংলায় ‘ঘডুলী’ শব্দ পাওয়া গেছে। সংস্কৃত ‘ঘটী’ থেকে এসেছে অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত ঘটি অর্থে এবং সর্বত্র প্রচলিত সময়জ্ঞাপক যন্ত্র অর্থে। ক্ষীর্ণ ডমরু-মধ্য ঘটিকাপাত্রে বালি অথবা জল রেখে সেকালে সময় নির্ণয় করা হত।
এরকম ঘটিকা তামারও হত। তাই ঘড়ির নামান্তর ছিল ‘তামি’ (তাম্রিকা থেকে) আধুনিক দম দেওয়া ঘড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে এদেশে অজ্ঞাত ছিল। ছোট কাঁসার থালা বা প্লেট হল কাঁসি। শব্দটি এসেছে ‘কাংস্য’ (মানে কাঁসা) থেকে। কাঁসি বাদ্যযন্ত্রও বটে, ঢোলের সঙ্গে বাজানো হয়। পূজায় আরতিতে বাজানো হয় ‘কাঁসর’, দোমড়া মুখ-উঁচু কানাওয়ালা কাঁসি। এও কাঁসার তৈরি। ঘণ্টা (সংস্কৃত শব্দ)-ও তাই। কাঁসরের সঙ্গে বাজানো হয়। ঘন্টা দুরকম—হাতুড়ি পেটা, কাঁসর বড়ো মোটা চাকতি, আর হাতে নাড়া। এ ঘণ্টা যে উল্টানো বাটি। ভিতরে একটি ঝোলানো ধাতুখন্ড আছে। হ্যা্ডেল ধরে নাড়লে বাজে। পেটা ঘন্টাকে ঘড়িও বলে। এ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘ঘন্টিকা’ থেকে।
(ক্রমশ)