গৌতম মণ্ডল
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন নিউইয়র্ক সিটিতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান কোয়েমে মামদানি মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি নিউইয়র্কের জন্য সমস্ত অনুদান প্রদান বন্ধ করে দেবেন। শুধু হুমকি নয়, ট্রাম্প মামদানিকে হারাতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন। ১৬ জুন, ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি না যে মি. মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের ভোটপত্রে থাকার উপযুক্ত’। শুধু তাই নয়, ওই সম্পাদকীয়তে লেখা হয় রাজনীতিবিদ হিসেবে মামদানির ‘অভিজ্ঞতা খুবই নিঃস্ব’ । কিন্তু ট্রাম্পের কোনো লম্ফঝম্ফ ও নিউইয়র্ক টাইমসের ভবিষ্যৎবাণী কোনো কাজে এল না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যাঁকে জেতানোর জন্য সমস্ত ধরনের কৌশল ও শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন সেই রিপাবলিকান দলের প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুমো শেষপর্যন্ত পরাজিত হলেন রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই নবাগত মামদানির কাছে। ফলশ্রুতি বিগত ১০০ বছরের নিউইয়র্কের ইতিহাসে কনিষ্ঠতম মেয়র হিসেবে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে জয়ী হলেন জোহরান মামদানি। এই জয় শুধুই একটি নির্বাচনভিত্তিক জয় নয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। নিউইয়র্ক সিটির মতো বিশ্বের অন্যতম বড় নগরীতে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত একজন মুসলিম যুবক মেয়র নির্বাচিত হলেন— এটি এই মুহূর্তে নিজেই একটি বড় সংবাদ । কিন্তু কে এই মামদানি? তাঁর জয়কে কেন আমেরিকার রাজনীতিতে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখতে চাইছি? ভারত বা বাংলার সঙ্গে তাঁর কি কোনো যোগসূত্র আছে? থাকলে কীভাবে ?
Advertisement
জোহরান কোয়ামে মামদানি জন্মগ্রহণ করেন ১৮ অক্টোবর ১৯৯১, আফ্রিকার উগান্ডার কামবালায়। বাবা হলেন একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত উগান্ডিয় শিক্ষাবিদ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক মাহমুদ মামদানি আর মা ‘সালাম বোম্বে’-সহ বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের ভারতীয় মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নায়ার। মামদানি যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন বাবার কর্মসূত্রে তাঁর পরিবার দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন চলে যান। সেখানে তিনি সেন্ট জর্জস গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা করেন এরপর তাঁর বয়স যখন সাত বছর, মামদানির পরিবার নিউইয়র্ক সিটিতে চলে আসে। এখানে তিনি ব্যাঙ্ক স্ট্রিট স্কুল ফর চিলড্রেন এবং এরপর ব্রঙ্কস হাই স্কুল অফ সায়েন্স থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে মামদানি মেইন রাজ্যের বোডোইন কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি Students for Justice in Palestine সংগঠনের কলেজ শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। এর পক্ষে পেয়ে যান অনেক বামমনস্ক সহপাঠীকেও। তিনি ওই কলেজ থেকে ২০১৪ সালে আফ্রিকান স্টাডিজ-এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সংগীতের প্রতি ছোটবেলা থেকেই মামদানির ছিল গভীর অনুরাগ। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে তিনি হিপ-হপ সংগীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি ২০১৬ সালে ‘ইয়ং কার্ডামম’ ছদ্মনামে উগান্ডীয় র্যাপার HAB-এর সঙ্গে Sidda Mukyaalo EP-তে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা মীরা নায়ার পরিচালিত Queen of Katwe চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাকে একটি গানও পরিবেশন করেন।২০১৯ সালে মিস্টার কার্ডামম নামেই তিনি ‘Nani’ শীর্ষক একক গান প্রকাশ করেন। বোঝাই যায়, রাজনীতিতে আসার আগে গানের প্রতি তাঁর ছিল একটা তীব্র প্যাশন।
Advertisement
