‘নায়ক’ ছবিটাকে নতুন করে রেস্টোর করা হল। এই উদ্যোগের বিষয়ে কী অভিমত আপনার?
এটা খুব ভালো একটা উদ্যোগ বলেই আমার মনে হয়। বিশেষ করে এই প্রজন্ম তো ছবিটাকে বড়ো পর্দায় দেখেনি। আর ডি বনশলদের আমি সাধুবাদ জানাই এর জন্য কারণ ওঁদের কাছে বাবার এতগুলো ভালো ভালো ছবি রয়েছে। সেগুলো যদি এক এক করে প্যান ইন্ডিয়া রিলিজ হয়- তাহলে তো খুবই সুখের কথা। বনশলরা এর আগে ‘মহানগর’ রিলিজ করেছিলেন, সেটাও ভালো চলেছিল। সেই কারণেই হয়তো ওঁরা নায়ক নিয়ে উদ্যোগী হলেন। এটা তো রেস্টোর্ড প্রিন্ট, কাজেই ঝকঝকে ছবি দেখতেও ভালো লাগবে দর্শকদের।
এই ছবিকে ঘিরে কোনও স্মৃতি যদি থাকে, একটু শেয়ার করুন।
স্মৃতি তো অনেক। তখন অবশ্য আমি খুবই ছোট। তবে এটা বুঝেছিলাম যে এই ছবিটা করা খুবই কঠিন ছিল। একটা ট্রেনের মধ্যে ঘটনা। অদ্ভুতভাবে শ্যুটিং করা হয়েছিল এবং মানুষ ধরতেই পারেননি যে এটা নকল ট্রেন। খুবই খাটুনির ব্যাপার ছিল সব দিক থেকে— তোলা এবং তৈরি করার ক্ষেত্রে। শব্দ যেমন এখানে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ট্রেনের ডাইনিং কার-এ এক রকমের শব্দ, করিডরে এক রকম আবার বাথরুমে আরেক রকমের শব্দ। তখন তো ‘ফলি’ কথাটা আসেনি। কিন্তু ওই শব্দগুলোকে পোস্ট প্রোডাকশনের সময় বসানো হয়েছিল।
তাছাড়া ছবিটা তো উত্তমবাবুকে ভেবেই করা। সেই ভাবেই লেখা। বাবা অনেকদিন ধরেই উত্তম কুমারের ছবিগুলি দেখছিলেন। উনি বাবার খুব পছন্দের অভিনেতাও ছিলেন। ফলে দু’জনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় এবং উনি উত্তমবাবুকে কাস্ট করেন। বাবা কোনও দিন ওয়ার্কশপ টাইপের কিছু করেননি। তবে অবশ্যই উত্তমবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, স্ক্রিপ্ট শুনিয়েছিলেন এবং উত্তমবাবুও খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন। বাবা তো কথা বলে ভীষণ ভালো লোক চিনতে পারতেন। ফলে অরিন্দমের চরিত্রে উত্তম কুমারের বিকল্প হয় না। একজন শীর্ষে থাকা নায়কের দুঃখ, যন্ত্রণা, সাফল্য, সবকিছুর সঙ্গেই উত্তমবাবু নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছিলেন। পরে উনি বলেছিলেন, যেভাবে চিত্রনাট্যটা তৈরি হয়েছে তাতে ওনাকে সংলাপ মুখস্থ করতেই হয়নি। খুব সহজে চলে এসেছে।
বাবা ওঁকে উইদাউট মেকআপ এই ছবিতে অভিনয় করিয়েছিলেন। ‘নায়ক’-এর শ্যুটিংয়ের আগে উত্তমবাবুর চিকেন পক্স হয়েছিল। তাই প্রথমে মেকআপ করা হবে না শুনে উনি বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন। বাবা বলেছিলেন ‘তুমি আমাকে তো বিশ্বাস করো, আমি যা তুলছি তার কিছু ফুটেজ না হয় তোমায় দেখাব।’ পরে ওই রাশ দেখে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন উত্তমবাবু যে বলেছিলেন, ‘তাহলে আমি মেকআপ রুমে এত সময় নষ্ট করি কেন!’ কোনওদিনই মেকআপে বিশ্বাসী ছিলেন না বাবা। একটু প্যডিং আর সামান্য চোখে টাচ দেওয়া, ব্যস এইটুকুই।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নায়ক ছবির প্রাসঙ্গিকতা কতটা বলে মনে হয় আপনার ?
বাবার সমস্ত ছবিই ভীষণ প্রাসঙ্গিক। ক্লাসিক ছবি মানেই সেটার কোনও কালের গণ্ডি নেই। তখনও দেখতে ভালো লেগেছে, এখনও দেখতে ভালো লাগছে। আর ওঁর একই ছবি বিভিন্ন বয়সে দেখলে এক এক রকম আনন্দ পাওয়া যায়। কম বসয়ে দেখলে একরকম, আর পরিণত বয়সে দেখলে আরেক রকম।
‘নায়ক’ ছবিতে যে-সাংবাদিকের সঙ্গে অরিন্দমের মনোমালিন্য হয়, তিনি স্টেটসম্যান কাগজে নায়কের বিপক্ষে খবর বের করেছিলেন। আবার ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’ ছবিতেও, সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রেক্ষিতে যে-কাগজটি ছুঁড়ে দেওয়া হয়- সেটাও ছিল স্টেটসম্যান। সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে সংবাদপত্রটির এই যে যোগসূত্র, এটার বিষয়ে কী বলবেন?
তখন তো ইংরেজি কাগজ খুব একটা ছিল না। বরাবর বাড়িতে স্টেটসম্যানই আসত। ফলে সত্যজিৎ রায়ের পছন্দের কাগজ বলতে ছিল স্টেটসম্যান, যা একাধিকবার তাঁর ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে।