বিশ্বে ১১০ কোটি মানুষ তীব্র দারিদ্রের মধ্যে রয়েছে। এর অর্ধেক মূলত পাঁচটি দেশে, যার শীর্ষে রয়েছে ভারত। এদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি। তালিকায় বাকি চারটি দেশ হল পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, নাইজিরিয়া ও কঙ্গো। এই দরিদ্রের ৮৩ শতাংশই বাস করেন গ্রামাঞ্চলে। বিশ্বের ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
দিনকে রাত ও রাতকে দিন করে দিতে অভ্যস্থ নরেন্দ্র মোদী নিজেকে গরিব মানুষের ‘ত্রাতা’ হিসাবে উপস্থিত করেছন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তাঁর দাবি, স্বাধীনতার পর কোনও সরকার যা পারেনি, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। দশ বছরে কমিয়ে দিয়েছেন গ্রাম-শহরের দারিদ্রের হার। তাঁর ব্যাখ্যা, ২০১২ সালে ভারতে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ শতাংশ। এখন তা ৫ শতাংশের কম। দশ বছেরে ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। তাঁর হিসাব মতো এই মুহূর্তে গ্রামীণ জনতার ৯৫ শতাংশকে আর গরিব বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই দাবি মূলত স্টেট ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা রিপোর্ট। এই সমীক্ষায় গ্রামীণ অর্থনীতির মূল উপাদান ১০০ দিনের কাজ কিংবা দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলমুখী করতে চালু মিড ডে প্রকল্প নিয়ে একটি শব্দও ব্যায় করা হয়নি। আসলে সরকারি তথ্যই বলছে, এই দু’টি প্রকল্পেই সরকারি বরাদ্দ বছর বছর কমেছে।
মোদীর ভাষণে যখন দেশের উন্নয়ন ও বিকাশের জোয়ার বইছে তখন মানব উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে গত তিন দশকে পড়ে আছে একই জায়গায়। সামগ্রিকভাবে সামাজিক খাতে জিডিপি-র অংশ হিসাবে ব্যয় কিঞ্চিত বাড়লেও কমে গেছে শিক্ষা খাতে। ১৯৯০-৯১ সালে সামাজিক খাতে সরকার খরচ করতো মোট জিডিপি-র ৫.৮ শতাংশ। এখন ২০১৯-২০ সালে খরচ হয়েছে ৬.৮ শতাংশ। এই তিন দশকে জিডিপি-র পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেলেও সামাজিক খাতে সরকারি খরচ বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ। সামাজিক খাতে ব্যয় মূলত সাধারণ মানুষের জন্য। শাসকরা ভারতকে জনকল্যাণমুখী দেশ বলে দাবি করলেও জনগণের উন্নয়নে বরাদ্দ কিন্তু বাড়েনি।
২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত করার স্বপ্ন ফেরি করতে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপি নিরন্তর প্রচার করে চলেছে। অথচ উন্নত হবার প্রাথমিক শর্ত যে জনকল্যাণ সেটাই সবচেয়ে উপেক্ষিত এবং অবহেলিত। উন্নত ও বিকশিত অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যেমন সরকারি ব্যয়-বরাদ্দ বাড়ে তেমনই-সরকারি ব্যায়ে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ সামাজিক ক্ষেত্রেও বরাদ্দ বাড়ে। যে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক ও সকলের জন্য নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অনুরূপ নয় সে দেশ কোনোদিন উন্নত হতে পারে না।
একটা দেশ তার বৃহত্তর জনসংখ্যাকে পেছনে ফেলে ক্ষুদ্রতর অংশকে নিয়ে উন্নত হতে পারে না। জিডিপি বেশি হলেও, মাথাপিছু জিডিপি আরও বাড়লেও তার সুবিধা যদি আমজনতার কাছে না পৌঁছায় তাহলে তাকে উন্নত বলা যায় না। মোদী শিবির যে ফাইভ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির কথা বলছে সেটা আসলে অল্পসংখ্যক মানুষের অতি ধনী ও সম্পদশালী হওয়া। এরাই উন্নত ও আধুনিক শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুবিধা ভোগ করবে, উন্নত যোগাযোগের সুযোগ পাবে। আর আমজনতা যে তিমিরে ছিল সেখানেই থেকে যাবে।
সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়িয়ে মানবোন্নয়ন জোরদার করতে হলে সরকারের সামগ্রিক ব্যয় অনেক বাড়াতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন রাজস্ব বৃদ্ধি বা সরকারের আয় বৃদ্ধি। তাতে ধনীদের উপর কর বাড়াতে হবে। কিন্তু ভারতে পুঁজিবাদের ধারক-বাহকরা সেটা কোনও অবস্থাতেই হতে দিতে রাজি নয়। তাই জিডিপি-র সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকারের আয়-ব্যয় বাড়েনি। তেমনই সামাজিক খাতে ব্যয়ও বাড়েনি।