কলেজে পড়াকালীন প্যালেস্তাইনের পক্ষে মতামত তৈরি করতে গিয়ে তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। কলেজের বাইরে মামদানির রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় আলী নাজমির নির্বাচনী প্রচারণায় একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে, যাঁরা নিউইয়র্ক সিটির ২৩তম সিটি কাউন্সিল নির্বাচনের ২০১৫ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এক বছরের মাথায়, ২০১৭ সালে তিনি ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকা (DSA)-তে যোগ দেন ।
২০১৯ সালে তিনি টিফানি ক্যাবান- এর কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি নির্বাচনের প্রচারণায় নিজেইএকজন ফিল্ড অর্গানাইজার হিসেবে কাজ করেন। চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আরাভেলা সিমোটাসকে পরাজিত করে তিনি ২০২০ সালে প্রথম নিউ ইয়র্ক রাজ্য বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ২০২১ সাল থেকে তিনি কুইন্সে অবস্থিত নিউইয়র্ক রাজ্য বিধানসভার ৩৬ তম জেলার নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ভাড়ার উপর হিমায়িত অবস্থা বজায় রাখা, বিনামূল্যে বাস পরিষেবা, সরকারি স্তরে শিশু যত্ন ব্যবস্থা এবং শহরের মালিকানাধীন মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা এবং তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম মূল্যের সামাজিক আবাসন ইউনিট নির্মাণ । মামদানির নির্বাচনী যাত্রা ছিল আসলে এক ‘গ্রাসরুটস’ (grass-roots) অভিযাত্রা। তিনি যুবকদের মধ্যে প্রত্যয় জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন এই বলে : ‘The future is in our hands.’। আগেই উল্লেখ করেছি মামদানি নিজে একজন আমেরিকান হয়েও প্যালেস্টাইনের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার এবং একইসঙ্গে ইসরায়েলের আগ্রসনের একজন কট্টর সমালোচক। বাবা মাহমুদ মামদানি পুত্রের মধ্য নাম ‘কোয়ামে’ রেখেছিলেন সম্ভবত কোয়ামে এনক্রুমাহর নামে, যিনি ছিলেন ঘানার একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী নেতা এবং ওই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি যে খুব ভুল করেননি তা আজ অনেক সংগ্রামের ভিতর দিয়ে পুত্র মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় সেকথা বলাই যায়।
মেয়র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগে, মামদানি কুইন্সের দারিদ্র্যপীড়িত মালিকানাধিকারীদের আবাসন পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন। সেখানে তিনি কম আয়ের গৃহমালিকদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ও তাঁদের ঘরে থাকার অধিকার রক্ষা করতে আইনি সহায়তা করতেন। বলাবাহল্য, এই ক্যুইনস প্রদেশে বিপুল পরিমাণ বাঙালি বসবাস করেন। এর মধ্যে লক্ষাধিক বাঙালি এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। ভারতীয় বাঙালিও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানে রয়েছে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠন। এখানে পয়লা বৈশাখ, ভাষাদিবস, দুর্গাপুজো— খুব মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। ক্যুইনসে কাজ করতে গিয়ে তাই মামদিন শুধু বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন, তা নন, নিজেও কিছুটা শিখে ফেলেন বাংলা ভাষা।
এখন একটা প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় মামদানি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় আমেরিকা বা বিশ্বের কী সুবিধা হতে পারে ? যেভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সারা বিশ্বজুড়ে উগ্র দক্ষিণপন্থা ও আধিপত্যবাদ কায়েম করছে, কোনোরকম শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে সমগ্র বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে তুলছে এবং ইজরায়েলকে প্রত্যক্ষভাবে মদত দিয়ে প্যালেস্তাইনকে বধ্যভূমিতে পরিণত করছে সেখানে আমেরিকা থেকেই একটা সংহত বিরুদ্ধ স্বরের উত্থানের প্রয়োজন ছিল। নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে বাংলা ভাষা জানা জোহরান মামদানি নির্বাচিত হওয়ায় তিনিই আগামীদিনে কিছুটা হলেও সেই বিরুদ্ধ স্বরের প্রতীক হয়ে হয়ে উঠতে পারেন বলে আপাতত আশা রাখা যায়।
Advertisement



