আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র হলেন জোহরান মামদানি। একটি শহরের মেয়র নির্বাচন নজর কেড়ে ছিল বিশ্ববাসীর, অবশ্যই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌজন্যে। মামদানির বিরোধিতা করে প্রকাশ্যে শুধু ট্রাম্প নন, নেমেছিলেন বিল অ্যাকমান, এলন মাস্কের মতো কোটিপতি প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। ট্রাম্পের হুমকি উড়িয়ে আমেরিকার বাণিজ্যিক নগরী নিউইয়র্কের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র হতে চলেছেন পরিচালক মীরা নায়ারের ছেলে মামদানি। নিউ ইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়রও হবেন তিনি। ২০২৫-এর আমেরিকায় জোহরান এক স্পষ্ট ও নির্ভীক অভিবাসী স্বর, যিনি গত এক বছর ধরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলেছেন। ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগেও ট্রাম্পের অনুদান-বন্ধের হুমকি শুনে সামান্য হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘উনি তাহলে ভয় পেয়েছেন।’ ভোটে জিতে মামদানি ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, ‘এবার উনি যত খুশি চিৎকার করুন।’
‘ইতিহাসে কখনও কখনও এমনই এক বিরল মুহূর্ত আসে, যখন আমরা পুরনো থেকে নতুনের দিকে পা বাড়াই, এক যুগের অবসান ঘটে, যখন বহুদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা এক জাতির অন্তরাত্মা নিজের ভাষা খুঁজে পায়।’ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট জওহরলাল নেহরুর কালজয়ী বক্তৃতা থেকে এই উদ্ধৃতি দিয়েই নিজের ঐতিহাসিক জয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিউইয়র্কের প্রথম বামপন্থী মেয়র (ট্রাম্পের ভাষায় ‘কমিউনিস্ট’) জোহরান মামদানি। বছর খানেক আগে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। পরবর্তী এক বছরে মামদানি ৩০ লক্ষ মানুষের কাছে পায়ে হেঁটে ভোট চেয়েছেন। অভিনব কায়দায় সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর মতো ঘটনা এটি।
Advertisement
জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থনের জোয়ারে জামদানি যতই ভাসছেন, ততই ট্রাম্পের ভয় ও উদ্বেগ বাড়ছে। তার থেকেই ছড়িয়েছে আতঙ্ক। তাই মামদানিকে ভোটে হারাতে তিনি সব রকমের চেষ্টা চালিয়েছেন। মামদানি কমিউনিস্ট, মার্কসবাদী, বামপন্থী বলে বিস্তর গালি দেবার পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে উপহাস-বিদ্রূপও করেছেন। বলেছেন, মামদানিকে দেখতে কুৎসিত, ভালো করে কথা বলতে জানেন না ইত্যাদি। বলেছেন, তিনি চান না কোনও কমিউনিস্ট নিউ ইয়র্কের মতো শহরের মেয়র হন। ভয় দেখিয়েছেন, হুমকি দিয়েছেন, বলেছেন, মামদানি জয়ী হলে শহরের জন্য সমস্ত কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বন্ধ করে দেবেন। মামদানির হাতে নিউ ইয়র্কের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
Advertisement
ট্রাম্প মামদানিকে যত বেশি আক্রমণ করেছেন, অপমান করেছেন, ততই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আরও বেশি বেশি মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। শেষে আর কোনও উপায় না দেখে নিজের দলের (রিপাবলিকান পার্টি) প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে মামদানির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তাঁরই দলের নির্দল প্রার্থীকে ভোট দিতে আহ্বান জানান। আসলে মামদানির ভোট কাটাটাই ছিল লক্ষ্য।
কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে নিউ ইয়র্কের মানুষ জিতিয়ে দিলেন মামদানিকে। অর্থাৎ ট্রাম্পের কার্যকলাপ, প্রশাসন চালানোর ধরনের বিরুদ্ধেই যেন রায় দিলেন মানুষ। মাত্র ৩৪ বছরের যুবক, জন্মসূত্রে উগান্ডা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত, ধর্মে মুসলিম নিউ ইয়র্কের মেয়র হতে একাধিক নজির সৃষ্টি করেছেন মামদানি।
নিজেকে ডেমোক্রাট সোস্যালিস্ট দাবি করে তিনি যে বিষয়গুলিকে নির্বাচনের প্রধান ইস্যু করেছিলেন, সেগুলি মন কেড়েছিল নিউ ইয়র্কের মানুষের। কর্পোরেট পুঁজির শক্তির বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্ক শহরকে গরিব, নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ এবং মধ্যবিত্তদের বাসযোগ্য করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। ইজরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্যালেস্তাইনের পক্ষে বারবার গর্জে উঠেছেন। কোথাও তোয়াক্কা করেননি ট্রাম্পকে। নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকে নিজের ঢঙে প্রচার করে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। ইতিমধ্যে মার্কিন নাগরিকরা মামদানির মধ্যে ট্রাম্প জমানার বিনাশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। প্রচলিত দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মধ্যেই মার্কিন রাজনীতিতে জনস্বার্থে এক নতুন সমীকরণ খুঁজছেন। আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় শহরে, বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার কেন্দ্রে এমন ঝটিকা পরিবর্তন চমকে দিয়েছে বিশ্বকে। মামদানির জয় এখন শুধু একটা শহর জয় নয়, মার্কিনীদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। এবার অপেক্ষা শুধু পরিবর্তনের।
Advertisement



